১৯১৭ সালে পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের হাত ধরে শিলিগুড়িতে প্রথম শুরু হয়েছিল দুর্গা পুজো। টয় ট্রেনে চেপে মা আসতেন পুজো মণ্ডপে। আবার ভাসানও হত টয়ট্রেনেই। খোদ রেলকর্তারা ছিলেন পুজোর উদ্যোক্তা। এরপর মহানন্দা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ঐতিহ্য হারিয়ে ১০১ বছরে এসে বন্ধের মুখে শিলিগুড়ি শহরের প্রথম দুর্গাপুজো। ইতিহাসের সাক্ষী শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন দুর্গাপূজা কমিটির পুজো এখন নিজেই ইতিহাস হওয়ার পথে। অর্থের অভাবে পুরোনো স্মৃতি হাতড়েই বর্তমানে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে পারে সে।
ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার পাহাড় ঘেঁষা ছোট শহর শিলিগুড়ি। তখন শিলিগুড়ির হাসমি চকেই ছিল ডিএইচআরের (Darjeeling Himalayan Railway) স্টেশন। ওই স্টেশন থেকেই পাহাড়ি পথে ছুটত খেলনা গাড়ি, যার পোশাকি নাম টয় ট্রেন। স্টেশনের কাছেই ছিল বেশ কিছুটা জায়গা। হঠাৎই এক বাঙালি রেলকর্মীর ভাবনায় আসে দুর্গাপুজোর কথা। সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে সেইসময়কার বাঙালি রেলকর্মীদের নিয়ে একটি মঞ্চ তৈরি করে পুজোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: আমার পুজো: মেহতাব হোসেন
ইংরেজ সরকারকেও বিষয়টি জানানো হয়। তাঁদের নিবেদন শোনার পরেই স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় পুজোর অনুমতি দেয় ব্রিটিশ সরকার। প্রথম ১৯১৭ সালে শিলিগুড়িতে শুরু হয় বারোয়ারি পুজো। সেই থেকে রেলের এবং ইংরেজ সরকারের মদতেই চলত পুজো। পুজো উপলক্ষে বসত মেলা। দূরদূরান্ত থেকে গরুর গাড়িতে করে মানুষ আসতেন শিলিগুড়িতে। পুজোর চারদিন শিলিগুড়িতেই কাটাতেন তাঁরা। মহিষের গাড়িতে আসত প্যান্ডেল তৈরির সামগ্রী।
ক্রমে শিলিগুড়ির ভৌগোলিক চিত্র বদলাতে থাকে। একসময় বন্ধ হয়ে যায় হাসমি চকে থাকা ডিএইচআরের স্টেশন। টাউন স্টেশন থেকেই চলত টয় ট্রেন। সেই সময় পুজোও স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ে ইন্সটিটিউট কলোনিতে। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধের সময় এক বছরের জন্যে বন্ধ ছিল পুজো। সেই থেকে বন্ধ হয়ে যায় টয় ট্রেনে দেবীর ভাসান প্রথাও। যদিও পুজো চালিয়ে যেতেন উদ্যোক্তারা। পুজোর চারদিন রেলের পক্ষ থেকেই করা হত দরিদ্র নারায়ণ সেবা। কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শহরের পরিধি, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শহরের পুজো। শহরের কোলাহলে হারিয়ে যেতে থাকে টাউন স্টেশন দুর্গাপূজা কমিটির পুজো।
আরও পড়ুন: প্রথা মেনে আজও নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ে রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোয়
সব মিলিয়ে শিলিগুড়িতে এখন ১১১টি লাইসেন্স প্রাপ্ত পুজো রয়েছে। যার মধ্যে ৭৭টি বিগ বাজেটের পুজো। আর এসবের মাঝে কোনমতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে টাউন স্টেশনের দুর্গাপুজো। ১০০ বছর পুজো করেই মেয়াদ শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু পুজো এগিয়ে আসতে মন মানে নি স্থানীয়দের। তাঁরাই কমিটিকে পুজো করার আহ্বান জানান। এরই মাঝে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের প্রতিটি লাইসেন্স প্রাপ্ত ক্লাবকে ১০ হাজার টাকা অনুদানের কথা ঘোষণা করেন। সেই টাকা হাতে পেয়েই ফের পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোক্তারা। সেইমতো শুরু হয় প্যান্ডেল।
শহরের প্রথম দুর্গাপুজো এভাবে বন্ধ হয়ে যেতে বসলেও আক্ষেপ নেই শহর বাসীর। শহরের আলো ঝলমলে পুজো মণ্ডপের কাছে এই পুজো আজ মলিন। উদ্যোক্তাদের কথায় শহরের বিগ বাজেটের পুজো গুলিকে হাজার হাজার টাকা চাঁদা দেওয়া হলেও সবচেয়ে পুরোনো পুজোকে বাঁচাতে হাত বাড়ায় না কেউই। পুজো কমিটির সম্পাদক চিন্ময় ঘোষ বলেন, "১০১ বছরের পুরোনো পুজো আমাদের। একসময় সাড়ম্বরে পুজো হত। রেলের পদস্থ কর্তারা পুজোর উদবোধন করতেন। এখন সেসব অতীত। অর্থাভাব, তাই বন্ধের মুখে ঐতিহ্যবাহী আমাদের এই পুজো। কেউ সাহায্য করে না। এবার তো পুজোই হত না। রাজ্য সরকার ১০ হাজার টাকা অনুদান দেবে শুনে আমরা পুজো করার সিদ্ধান্ত নিই।"