শরত শরত মেঘ আছে, আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক আছে, রেল লাইনের ধারে কাশ আছে, পুজোর আর বাকিটা কী থাকল? ফুটপাথ জোড়া বাঁশের স্তূপ, গড়িয়াহাটে অটোর অপেক্ষায় যাত্রীদের লম্বা লাইন, অফিস ফেরতা যানজটে কয়েক আলোকবর্ষ পার করে দেওয়া, সব সহ্য করা যায় ওই পাঁচটা দিনের জন্য। নিংড়ে নিয়ে উজার করা যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমস্ত আবেগ।
সেই দুর্গা পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ল বলে। তিলোত্তমা সেজে উঠছে। সাবেকি পুজোর পাশাপাশি শহর কলকাতায় থিম পুজোর রমরমা হয়েছে কয়েক দশক আগেই। আজ আমাদের গল্প সেরকম এক 'থিম পুজো' নিয়ে। চেতলা অগ্রণী ক্লাবের পুজো। খুব চেনা নাম। 'চেতলা অগ্রণী' বললে চিনতে যত সময় লাগে তার চেয়ে অনেক সহজে চেনা যায় 'ফিরহাদ হাকিমের পুজো' বলে।'চেতলা অগ্রণী' র থিম এবার 'বিসর্জন'। বোধনের আগেই বিসর্জন?
আরও পড়ুন: প্রবাসিনীর চিঠি: টরন্টোর রাস্তায় ঢাক, কাঁসর, কাশফুল
"মনে জমা যত জঞ্জাল বিসর্জন দিয়ে মায়ের আরাধনা শুরু করা, এই ভাবনা থেকেই বেছে নেওয়া থিম 'বিসর্জন'," জানালেন শিল্পী অনির্বাণ দাস। ভাবনা তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত। রাজস্থানের শিশমহলের আদলে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। শিশমহলে রয়েছে হাজার হাজার আয়না। আয়নায় নিজের প্রতিফলন দেখা যায়, চিনে নেওয়া যায় নিজেকে। দিনের শেষে আত্মশুদ্ধির জন্য যা একান্ত প্রয়োজন। 'বিসর্জন'-এর থিম সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন বাংলার সঙ্গীত জগতের অতি পরিচিত দুই নাম, সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ। এবং সেখানেও চমক। না, চমক বলা ভুল হল বোধহয়। কোনো সস্তা, খেলো চমক নেই। বরং আছে গভীর এক ভাবনা।
চেতলা অগ্রণী ক্লাবের পুজোর থিম সঙ্গীত পরিবেশনায় সুফি শিল্পী সালিম হাসান চিস্তি। সঙ্গে রয়েছেন পরিচালক সৌমজিৎ-সৌরেন্দ্র।
সাংবাদিক বৈঠকের ছবি pic.twitter.com/LYVNONH77j
— IE Bangla (@ieBangla) September 24, 2018
বিসর্জনের থিম সঙ্গীতে সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিতের সঙ্গে গান গেয়েছেন ফতেপুর সিক্রির সুফি শিল্পী সেলিম হাসান চিস্তি। ২০ প্রজন্ম ধরে সেখানে চিস্তি হিসেবে রয়েছেন শিল্পী সেলিম হাসানের পূর্বসূরিরা। সুরের জগতে কবীর এবং রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়ে দিয়েছেন সৌম্যজিৎ-সৌরেন্দ্র। বাঙালির (বিশেষত হিন্দু বাঙালির) দুর্গা পুজো উপলক্ষে গান গাইছেন ফতেপুর সিক্রির সুফি শিল্পী। কবীরের 'দুনিয়া দর্শন কা মেলা'-র সঙ্গে মিলে যাচ্ছে 'জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ'।
শিল্পী সৌম্যজিৎ দাসের কথায়, "আমাদের দৈনন্দিন যাপনে ধর্ম কোথাও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। শিল্পী সেলিম হাসানের নিজেরও কখনও আলাদা করে মনে হয়নি তা। শৈশবে ফতেপুর সিক্রিতে সঙ্গীতের আরাধনা যেমন করেছেন, বৃন্দাবনও ছিল তাঁর প্রিয় জায়গা।" কৃষ্ণ এবং করিমকে আলাদা ভাবেননি কোনোদিন। শিল্পের কোনো ধর্ম হয় না, ধর্ম হয় না শিল্পীর। এ কথা তো নতুন নয়? তাহলে কেন খবর হয় এমন ঘটনা? হতে হয়।
স্কুল জীবনে সারা বছর সারিকার সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রার্থনায় 'তু হি রাম হ্যায়, তু রহিম হ্যায়' গাইলেও, কিংবা আয়েশার গা ঘেঁষে বসলেও ঠিক যে কারণে ঈদটা হতো 'ওদের' আর দুর্গা পুজোটা আমার। ঠিক যে কারণে আমদের দেশে 'হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ' হয় না। আর যে যে কারণে আমাদের মনের ভেতরে থাকা সুপ্ত 'গুজরাট (২০০২)' গুলো খুঁচিয়ে দেওয়া যায় খুব সহজে। আর তাই শিউলি ঝরা ভোরগুলোতে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হয় এমন শারদ উৎসবের, যা 'ধর্মীয়' নয়, বরং সামাজিক অনুষ্ঠান। যে সমাজে 'ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু'।