এক ধাক্কায় পিছিয়ে যেতে হবে অনেকটা। সময়টা ১৯৩৯। ডিসেম্বরের ৫ তারিখ। সুভাষ চন্দ্রের জন্য খুবই ঘটনাবহুল বছর। নেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা বাড়ছে সুভাষের। এই বছরই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচনে জিতলেন নেতাজী। কাকে হারিয়ে? স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীকে। অবশ্য মহাত্মার সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় এবং গান্ধীজীর অনুগামীদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পেয়ে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন নি শেষমেশ।
ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধ বেধেছে জার্মানির। নেতাজী বুঝেছিলেন, লড়াইটা আসলে দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যেই। কিন্তু ভারতে স্বাধীনতা আনতে যেই সাহায্য করুক, সেদেশের সঙ্গেই হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে সুভাষ তখন জেলে। জেল থেকেই শুরু করলেন আমরণ অনশন। সাত দিনের মাথায় ৫ ডিসেম্বর জেল থেকে ছাড়া পেলেন সুভাষ। তাঁর মতো এত জনপ্রিয় নেতার জেলে মৃত্যু হলে জনতার রোষের মুখে পড়তে হবে ব্রিটিশ শাসকদের। এই আশঙ্কা থেকেই জেল থেকে মুক্ত করা হল সুভাষকে। কিছুটা সুস্থ হতেই আবার গ্রেফতার হলেন নেতাজী।
জেল থেকে বাড়ি ফিরেও রেহাই নেই। চারপাশে পুলিশি পাহারা। বাড়ির ভেতর কী হচ্ছে, সে খবর ব্রিটিশদের দেওয়ার জন্য বাড়ির আশেপাশেই রইল ডজনখানেক চর। কিন্তু এসবের মাঝে ব্রিটিশরা জানতেই পারেনি, জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেই সুভাষ পরিকল্পনা শুরু করে ফেলেছেন দেশ থেকে পালানোর। দাদা শরত বোসের ছেলে, অর্থাৎ ভাইপো শিশির বোসের সঙ্গে বসে তিনি ছক কষে ফেলেছেন ভারত ছাড়ার।
একদিকে প্রকাশ্যে যখন হা হুতাশ করছেন জেলে ফেরত যেতে হবে বলে, অন্যদিকে তাঁর ভাইপো তখন বাজার করতে বেরিয়ে পড়েছেন কাকার মহানিষ্ক্রমণ ঘটাতে। আটঘাট বেধে নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক বাড়ি ছাড়লেন সুভাষ। ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কেউ। এমন কী সুভাষের মাও জানতে পারেননি তাঁর পালানোর কথা। তাঁর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এলে সম্ভাব্য উত্তরও চিঠির আকারে লিখে রেখে গেছিলেন সুভাষ, যাতে কেউ বুঝতে না পারে তিনি বাড়িতে নেই আদৌ।
নেতাজির কণ্ঠস্বর, সৌজন্যে অল ইন্ডিয়া রেডিও
হ্যাঁ, ১৯৪০ এর ১৬ জানুয়ারি দিনটি ভারতের ইতিহাসে লেখা থাকল চিরকালের জন্যই। রাত ১ টা ৩৫ মিনিটে শিশির বোসের গাড়িতে উঠলেন নেতাজী। নাহ, এ তো অন্য লোক। জোব্বা মতো সালোয়ার, লম্বা গলা বন্ধ কোট পরে নিশ্চয়ই উত্তর ভারতীয় কোনো পাঠান। নাম তাঁর মহম্মদ জিয়াউদ্দিন। পরিচয় পত্রে এই নামের নীচে বড়বড় করে লেখা - বিএ, এলএলবি ট্র্যাভেলিং ইনস্পেকটর, দ্য এম্পায়ার অফ ইন্ডিয়া লাইফ অ্যাসুওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।
অপমানে লজ্জায় ব্রিটিশ সরকার তখন দিশাহারা। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে সংসার ত্যাগ করে সুভাষ চন্দ্র সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছেন। একে একে আসতে থাকল নানা গুজব। কেউ বলছেন সুভাষ রাশিয়ায় পালিয়েছেন, কেউ বলছেন ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন জাপান। নেতাজী ততক্ষণে সিঙ্গাপুরগামী এক জাহাজে। আরও একবার বড় ধাক্কা খেল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। সুভাষ কোথায় বোঝার আগেই দেশ ছেড়েছেন তিনি। তবে সংসার ত্যাগী হওয়ার জন্য যে নেতাজী দেশ ছাড়েননি, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল ব্রিটিশরা। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও ভারতকে স্বাধীন করার জন্য নেতাজী ছিলেন দৃঢ়কল্প। সেটি অজানা ছিল না ব্রিটিশদের কাছেও।
কিন্তু কয়েকটি টেলিগ্রাম ব্রিটিশদের হাতে পড়ে যাওয়ার ফলে তারা জানতে পারে, সুভাষ আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে আছেন, এবং সিদ্ধান্ত হলো, সুভাষ যখন তুরস্ক এবং মিশর হয়ে ইউরোপ পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন, তখন ব্রিটিশদের পাঠানো গুপ্ত ঘাতক হত্যা করবে তাঁকে। কিন্তু সে গুড়েও বালি। ততদিনে সুভাষ হয়ে গিয়েছেন অর্লান্ডো মাজোত্তা, সৌজন্যে এক ইটালিয়ান কূটনীতিকের আসল পাসপোর্ট, যার মধ্যে নিজের ছবি বসিয়ে নিয়েছিলেন নেতাজী। ২৩ মার্চ কয়েকজন ইউরোপিয়ানের সঙ্গে সড়কপথে হিন্দু কুশ পর্বত পেরিয়ে উজবেকিস্তানের শহর সমরকন্দে ঢুকে পড়লেন "মাজোত্তা", সেখান থেকে ট্রেনে পাড়ি দিলেন মস্কো।