/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/06/pashupati-1.jpg)
ছবি- লেখক
পরাধীন ভারতের মুক্তিকামী মানুষের লড়াইয়ের সাক্ষী এ বাড়ি। আবার গঠন বৈচিত্রের বিচারে সারা শহর ঢুঁড়ে এর দ্বিতীয় নজির মেলা ভার। অথচ খুব কম মানুষ এ বাড়ির হদিশ রাখেন। একদা যে বাড়িতে কতশত গুণিজনের পদধূলি পড়েছিল, হেরিটেজ কমিটির গ্রেড ওয়ান তকমা যার গায়ে, সেই নাকি আজ বাদে কাল হয়ে উঠবে তারকা খচিত হোটেল! উত্তর কলকাতার বাগবাজারে এক অবিস্মরণীয় অতীত ও অভূতপূর্ব স্থাপত্য নিয়ে ভোলবদলের দিন গুনছে কলকাতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হেরিটেজ বসতবাড়ি। পশুপতি বসুবাড়ি।
বাগবাজার ঘাট থেকে অনতিদূরে সংকীর্ণ এক গলি পশুপতি বসু লেনের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে এই প্রাসাদ। এই পশুপতি বসু হলেন দশরথ বসুর চব্বিশতম প্রজন্ম। যে দশরথ বসুর নাম প্রথম ‘বসু’ পদবিধারী হিসেবে পাওয়া যায়। এই বসু বংশেই একদিকে যেমন জন্মেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র, অন্যদিকে ‘অডিয়ো সাউন্ড’-এর ক্ষেত্রে সুবিখ্যাত ‘বোস করপোরেশন’এর প্রতিষ্ঠাতা অমর গোপাল বোস। পশুপতিনাথ, মহেন্দ্রনাথ ও নন্দলালের পিতা মাধবচন্দ্র বসু ১৮৫৯ সালে মারা যান। গয়ার জমিদারি থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ২২ বিঘা জমি কিনে তার ওপর তৈরি হয় এই অট্টালিকা। স্থপতি ছিলেন নীলমণি মিত্র। ১৮৭৬ সালে এ বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, দু বছর লাগে সম্পূর্ণ হতে।
আরও পড়ুন, শহরের বুকে এক ফালি স্কটল্যান্ড
নীলমণি মিত্র ছিলেন প্রথম বাঙালি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তৎকালীন প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদাধিকারী হয়েও কতৃপক্ষের সাথে মতবিরোধে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। বসুবাড়ি ছাড়াও কলকাতার কিছু উল্লেখযোগ্য বাড়ি, এমনকি শ্রীরামপুরের মাহেশের রথেরও রূপকার ছিলেন তিনি। দক্ষিণমুখী এই দোতলা বাড়ির সামনে ডরিক কলাম।
এই কলামগুলির শীর্ষে পদ্মফুলের পাপড়ি খোদাই করা, তার নীচে সিংহের মাথা, কেশরের তলা দিয়ে মালার আকারে গোলাকার বিড। ছাদে লোহার বিম।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/06/pashupati-5.jpg)
দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে দেখা যায় প্রশস্ত উঠোনের দক্ষিণ, পুব ও পশ্চিম দিকে সার সার ঘর, ঢাকা বারান্দা।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/06/pashupati-4.jpg)
উত্তর প্রান্তে দুতলা সমান উচ্চতা বিশিষ্ট ঠাকুরদালান। অতীতে এখানে দুর্গাপূজা ও অন্যন্য উৎসব অনুষ্ঠান হতো। একদা এই ঠাকুরদালান সুবিখ্যাত ছিল তার দেওয়ালের পেন্টিং এবং প্লাস্টারের মোটিফগুলির জন্য, যেগুলি ছিল খাঁটি বাঙালি শিল্পকলার নিদর্শন। ছিল বাংলার পটচিত্র ধারায় আঁকা পুরান, রামায়ণ, মহাভারতের ছবি। এখন পলেস্তারা ও চাঙ্গড় খসে পড়ার কারণে ঠাকুরদালানে প্রবেশ বেশ বিপজ্জনক, কেবল পায়রাদের সপরিবারে বসবাস। জানা যায় অতীতে পুরো বাড়ির দেয়ালগুলি ছিল কারুকার্যময়। ছাদে সোনালি রঙ। পূবদিকে ছিল বৈঠকখানা, দোতলায় নাচঘর। মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট অন্দরমহলে আরেকটি ছোট উঠোন, সেদিকে খুব ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় ছাড়া পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। বসু বাড়ির স্থাপত্যের অভিনবত্বের অন্যতম কারণ ছিল, নীলমণি মিত্র এই বাড়ির ডিজাইনে প্রচলিত ইওরোপিয়ান ধারার বিরুদ্ধে গিয়ে হিন্দু ও মুসলমান প্রভাবের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ঠাকুরদালানের তিন সারির কলামের বাইরের সারির কলামশীর্ষে হিন্দু ধারার পদ্ম ফুলের মোটিফ, ভিতরের দুই সারির কলাম খর্বকায়, চৌকোনা বেস-এর ওপর, দেখতে মধ্যযুগীয় হিন্দু মন্দিরের পিলারের মত। সেগুলির শীর্ষেও প্রতিটি সারিতে আলাদা রকম ফুলের মোটিফ।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/06/pashupati-11.jpg)
ঠাকুরদালানের চারপাশের থামগুলি একতলায় আটকোনা, সেগুলিতে প্লাস্টারের অভিনব কাজ। দোতলায় তা গোলাকার, চিরাচরিত ইওরোপিয়ান ধাঁচের। বসুবাড়িতে ব্যবহৃত আর্চ গুলি আবার মুসলিম ঘরানার।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/06/pashupati-6.jpg)
প্রবেশপথের বাঁ দিকে দোতলায় যাবার কাঠের সিঁড়ি, কারুকাজ করা লোহার রেলিং ও কাঠের হাতল। সিঁড়ি ঘরের ওপরে একটি স্কাইলাইট, যা সে যুগের পক্ষে একটু অস্বাভাবিক। সম্ভবত কলকাতায় বিদ্যুতের আলো আসার আগে এ বাড়ি তৈরি বলেই এটির সংযোজন।
আরও পড়ুন, কলকাতার কৈলাস: ভূকৈলাস
বসুবাড়ি তৈরি হওয়ার আগেই মহেন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে, বাড়ির মালিক হন বাকি দুই ভাই পশুপতি বসু ও নন্দলাল বসু। এঁদের বংশধরদের মধ্যে সম্পত্তি বিভাজন ও পরবর্তীকালে হাতবদল ঘটে। পূব দিকের অর্থাৎ পশুপতিনাথের অংশ ও অন্দরমহল এখন সরকারি লাইব্রেরির দখলে। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে এই অংশটি ক্রয় করা হয়েছিল, রামকৃষ্ণ ডে স্টুডেন্টস হোম এখনো সেখানে সচল। পশ্চিম দিক থাকে নন্দলাল বসুর বংশধরদের হাতে। কালের অমোঘ গতিতে এত প্রকাণ্ড প্রাসাদের দেখভাল বাসিন্দাদের পক্ষে ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। শোনা যায়, বসু পরিবারের সদস্যরা এ দায়িত্ব ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কতৃপক্ষের হাতে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিপুল খরচের কথা ভেবে সেটিও বাস্তবায়িত হয়নি। পরিবারের সদস্যদের ট্রাস্ট করে বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচা চালাবার পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়। অবশেষে ২০০৭ সালে এ বাড়ি অধিগ্রহণ করে হর্ষবর্ধন নেওটিয়ার ‘অম্বুজা রিয়েলটি’, তাদের পরিকল্পনা এই ঐতিহাসিক বাড়িতে একটি হেরিটেজ হোটেল গড়ে তোলার।
আরও পড়ুন, হাওড়া ব্রিজ: পঁচাত্তর বছর বয়সী সর্বংসহ
এ বাড়ির অতীত মালিক পশুপতিনাথ ও নন্দলাল ছিলেন ভারতীয় শিল্পকলার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন অজস্র তৈলচিত্র, কালীঘাটের পট, তাঞ্জোর আর্টের নানা নিদর্শন। ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত শিল্পী বামাপদ ব্যানার্জির আঁকা বেশ কিছু পৌরাণিক ছবির দৃশ্যকল্পের তৈলচিত্র ছিল তাঁদের সংগ্রহে। জানা যায় একতলার দক্ষিণের প্রকান্ড হলঘরটিতে স্টেইনড গ্লাস পেইন্টিং-এ দশাবতার সৃষ্টি করা হয়েছিল, যা কাঁচের দুদিক থেকেই দৃশ্যমান ছিল। প্রখ্যাত শিল্পী যামিনী রায় বহুবার এসেছেন এবাড়িতে, ছবির, বিশেষত পটচিত্রের সংগ্রহ দেখার জন্য। নন্দলাল বসু ছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের ভক্ত। পরমহংসদেব বসুবাড়িতে এসে এসব ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/06/pashupati-10.jpg)
বসু পরিবার ছিলেন থিয়েটারপ্রেমী। ১৮৯১ সালে স্টার থিয়েটার ও গিরিশ ঘোষের বিচ্ছেদের পরে বসুরা তাঁদের বাড়ির দরজা খুলে দেন স্টার-এর অবশিষ্ট অভিনেতাদের জন্য। ‘সিটি থিয়েটার’ নামে এখানেই চলত নাট্যচর্চা। এই সেই একমাত্র বাঙালি বাড়ি যেখানে পা রেখেছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ, থিয়েটার দেখতে। সুদূর গার্ডেনরীচ ঘাট থেকে গঙ্গাবক্ষে বাগবাজার ঘাটে নেমেছিলেন নির্বাসিত নবাব, উপভোগ করেছিলেন পাণ্ডববিজয় নাটক।
আরও পড়ুন, ময়নাগড়ের ময়নামতী
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এ বাড়ির গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এখানেই রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম মিটিং ডেকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে আয়োজন করেছিলেন রাখীবন্ধন উৎসব।
ছবি- লেখক
আপার সার্কুলার রোডের ফেডারেশন হল থেকে মিছিল করে এসে বসুবাটি প্রাঙ্গনে হিন্দু-মুসলমান সকলের হাতে রাখী বেঁধেছিলেন বিশ্বকবি, কণ্ঠে ছিল ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’! এদিনই বসুবাটিতে মিটিং-এ দেশীয় শিল্পোদ্যোগের জন্য অর্থসংগ্রহের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেশবাসী পঞ্চাশ হাজার টাকার ফান্ড তৈরি করে ফেলেছিলেন। এখান থেকেই সূচনা স্বদেশি আন্দোলনের। পরের বছর এ বাড়িতে খাদি ও দেশজ সামগ্রী প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রথম স্বদেশি মেলার উদ্বোধন করেছিলেন কস্তুরবা গান্ধী। এখানেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস গঠন করেছিলেন ‘স্বরাজ্য পার্টি’। ১৯৩১ সালে এই বাড়ির প্রাঙ্গনে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্লোগানে। এই বাড়ি আশ্রয় দিয়েছে শতশত সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামী বিপ্লবীকে। প্রেস কর্মীদের ধর্মঘটেও অর্থসাহায্য করেন বসুপরিবার।
আরও পড়ুন, এ এক অন্য লাল বাড়ির গল্প
এমনই সমৃদ্ধ যার ইতিহাস, এতই অপূর্ব যার স্থাপত্য, আজ তা লোকচক্ষুর আড়ালে একটু একটু করে ধংসের দিন গুনছে। গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ তকমা পাওয়া বাড়িতে যখন একটি পেরেক পোঁতার অনুমতিও মেলে না, সেখানে ভবিষ্যতে যে কী পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হতে চলেছে, তা কে জানে! সূত্রের খবর, আধুনিক পদ্ধতি ও মালমশলায় এ বাড়ির মেরামতি সম্ভব নয়, রাজস্তানের খুব অল্পসংখ্যক শিল্পীর কাছে আছে সেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা, যে উপকরণে এ বাড়ি তৈরি হয়েছিল তার হদিশ। এখন কেবল বসুবাড়ির কপালে জোটে কিছু সিনেমার শ্যুটিং, বিজ্ঞাপনী স্টিল ও ভিডিও ফটো শ্যুট! সম্প্রতি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সুপারহিট ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত, ফোর্স থেকে বহিষ্কৃত পুলিশ অফিসারের চরিত্র প্রবীর রায়চৌধুরীর ভগ্নপ্রায় যে বসতবাড়িটিকে দেখে যে দর্শক চমৎকৃত হয়েছিলেন, সে যে এই হতমান, গতরূপ বসুবাটি, সে তথ্যটুকুই বা কজন রাখে? আশঙ্কা হয়, সিনেমাটির সেই চরিত্রের মত একদিন ঐতিহ্যময় বসুবাড়িও অবহেলা আর অনাদরে আত্মহননের পথই না বেছে নেয়!