কখনও কোন ট্রাফিক পুলিশ কর্মীকে জিজ্ঞেস করেছেন তিনি কেমন আছেন? কিংবা বাড়িতে দুপুরে কোনও সেলসম্যান এলে তাঁকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়েছেন কখনও? কোনদিন কি জানতে চেয়েছেন যাঁরা ২৪ ঘণ্টা আপনাদের পরিষেবা দিয়ে চলেছেন তাঁরা ভাল আছেন কিনা? আমি আপনি যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আছি তখনও কিন্তু একদল মানুষ চাঁদিফাটা রোদে ঘুরছেন সারাদিন, গ্রীষ্ম-বর্ষাতে তাঁরা নিজেদের কাজে অবিচল, আপনারই সেবায়। পথচলতি এরকমই কয়েকজনের কথা তুলে ধরা হল।
শিয়ালদহ ট্রাফিকের এক পুলিশ কর্মীর কথায়, "গরমে আমাদের সমস্যা হলে তো চলবে না। আমরা তো আছিই মানুষের দেখভালের জন্য। তবে টানা সাত-আট ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়, কষ্ট তো হবেই। শারীরিক বিভিন্ন সমস্যাও হয়। তখন ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিই। এ ছাড়াও দপ্তর থেকে আমাদের সমস্তরকম সুরক্ষা সংক্রান্ত সুবিধা দেওয়া হয়। যেমন সানগ্লাস, নেক কুলার, ওআরএস (ORS)-এর প্যাকেট, বিশেষ জুতো, ছাতা সহ প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই দেওয়া হয়। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে একটু সচেতন থাকার চেষ্টা করি এই সময়, সঙ্গে ঠান্ডা জল, লেবুর চিনির জল, ওআরএস রাখি। যতটা সম্ভব হালকা খাবার খাই। তবে দিনের পর দিন একই ভাবে কাজ করে অভ্যাস হয়ে গেছে।"
আরও পড়ুন, Summer Coolers: শহরের কোথায় গেলে জুড়োবে প্রাণ?
পেট্রোল পাম্পে কর্মরত রাকেশ পোদ্দারের কথায়, "ডিউটি আওয়ার্স বলতে প্রায় ১২ ঘণ্টা। সারাদিনই তো একটা গ্যাসের মধ্যে থাকতে হয়, এই গরমে সমস্যাটা আরও বাড়ে। খাওয়া বলতে এই সময়টা লিকুইড ফুডই বেশি খাই। ফল, চিঁড়ে-দই এসব রাখি সঙ্গে। আর এই পুরো সময়টার মধ্যে বড়জোর আধ ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা টিফিনের জন্য পাই। আগে তো পুরোটাই রোদের মধ্যে থাকতে হত, এখন তাও মাথার ওপর শেড বানিয়ে দেওয়ায় কিছুটা নিস্তার পাওয়া গেছে। আমাদের অফিসই আমাদের ইউনিফর্ম দেয়, সেক্ষেত্রে আলাদা করে সুতির জামা পরারও উপায় নেই, এই সিনথেটিক জামাতেই কাটাতে হয় পুরো সময়টা। তাই সারাদিনের ক্লান্তির পর বাড়ি ফিরেই আগে স্নান করি। তারপর খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম।"
পথচলতি রিক্সাচালক মঙ্গলরাম পান্তা ভাতই বেছে নিয়েছেন এই গরমে। তাঁর কথায়, "হাতে টানা রিক্সা টানতে কষ্ট তো হয়, আবার না টানলে পেট টানতে পারব না যে। শুধু এই সময় কষ্টটা একটু বেশি হয়, শরীরে জুত পাইনা, ক্লান্ত হয়ে যাই তাড়াতাড়ি। আসলে বয়সও তো হচ্ছে, সেই শক্তি আর কই? সামর্থ্য মত খাওয়াদাওয়া করার চেষ্টা করি, গরমে আলাদা করে কিছু করার সামর্থ নেই, সম্বল বলতে এই গামছা, পান্তা ভাত বা রুটি আর জল। তবে সবই অভ্যাস হয়ে গেছে, এখন শীত গ্রীষ্ম বর্ষা কোনও কিছুই গায়ে লাগে না।"
বেশ হেসেই উত্তর দিলেন সেলসম্যান অভ্র চক্রবর্তী, "আমাদের জন্য তো বাড়ির গেটেই নিশেধাজ্ঞা থাকে, 'সেলসম্যানের প্রবেশ নিষেধ'। গরমে আলাদা আর কি? খুব কম বাড়িই আছে যাঁরা বসতে বলেন, জল খাওয়ার কথা বলেন। প্রোটেকশন বলতে সানগ্লাস, ছাতা, জল এসব সঙ্গে রাখি, রাস্তার খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি যতটা সম্ভব।"
একজন সাংবাদিকের কথায়, "কলকাতার গরমের চরিত্রটা হল, ঘাম অত্যন্ত বেশি হয়। এখানে লু বয় না।রাস্তায় বেরোলে শুধু ঘামই নয়, রোদের দাপটও নাস্তানাবুদ করে দেয়। সেক্ষেত্রে বাড়ি থেকে সানস্ক্রিন মেখে বেরোই। যতটা সম্ভব সুতির পোশাক পরার চেষ্টা করি। ছাতা মাথায় হাঁটাটা অত্যন্ত সমস্যার, চেষ্টা করি একটু ছায়া ধরে হাঁটতে। এছাড়াও সানগ্লাস মাস্ট। ব্যাগে জলের বোতলটা একটু বড়ই থাকে। আরেকটা বোতলে গ্লুকনড-ডি মিশিয়ে রেখে দিই। ঘোরাঘুরির সময় ভীষণ কাজে লাগে এগুলো। এভাবেই গরমের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছি।"
গনগনে আঁচের মুখে দাঁড়িয়েও ফাস্টফুড বিক্রেতা রাম কিশোরের মুখে হাসি। তাঁর কথায়, "এসব আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে পাখার তলায় বসে একটা গোটা দিন কাটাতেই পারব না। দোকান না খুললে আরও গরম করবে।" বলেই হোহো করে হেসে ফেলেন তিনি।