Advertisment

চালচিত্রের চলচ্চিত্র; হারিয়ে যাচ্ছে সাবেকিয়ানা

বর্তমানের ডিজিটাল পদ্ধতি মুছে দিয়েছে পটশিল্পীদের অস্তিত্ব। এখন একবার আঁকা ছবিকে ডিজিটাল মাধ্যমে সংগ্রহ করে তুলে রাখা হয়। বছর বছর সেটাকেই প্রিণ্ট করে ছবি বিক্রি করা হয়ে থাকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

চিরকালই নেপথ্যে থাকা চালচিত্র হারিয়ে যেতে চলেছে অবলুপ্তির আঁধারে?

বর্তমানে থিম পুজোর প্রতিযোগীতায়, ফিকে হয়ে গেছে সাবেকি পুজো। সে একচালায় পটচিত্রের চালচিত্র হোক বা ডাকের সাজ, দেখা মেলা দুষ্কর। চালচিত্রের কাজ প্রতিমার নেপথ্যে থেকে মা দুগ্গার পূর্ণ রূপ দেওয়া। কিন্তু থিমের ঢেউয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে সাবেকি পুজোর ওপরে নির্ভর করে থাকা শিল্পীদের উপার্জন। এখন পুজো মানে থিম বনাম সাবেকির তরজা। আর তারই হাত ধরে দিনে দিনে ভোল বদল ঘটেছে চালচিত্রের। থিমের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় কালের গর্ভে চলে যাচ্ছে সাবেকিয়ানা।

Advertisment

publive-image

পটচিত্রের চালচিত্র। ছবি: শশী ঘোষ

আরও পড়ুন: শেষমূহুর্তে পুজোর শাড়ির ট্রেন্ডি ডেস্টিনেশন ‘উইভার্স হাট’

ডান হাতে লিবার্টি সিনেমা হল, বাঁ হাতে গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশন, এরই মাঝে আদিত্য মল্লিক লেনে শহর কলকাতার চালচিত্রের পীঠস্থান। সেখানেই বাঁশের কঞ্চি কেটে তাকে অর্ধবৃত্তাকার আকার দিয়ে তৈরি করা হয় সেই পরিচিত ধাঁচের চালচিত্রের কাঠামো। তারপর সেই চালচিত্রের ওপর বায়না দেওয়া পাড়ার নাম লিখে তা পৌঁছে যায় কুমোরটলিতে। লিখতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, কাজটি কিন্তু অতটাও সহজ নয়।

publive-image

 চালচিত্রের আঁতুড়ঘর। ছবি: অরুণিমা কর্মকার

আসাম থেকে সহস্র গোছা বাঁশ এসে পৌঁছয় চালচিত্রের কাঠামো তৈরি করা শিল্পীদের কাছে। তাঁরা জানান, এক একটি গোছার মধ্যে থাকে ৩০টি বাঁশ। যা কেটে তৈরি করা যায় একটি সেটের চালচিত্র। সমস্তটাই নির্ভর করে প্রতিমার আকারের ওপর। কুমোরটুলি থেকে অর্ডার এলে তাতে কলকা না বসিয়েই পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুমোরটুলির শিল্পীদের কাছে। এক একজন শিল্পী বছরে ৩০ থেকে ৪০টা চালচিত্রর অর্ডার পান। চালচিত্রের এই কাঠামোর দাম এখন কলকাতার বাজারে হাজার পাঁচেক টাকা। কলকা লাগিয়ে একটা চালচিত্রের দাম হয় দশ হাজার।

শিল্পী রাধাকান্ত বড়াল দুঃখ করে বলেন, থিম পুজোর ইঁদুর দৌড়ে হারিয়েছে তাঁদের আধিপত্য। ব্যবসায় এসেছে ভাঁটার টান। আগে কোনো কোনো বছর শ-খানেকের ওপর চালচিত্র বানিয়েছেন তাঁরা।

publive-image

পুজোর দুমাস আগে থেকেই শুরু হয় এর কাজ। কিন্তু সারা বছর তারা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় অন্য কাজের তাগিদে।

আরও পড়ুন: বাঁকুড়ায় হাড়মাসড়ার রায়বাড়িতে পালকিতে কলাবউ, ভোগে পোড়া মাছ

রাধাকান্তবাবুর আরও আক্ষেপ, কুমোরটুলির শিল্পীরা তাঁদের কাছ থেকে কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করেন চালচিত্র। কাজেই সেই পরিমাণে লাভের মুখ দেখছেন না তাঁরা। এদিকে যখন পাড়ার মন্ডপের সঙ্গে দেবী প্রতিমার সুখ্যাতি করা হয় তখনও ঢাকা পড়ে যায় এই সব শিল্পীদের নাম।

একটা একটা বাঁশের বান্ডিলের দাম প্রায় ১৫০ টাকা। মৃদু হেসে শিল্পী বলেন, এককালে তাঁরা এই বান্ডিল বাঁশ কিনতেন আট ন'টাকায়। এছাড়া চালচিত্রের কাঠামো তৈরি করতে প্রয়োজন হয় কাগজের। দিস্তা দিস্তা কাগজের জোগান হয় প্রেস থেকে। ছাপা নয়, ফেলনা কাগজই নিয়ে আসেন শিল্পীরা, সবটাই ৫০ টাকা কিলো দরে কিনে। আঠাটা বানিয়ে নেন নিজেরাই। প্রসঙ্গত, মুলি বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় চালচিত্র। বাকি যা সরঞ্জাম থাকে তা ভেলকো বাঁশের তৈরি। সমস্তটাই আমদানি হয় আসাম থেকে।

publive-image

 দিস্তা দিস্তা কাগজ আসে প্রেস থেকে। ছবি: অরুণিমা কর্মকার

তবে চালচিত্র বানানো বছরের এককালীন ব্যবসা । পুজোর মাত্র দুমাস আগে থেকে শুরু হয় এর কাজ। বাকি সারাটা বছর তাঁরা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান অন্য কাজের তাগিদে।

publive-image

বাড়ির সব কাজ সেরে, চালচিত্র বানানোর কাজে হাত লাগান মেয়েরা। দুর্গা ঠাকুর সহ তাঁর চার ছেলে মেয়ের চালচিত্র বানাতে দৈনিক আয় হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।

আরও পড়ুন:প্রথমবার ফুটপাথের খুদেদের দুর্গাপুজো দেখবে এ শহর

এছাড়াও আরেক ধরণের সাবেকি চালচিত্র আছে যাতে এককালে আঁকা হত পটচিত্র। কয়েক বছর আগেও কুমোরটুলিতে চালচিত্রে আঁকার জন্য পটশিল্পীদের দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানের ডিজিটাল পদ্ধতি মুছে দিয়েছে পটশিল্পীদের অস্তিত্ব। এখন একবার আঁকা ছবিকে ডিজিটাল মাধ্যমে সংগ্রহ করে তুলে রাখা হয়। বর্তমানে বছর বছর সেটাকেই প্রিণ্ট করে ছবি বিক্রি করা হয়ে থাকে। কুমোরটুলির অলিগলি ঘুরে জানা গেল, গোপেশ্বর পাল  নামের এক শিল্পী পটচিত্র আঁকতেন। অবশ্য তাঁর খোঁজ মেলেনি। কেউ বলছেন তিনি থাকেন কৃষ্ণনগরে, কেউ বলছেন বিধাননগরে। তার আঁকা ছবিকেই ফটোকপি করে একের পর এক চালচিত্রে বসানো হচ্ছে প্রতি বছর।

মূর্তিশিল্পী অশোক পাল বলেন, তাঁরা স্বল্পসংখ্যক ঠাকুর বানান, তাই নিজেরাই চালচিত্রে এঁকে নেন। অতটা নিঁখুত না হলেও কাজ চালিয়ে নেন। একটা চালচিত্রে পটচিত্র আঁকতে বহুক্ষন সময় লাগে। কিন্তু ছবি সাঁটা মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। শিল্পীরা অকপটে জানিয়েছেন, মূলত সময়ের অভাবেই তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন পটচিত্র। কাজেই এই পটচিত্রের উপস্থিতিও বর্তমানে ম্রিয়মাণ। ডিজিটাল প্রিন্টে পটচিত্র বর্তমানে বিক্রি হয় মিটার পিছু দেড়শো দুশো টাকায়। সুতরাং কুমোরটুলিতে পটশিল্পী খুঁজে পাওয়া দায়।

আচারবিচারে চালচিত্রের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও থিমের দৌড়ে পথ হারিয়েছে চালচিত্র। প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে চালচিত্রের ভবিষ্যৎ। তাহলে কি চিরকালই নেপথ্যে থাকা চালচিত্র হারিয়ে যেতে চলেছে অবলুপ্তির আঁধারে? সে উত্তর জানে আগামী দিন। বর্তমানে চালচিত্রের উপস্থিতি পার্শ্বচরিত্র হিসেবে হলেও, তার ঔজ্জ্বল্য ও গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে হারায়নি। যেভাবে হারায়নি চালচিত্র শিল্পীর উৎসাহ ও দিনরাত এক করা পরিশ্রম।

Durga Puja 2019
Advertisment