সারা পাড়ায় মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে গাঁক গাঁক করে। হতেই পারে, সরস্বতী পুজোর সাংস্কৃতিক সকাল বলে কথা। একটু পরেই বাচ্চারা সব বাসন্তী রঙের পোশাকে বেরোবে, দুপুরে খিচুড়ি আর লাবড়া খাবে কব্জি ডুবিয়ে। কিন্তু পাড়ার একাধিক বাড়ি থেকেই ছেলেমেয়েরা বেরোচ্ছে না, আসছে নালিশ। "মাইকটা কমিয়ে দাও, পড়াশোনার অসুবিধে হচ্ছে।" কী হলো ব্যাপারটা? সরস্বতী পুজোর দিন পড়াশোনা? ছোটবেলা থেকে জানি এই সেই স্বপ্নের দিন, যেদিন লেখাপড়া করা রীতিমত বারণ। করলে বীনাপাণি রুষ্ট হন।
কিন্তু উপায় নেই। আগামি মাসের মাঝামাঝি থেকে আইসিএসই (ICSE) এবং সিবিএসই (CBSE) বোর্ড পরীক্ষা। অতএব সরস্বতী পুজোর দিন হোক আর যাই হোক, দেবীর আরাধনা ওই বইখাতা খুলেই করতে হবে। অনাচার হলেই বা। নিমপাতা খাওয়া মুখ নিয়ে ব্যাজার মুখে বাড়িতে বাড়িতে পড়তে বসে পড়েছে মায়ের ভক্তরা।
আজ অনেক বাড়িতে জোড়া ইলিশ খাওয়ারও দিন বটে। তবে একজোড়া মোটামুটি ভদ্রস্থ ইলিশের যা দাম, তাতে নিয়মরক্ষা করা দায়। বাজার ঘুরে যা বোঝা যাচ্ছে, ১,৫০০ টাকার কমে এক কিলো ইলিশ আশা করাও পাপ।
অন্যান্য ব্যাপারে অবশ্য নিয়ম কানুন পালনের বাধা নেই। মাঘ মাসের পঞ্চম দিনে পুজো হচ্ছে প্রথা মেনেই। তবে তা শুধু বাংলায়। দেশের অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে আজকের দিনে পালিত হচ্ছে বসন্ত পঞ্চমী। উত্তর ভারতে বসন্তকালে মূলত দুটি উৎসবের রমরমা বাজার। এক, বসন্ত পঞ্চমী। দুই, হোলি, পঞ্চমীর ৪০ দিন পর। বসন্ত পঞ্চমীর দিন হলুদ পরা নিয়ম, আমাদের সরস্বতী পুজোর মতোই। এমনকি জাফরান দিয়ে হলুদ করে দেওয়া হয় পোলাও, দুধ, বা মিষ্টিও। বিভিন্ন মন্দির সেজে ওঠে হলুদ ফুলে।
উত্তর ভারতে, প্রধানত পাঞ্জাবে, পূজিতা হন মা গঙ্গা, সরস্বতী নন। এই নামে দুই নদীর সঙ্গে মিল লক্ষ্য করুন। অনেকে গঙ্গা, যমুনা, এবং বিলুপ্ত সরস্বতী নদীর ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করেন আজকের দিনে। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা আবার এক তান্ত্রিক দেবীর পুজো করেন বসন্ত পঞ্চমীতে। এবং উত্তর ও পশ্চিম ভারতে কোথাও কোথাও পুজো হয় জগদ্ধাত্রী ও শিবের।
অবাকভাবে, দ্বাদশ শতাব্দী থেকে বসন্ত পঞ্চমী পালন করে আসছেন সুফিরাও। বলা হয় যে কিংবদন্তী কবি আমির খুসরো এই দিনে হলুদ পরতেন, বিষণ্ণ চিস্তি সন্ত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মন ভালো করতে।
সরস্বতীকে পুরাকালে ব্রহ্মার কন্যা মনে করা হলেও ব্রহ্ম পুরাণ ও মৎস্য পুরাণ তাঁকে বলে ব্রহ্মার স্ত্রী গায়ত্রী, যাঁর নামে উচ্চারিত হয় পরম পবিত্র গায়ত্রী মন্ত্র। ইতিহাস সাক্ষী, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ফের শুরু করে বিস্মৃতপ্রায় এই দেবীর আরাধনা। এরই জেরে ১৯৩০-এর দশকে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য সেসময় সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে চালু করেন সরস্বতী পুজো। তবে আজও বাংলা, আসামের কিছু জায়গা, এবং উত্তরাখন্ডের বাইরে মাঘী পঞ্চমীর দিন সরস্বতী পুজো হয় না কোথাও। দক্ষিণ ভারতে তাঁর পূজা হয় আশ্বিন মাসে, নবরাত্রির শেষ দিনে।
ভারতের বাইরেও কিন্তু পূজিতা হন বীনাপাণি। বিশেষ করে বালি দ্বীপে, যেখানকার হিন্দুরা আজকের দিনে তাঁর নাম করে পবিত্র স্নান করেন। অজস্র সরস্বতীর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে সেখানকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেখানেও তিনি বিদ্যা এবং সঙ্গীতেরই দেবী।