থিম পুজোর ভিড়ে বাংলার সাবেকি পুজোর মেজাজ ধরে রেখেছে যে ক'টি বনেদি বাড়ি, তার মধ্যে সুরুলের রাজবাড়ি অন্যতম। লালমাটির দেশ বীরভুমের সুরুল রাজবাড়ি। ষষ্ঠীতে হয় সরকার বাড়ির বোধন। সপ্তমীতে নবপত্রিকাকে স্নান করিয়ে এসে স্থাপন করা হয়েছে রাজবাড়িতে। সে এক বেশ জমজমাট শোভাযাত্রা। প্রতিবছর তাতে শামিল হন পরিবারের সব সদস্য এবং গ্রামবাসীরা। সে এক এলাহি ব্যাপার। এ বছরেও তার অন্যথা হয়নি। এ বছর ২৮৫ বছরে পড়ল সুরুলের সরকার বাড়ির পুজো।
শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে চারপাশ আলো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুরুল রাজবাড়ি। পুজোর মাস খানেক আগে থেকেই মেজাজটা চলে আসে রাঙা মাটির দেশে। শেষ কদিন পুজোর প্রস্তুতি চলে তুঙ্গে। নাটমন্দিরে চলে প্রতিমা সাজানোর কাজ। বছরের এই ক’টা দিন ঝলমল করবে রাজবাড়ি। আশেপাশে যে যার কাজে ব্যস্ত।
আরও পড়ুন, খিদিরপুরের মুন্সীগঞ্জ, এক চাঁদাতেই পুজো-মহরম
যে কোনো রাজবাড়ির মূল কাঠামো যে রকম হয়, সরকারবাড়ি তার থেকে খুব কিছু আলাদা নয়। মাঝখানে নাটমন্দিরকে রেখে চতুষ্কোণ রাজবাড়ি। কিন্তু শহুরে রাজবাড়ির তুলনায় মাটির গন্ধ যেন কিছু বেশি। বোলপুরের সরকারবাড়ির ইতিহাসটা একটু বলে নেওয়া যাক। সরকার কিন্তু এদের আসল পদবি নয়, ইংরেজদের থেকে পাওয়া। আসল পদবি ঘোষ। আর বোলপুর এদের আদি নিবাসও নয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ভরতচন্দ্র সরকার বর্ধমানের বাঁকা নদীর ধারে নীলপুর থেকে সুরুলে আসেন গুরুর বাড়িতে থাকতে। গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে দীর্ঘসময় সস্ত্রীক থাকেন ভরতচন্দ্র। সেখানে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হয় – কৃষ্ণহরি। এ ভাবে ধীরে ধীরে সুরুলেই পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন সরকার পরিবার।
কৃষ্ণহরির ছেলে শ্রীনিবাস ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা করে রীতিমতো নাম করেছিলেন সে যুগে, প্রভাব প্রতিপত্তিও হয়েছিল। মূলত ছিল জাহাজের পাল তৈরির কাপড় আর নীল চাষের ব্যবসা। ভরতচন্দ্রের আমল থেকেই শুরু হয়েছিল সরকারবাড়ির দুর্গাপুজো। পরে তার ছেলেদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি হলে ছোটো তরফের বাড়িতেও আলাদা করে শুরু হয় অকালবোধন।
আরও পড়ুন, দেড়শ বছর ধরে এই পুজোয় অসুরের পরনে থাকে কোট-প্যান্ট
সরকার বাড়ির নবম প্রজন্ম শরদিন্দুবাবু পুজোর যাবতীয় নিয়মকানুন আচার সব গুছিয়ে বললেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে। রথের দিন থেকে শুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ। একচালার ডাকের সাজের প্রতিমা। মৃৎশিল্পীরা পাঁচ পুরুষ ধরে প্রতিমা বানিয়ে আসছেন সুরুলের সরকারবাড়ির। পুজোর ক’টা দিন মা দুগ্গাকে সাজানো হয় রাজবাড়ির সোনার অলংকারে। অস্ত্রশস্ত্র যা থাকে দেবীর হাতে, সবই প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো। পঞ্চমী থেকেই নাটমন্দির আর ঠাকুরদালান সেজে ওঠে বেলজিয়াম থেকে আনা রঙিন বাতি আর ঝাড়লন্ঠনে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে সুরুলের রাজপরিবারের সম্পর্ক বরাবর ভালোই ছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের জমির বেশ অনেকটা পেয়েছিলেন এই রাজ পরিবারের কাছ থেকেই। রবীন্দ্রনাথ আর রথীন্দ্রনাথের নিয়মিত যাতায়াত ছিল সরকারবাড়িতে। মহাত্মাকে নিয়ে কবিগুরু রাজবাড়ির ঘরটিতে রাত কাটিয়েছিলেন, সুরুলের রাজবাড়িতে তার স্মৃতি এখনও অটুট।
পুজোর দিনগুলোতে টুনি বালব্ নয়, রাজবাড়ি সাজে রেড়ির তেলের প্রদীপে। অন্নভোগের রেওয়াজ নেই বড়োবাড়ির পুজোয়। পুজো হয় বৈষ্ণব এবং শাক্ত দু'মতেই। পুজোর নির্ঘণ্ট তৈরি হয়ে যায় এক মাস আগে থেকে।সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী তিন দিনই বলির প্রচলন রয়েছে। সপ্তমীতে চালকুমড়ো, অষ্টমীতে পাঁঠা আর নবমীতে চালকুমড়ো-আখ। নারায়ণ যেহেতু বলি প্রথার বিরুদ্ধে, বলির সময়টুকু নারায়ণকে রেখে আসা হয় মন্দিরে। বাকি সময়টা তাঁর উপস্থিতিতেই হয় দেবীর আরাধনা। ওই তিন দিন রোজ সন্ধেতে নাটমন্দিরে বসে যাত্রার আসর। এই সে দিন পর্যন্ত বাড়ির মেয়েরা যাত্রা দেখতেন চিকের আড়াল থেকে। এখন সময় পালটেছে। বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে কোমর বেঁধে পুজোর কাজ কম্ম, আল্পনা দেওয়া, পুজোর জোগাড় যন্তর সব করেন মেয়েরা। এমন কী, পুজোর ক'দিন সরকার বাড়ির কচিকাঁচারা নাটক-নাচ-গানে ভরিয়ে রাখে রাজবাড়ি।
এখন জমজমাট রাজবাড়ি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তো বটেই, বিদেশ বিভূঁই থেকেও এসেছেন রাজপরিবারের সদস্যরা। বছরভর বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকে চারটে দিনের জন্য ঘরে ফেরা। এই ফেরার টান কিন্তু শাশ্বত। শেকড়ে ফেরার টান কিন্তু আভিজাত্য বোঝে না, বনেদিয়ানা বোঝে না। সে শুধুই ফিরতে চায় ঘরে। হাঁটু মুড়ে একটু বসতে চায় শৈশবের কাছে।