/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/03/cats-275.jpg)
প্রতীকী ছবি
অতিমারি শিশুদের শৈশব যে বিপন্ন করেছে সেকথা বারে বারেই উল্লেখ করেছে হু। শিশুদের শিক্ষার পাশাপাশি তাদের স্বাভাবিক ছন্দে বেড়ে ওঠাতেও বিরাট ব্যাঘাত ঘটিয়েছে করোনা মহামারি। কোভিড পরবর্তীতে স্পিচ থেরাপি ক্লিনিকে ভিড় বাড়ছে আগের থেকে অনেকটাই বেশি। বিশিষ্ট সাইকোলজিস্ট মিনাক্ষী খুরানা সাহা যেমনটা জানিয়েছে, গত ১০ বছর ধরে তিনি শিশুদের কাউন্সেলিং করাচ্ছেন, তবে কোভিড পরবর্তীতে কথা বলার সমস্যা, অথবা স্বাভাবিক আচরণের সমস্যা শিশুদের মধ্যে বেড়েছে অনেকটাই। আগের তুলনায় প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ এই ধরণের সমস্যা শিশুদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে। এই নিয়ে বেজায় সংকটে পড়েছেন অভিভাবকরা।
দুর্গাপুরের অয়ন ও অনুশ্রীর একমাত্র সন্তান অদ্রিজা, বয়স তিন বছর পেরিয়েছে, কিন্তু স্বাভাবিক ছন্দে কথা বলে না সে। পাশাপাশি দমদমের সুতানু প্রিয়াঙ্কার ছেলে সবে ছয়ে পড়েছে স্কুলে গিয়ে আর আগের মত বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারেনা। বাড়ি ফিরেও বেশি কথা বলে না। সেই সঙ্গে বিগত কয়েকমাসে তার রাগ আগের থেকে কয়েকগুণে বেড়ে গিয়েছে। এমন হাজারো সমস্যা নিয়ে স্পিচ থেরাপি ক্লিনিকে রোগীদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।
সাধারণত একটি বাচ্চা দু’বছর বয়সে ২৫০–৩০০ শব্দ বলতে সক্ষম। এর যদি কিছু ব্যতিক্রম হয় তাহলে দেরি না করে থেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ, ৬ মাসের মধ্যেই শিশুটিকে স্বাভাবিক ছন্দে কথা বলানো সম্ভব বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এবিষয়ে কলকাতার এক বেসরকারি স্পিচ থেরাপি সংস্থার চিকিৎসক মিনাক্ষী খুরানা সাহা বলেন, আগেও শিশুদের মধ্যে এই জাতীয় নানান সমস্যা দেখা যেত, তবে কোভিড পরবর্তীদের শিশুদের মধ্যে এই জাতীয় সমস্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কারণ হিসাবে তিনি বলেন, 'কোভিডের সময় যে সকল মহিলা গর্ভবতী ছিলেন তারা এক চরম উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তারা সুরক্ষিত থাকবেন তো? সন্তান সংক্রমিত হবে না তো এই ধরণের নানান জাতীয় উৎকণ্ঠা তাদের মধ্যে দেখা গিয়েছে যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে শিশুমনে। সাধারণত একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনরা বাড়িতে আসেন তাকে দেখতে তার সঙ্গে স্বাভাবিক কথোপকথন হয়ে থাকে, কোভিডের জেরে সেই পরিস্থিতি প্রায় ছিল না। শিশুরা ভূমিষ্ঠ হয়েই ঘরে আবদ্ধ থেকে, আর মা-বাবারা চরম উৎকন্ঠার মধ্যে ছিলেন পাশাপাশি অনেকক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থার কাজের সুবাদে ওয়ার্ক ফ্রম হোম চালু থাকার কারণে অনেক বাবা-মা’ই তাদের সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি, এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শিশুমনে'।
'যার ফলে অনেক বাচ্চাই এখন সঠিক সময়ে কথা বলতে পারছে না, সেই সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার ছন্দও ব্যাহত হচ্ছে। তাদের মধ্যে আচার-আচরণগত বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই সমস্যা যে কেবল বাচ্চাদের মধ্যেই হচ্ছে তা নয়, আনেক বড়দের মধ্যেও এই ধরণের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। আমাদের কাছে যে সকল শিশুরা আসছে আমরা প্রথমেই তাদের মানসিক এবং শারীরিক সমস্যা উভয়ের মধ্যে এক পার্থক্য বার করে নেওয়ার চেষ্টা করি সেই অনুযায়ী শিশুদের উপযুক্ত কাউন্সিলিং প্রদান করি'।
তিনি আরও বলেন, কোভিড পর্ব আমরা গত আড়াই-তিন বছর যাবত প্রত্যক্ষ করছি। ফলে যে সকল শিশুর বর্তমান বয়স এখন আড়াই-থেকে তিন বছর তাদের মধ্যেই এই ধরণের সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। এর আরও একটা কারণ হল বাচ্চারা সাধারণ ভাবে বড় স্কুলে ভর্তির আগে প্রি-স্কুলে খেলার ছলে শিক্ষার একটা পাঠ নিয়ে থাকে। কোভিডের জেরে সেই সকল প্রি-স্কুল বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের মধ্যে খেলার ছলে শেখা, মেশার ক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। তারা একটা জায়গায় আবদ্ধ থাকাতে তাদের মধ্যে যে স্বাভাবিক বিকাশ সেটাই ব্যাহত হচ্ছে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/03/cats-276.jpg)
পাশাপাশি ডাঃ মিনাক্ষী খুরানা সাহা বলেন, সঠিক সময়ে যদি শিশুকে নিয়ে আসা হয় তাহলে স্পিচ থেরাপির এক একটি সেশন শেষ হতে সময় লাগে কমপক্ষে ৬ মাস। বাচ্চার কানে শোনার অসুবিধা থাকলে কথা বলতেও দেরি হয় তার। এই সমস্যাকে বলা হয় ‘হিয়ারিং ইমপ্যাক্ট’। এক্ষেত্রে আগে বাচ্চাদের শব্দ বোঝানো হয়। একে বলা হয় ‘অডিটরি ট্রেনিং’। তারপর আস্তে আস্তে শুরু হয় স্পিচ থেরাপি। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ গুরুত্বপূর্ণ।
স্পিচ থেরাপি কী
স্পিচ থেরাপি হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে কথা বলতে অক্ষম অথবা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না এমন রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। তোতলামি, শিশুদের দেরিতে কথা বলা, কানে কম শোনাজনিত কথা বলার সমস্যা ইত্যাদি নানা কারণে যারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না, তাদের স্বাভাবিক ছন্দে প্রাণখুলে কথা বলার সুযোগ এনে দিয়েছে স্পিচ থেরাপি।
এদিকে বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইন্দ্রনীল চৌধুরির কথায়, “কর্পোরেট কালচার অথবা অত্যাধিক গ্যাজেটের দাপটও শিশুদের এই সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ বজায় রাখা বাবা-মায়ের কর্তব্য। যে বাড়িতে অনেক ভাষায় কথা বলেন মানুষজন সেখানে বাচ্চাদের কথা বলতে বা শিখতে অনেকটাই দেরি হয়।
নিঃসঙ্গ শৈশব, অথবা গ্যাজেটে আসক্তি বাচ্চাদের মধ্যে এই সকল সমস্যার সৃষ্টি করে। বাচ্চাদের দেরিতে কথা বলার আরেকটি কারণ অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার। যদি বাচ্চা এক বছরের মধ্যে নিজের নাম শুনে না তাকায়, মিশতে না পারে মুখভঙ্গি অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে না পারে তাহলে সেই শিশুটি অটিস্টিক স্পেক্ট্রামের শিকার কিনা তা জানতে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।