Advertisment

ধূপধুনোর গন্ধ ঘিঞ্জি গলিপথে, শারদোৎসবের প্রস্তুতি তুঙ্গে সোনাগাছিতে

পুজোর চাঁদা তোলা থেকে রান্না বা পুজোর জোগাড়, সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মহিলারাই। এমন কী পুরোহিত থেকে প্রতিমা শিল্পী, প্রত্যেকেই এবার মহিলা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ঘিঞ্জি গলিপথ, চেয়ার পেতে সার দিয়ে বসে রয়েছেন মেয়ে বৌ-রা। কিছুটা সময় ঠোঁটে অহেতুক গাঢ় রঙ মেখে রাস্তার ধারে দাঁড়ানো থেকে বিরতি মিলেছে এদিন। আসলে দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, যদিও শিউলি গন্ধ বা পেঁজা তুলোয় ভরা নীল আকাশের আলো, কোনওটাই খুব বেশি পৌঁছয় না এই স্যাঁতস্যাঁতে ঘিঞ্জি গলিতে। তবে ছবিটা রাতারাতি বদলে গিয়েছিল এই বিকেলে। কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ আর ধূপধুনোর গন্ধে ভরেছে ডালপট্টি চত্ত্বর। সোনাগাছির দুর্বার মহিলা কমিটির খুঁটি পুজোর প্রস্তুতি তখন তুঙ্গে। একাধিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে গত বছরই দুর্গাপুজোর ছাড়পত্র পেয়েছেন 'সোনাগাছির মেয়েরা'। আদালত জানিয়েছে, দুর্গাপুজোয় সামিল হতে পারবেন যৌনকর্মীরাও। কাজেই এখন একেবারে সাজসাজ রব এলাকা জুড়ে।

Advertisment

publive-image চলছে খুঁটিপুজো।

এবছরের পুজোয় একাধিক অভিনবত্বের পসরা সাজিয়েছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সদস্যারা। পুজোর চাঁদা তোলা থেকে রান্না বা পুজোর জোগাড়, সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মহিলারাই। এমন কী পুরোহিত থেকে প্রতিমা শিল্পী, প্রত্যেকেই এবার মহিলা।

পাশাপাশি রয়েছে আরও চমক। এ বছর দুর্বারের পূজোর পোস্টারে দুর্গার সাজে রয়েছেন শেওড়াফুলির বাসিন্দা সিন্টু বাগুই, তিনি রূপান্তরকামী। আনন্দমের সভাপতি সিন্টুর চোখে মুখে ধরা পড়ল তৃপ্তির ছাপ। তাঁর কথায়, ''দীর্ঘ লড়াইয়ের পর কিছুটা সাফল্য পেয়েছি আমরা, এভাবে সবাইকে পাশে পেলে আগামি দিনে এগিয়ে যাওয়াটা আরও সহজ হবে। রূপান্তরকামীদের আনন্দম সমিতির সঙ্গে এ বছর প্রথম গাঁটছড়া বেঁধেছে দুর্বারের পুজো। অনেক দায়িত্ব সামলাতে হবে। কোণঠাসা একটা জীবন থেকে উঠে এসে এমন একটা কাজে সামিল হতে পেরে ভীষণ ভাল লাগছে।"

আরও পড়ুন: একদিন যে প্যান্ডেলে ঢুকতে পারতেন না, আজ সেখানে বিচারক

''কয়েকবছর আগেও পাড়ার মন্ডপে উঠতে দেওয়া হত না, হেনস্থাও হতে হয়েছে বহুবার। ভীষণ ভাল লাগছে এটা ভেবে যে পুজো মন্ডপে আমাদের ঢুকতেই দেওয়া হত না, সেখানেই বিচারক হয়ে যাব আমরা,'' খুঁটি পুজোর শেষে প্রসাদ বিতরণ করতে করতেই আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন কাজল বোস। এখানেই শেষ নয়, এ বছর নারীশক্তি সম্মান পাচ্ছেন তিনি। সম্মানের লড়াই যদিও শেষ হয়নি এখনও।

publive-image একাগ্র চিত্তে।

দুর্বারের মুখ্য উপদেষ্ঠা ডাঃ সমরজিৎ জানার কথায়, ২৯৮টি পুজো প্যান্ডেলের বিচারকের ভূমিকায় বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করবেন দুর্বারের মহিলারাও। এ বছর দুর্বারের তরফ থেকে সেরা পুজো মন্ডপকে দেওয়া হবে শারদ সম্মান। মৃগনয়নী উমা সম্মানের অন্যতম মূল উদ্যোক্তা রাজর্ষি দাস এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, "এবার তিন বছরে পড়ল আমাদের শারদ সম্মান। এবারের থিম সমাজের উমারা। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতী মহিলাদের নিয়েই আমরা বিচারকমণ্ডলী সাজিয়েছি। মোট ২৮ জন মহিলা বিচারক থাকছেন বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। যাঁদের মধ্যে রূপান্তরকামী এবং দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিও থাকছেন আমাদের সঙ্গে।"

publive-image খুঁটি পুজোয় উদ্যোক্তা ডাঃ সমরজিৎ জানা

তবে আজও বিস্তর ছুঁৎমার্গের কারণে অভিমানের পাহাড় জমে আছে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের মনে। বিগত কয়েকবছর ধরেই দুর্গাপুজোর রীতি রক্ষার্থে নিজেদের চৌকাঠের মাটি দেওয়া বন্ধ করেছেন যৌনকর্মীরা। দুর্বারের সদস্য কাজল বোসের কথায়, ''দুর্গা মন্ডপেই যাঁদের ওঠার অধিকার নেই, তাঁদের দুয়োরের মাটি নিয়ে কী হবে? সবাই তো বলে আমাদের চৌকাঠের এপারে নাকি পাপ কাজ করি আমরা, কিন্তু ওরা কি জানে না আমরা খদ্দেরকে লক্ষ্মী মনে করি? এসবেই আমাদের আপত্তি, তাই মাটি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।" যদিও ইদানিং দশকর্মা ভাণ্ডারের রেডিমেড প্যাকেটেই মেলে 'বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা'। এ প্রসঙ্গে কাজল জানান, "আমরা জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, কিন্তু উত্তর পাইনি।" সব মিলিয়ে আনন্দ উৎসব থেকে ওঁরা ব্রাত্যই যখন, 'বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা' দেওয়াও অর্থহীনই মনে করছেন  কাজল বা মিনা।

তবে একাধিক না পাওয়াতেও পাওনার ঝুলি কার্যত কিছুটা হলেও পূর্ণ হয়েছে বলেই মনে করছেন যৌনপল্লীর শিউলি, মালতীরা। সব মিলিয়ে দূুর্গাপুজোর ব্যস্ততা, সর্বোপরি বেশ্যাবৃত্তির তকমা সত্ত্বেও সমাজের মূলস্রোতে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা এখন তুঙ্গে। শুধু পোস্টারেই নয়, লিপস্টিক আর কাজলের আধিক্যে ঢেকে যাওয়া ম্লান মুখগুলোও এক নাগাড়ে নেপথ্যে বলে চলেছে, ''আমিও নারী তুমিও নারী, গাই জীবনের গান।''

Durga Puja 2019
Advertisment