কলকাতায় যেমন শীতকাল এলে বাঙালীর মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়, তেমন ক্যানাডায় দু’মাসের গরমকালকে আমরা জাপটে ধরে থাকি। কিছুতেই যেতে দিতে চাইনা। হালকা-পাতলা, ছেঁড়া-ছেঁড়া পোশাক-আশাক পরে সূয্যিমামার দিকে হাত-পা বাড়িয়ে উত্তাপ নিই। যে যতটা পারে শরীর অনাবৃত করে সারা বছরের মতো ভিটামিন ডি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকে।
কিন্তু যাচ্ছে, শাঁইশাঁই করে গ্রীষ্মকাল হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বরফের ঘনঘটা ওত পেতে বসে আছে উত্তর দিগন্তে, “নে নে, যত খুশি জামাকাপড় খুলে নেচে নে, আর তো ক’দিন!” হ্যা হ্যা করে হাসছে ক্যানাডার ভয়ঙ্কর শীত। এরপর তো শুধু নিজেকে আবৃত করা নয়, রীতিমত বোরখা পরতে হবে, স্নো-বোরখা। হাত, পা, মুখ, নাক, কান, কপাল, গলা, আঙ্গুল, সব ঢাকতে হবে। সে যে ধর্মেরই হও। শীতের কামড় সর্বধর্ম-গোঁড়া দাদুদের থেকেও প্রবল কামড়। এখন যত পারো কোমর বের করে নেচে নাও।
আরও পড়ুন: কলকাতার হেঁশেলের গন্ধে ক্যানাডার বাঙালি এখন ফুলে-ফেঁপে সতেজ
তবে এ বছর গ্রীষ্মকালে একটা অভিনব অভিজ্ঞতা হলো। কলকাতা স্ট্রিট ফুডের দোকান! ঘুগনি, ভেজিটেবল চপ, মোচার চপ, এগ রোল, চিকেন রোল, পাটিসাপটা, মিষ্টি দই! খোদ টরন্টোর নাথান ফিলিপ স্কোয়ারে 'টেস্ট অফ ইন্ডিয়া' বলে একটা উৎসব হচ্ছিল, তাতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কলকাতার ‘কাফে ডি’কলকাতা’র স্টল! পরম যত্নে অর্পিতা, রুমকি, অনামিকা, জয়দীপ, নীলম আর বেঞ্জামিন তাদের বাঙালী রন্ধন পটুতার প্রদর্শনে সাদা-কালো-বাদামী-হলুদ সর্বধর্ম সমন্বয়কে কলকাতার স্বাদ, কলকাতার গন্ধতে মাতোয়ারা করল। আহা! সে কী মনোরম দৃশ্য। মনটা ভরে গেল।
আরও একটা স্টল ছিল, নাম ‘কলকাতা ক্লাব’। কিন্তু তাদের খাবারের কলকাতার খাবারের সাথে খুব একটা সম্পর্ক নেই। সেই বিষ বাটার চিকেন, নান, পনির বাটার মসালা, ডাল তড়কা, যা খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গেছে, তাই নতুন নামে বেচছে। তাই-ই খাবার জন্য পিলপিল করে সর্ব-রঙের লোকেদের লাইন।
এখন এখানে বেশ গরম, দিনের বেলা ৩০-৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁইছুঁই। মানে এক কথায়, এখানে সারা বছর তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রির মাঝে খেলা করে। মানুষগুলোকে হাতে করে লোফালুফি করেন মা ধরিত্রী। আমার এক আত্মীয়র ছেলে ‘সামার ইন্টার্ন’ হয়ে তিন মাসের জন্য এসেছিল ইউনিভারসিটি অফ টরন্টোয়। দেখা হতে বলল, “গরমে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি।” যে ডর্মিটরিতে থাকে, সেখানে এসি নেই, পাখাও চলে মিউ-মিউ করে। রাতে ঘুমোতে পারে না ঠিকমতন। আমাদের গাড়িতে উঠে বলল, “আহ! কতদিন পর এসিতে উঠলাম!” আমি বললাম, “দেশে গিয়ে কাউকে বোলো না তুমি ক্যানাডায় ‘গরমে কষ্ট পেয়েছ’!”
গরমে এখানে ভীষণ গরম। সারাদিন এসি চলে। বাতাসে আর্দ্রতা তেমন নেই, তাই ঘাম হয় না, কিন্তু রোদ এমন প্রখর, যে বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে গা-হাত-পা জ্বালা করে। শরীরের যেখানে রোদ পড়ছে সেখানটা তেতে যায়, আর বাকিটা থাকে ঠান্ডা। তাই রোদে পা ছড়িয়ে, বা পিঠ দিয়ে বসলে ব্যথায় খুব আরাম হয়। এই ক’টা দিন আমাদের ভিটামিন ডি সংগ্রহকাল, আর তাই গ্রীষ্মকালে সকলে মনের আনন্দে বস্ত্রের সঙ্গে আড়ি করে ছাঁট পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ক্যানাডায় “যাহা খুশি পরিতে পারো... যেখানে খুশি যাইতে পারো... যখন খুশি ফিরিতে পারো...” কেহ কিচ্ছু বলিবে না!
আরও পড়ুন: মাগুর মাছ, ইঁদুর, টিকটিকির ট্রেনিং দিতে দিতে কাহিল বাঙালি মা!
যেমন এই তো সেদিন 'ক্যারিবেনা' হলো। ক্যারিবানা একটি ক্যারিবিয়ান কার্নিভাল যাকে উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম স্ট্রিট ফেস্টিভাল বলা হয়। প্রতিবছর কয়েক কোটি মানুষের ভিড় উপচে পড়ে টরন্টো শহরে। প্রায় দেড় মিলিয়ন, বা ১৫ লক্ষ, দর্শনার্থী আসেন। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বাইরে এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয় টরন্টোয়, নিউ ইয়র্ক সিটিতে, নটিং হিলে এবং বস্টনে। বার্ষিক ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থনীতিতে নিয়ে আসে শুধু ওন্টারিওতে।
তিন দিনের উৎসব তিন সপ্তাহ অবধি চলে। টরন্টোর রাস্তায় গাড়ি সামলাতে পুলিশ নামাতে হয় রীতিমতন। আবার ঘোড়ায় চড়া পুলিশ। চোখ-ধাঁধানো রঙিন পোষাকে পালে পালে ক্যারিবিয়ান তাঁদের হিলহিলে শরীর নিয়ে হাঁটেন বিভিন্ন রাস্তায়। নানান গান চলে মাইকে। সে পোষাক চমকপ্রদ, তাতে কাপড় কম, পালক বেশি, পুঁতি বেশি। শরির ঢাকার খুব একটা চেষ্টা নেই। দু-চারটে চুমকি দিয়েই ঢাকা দেহের আবশ্যক অংশগুলি। এ হেন বরফের দেশে, যেখানে মাইনাস ৩৫ ডিগ্রিতে হিহি করে কাঁপে শহর অর্ধেক বছর, এমন বিরল দৃশ্য দেখতে আমাদের মতন হাড়-হাভাতে বাঙ্গালিরা টিকিট তো কাটবেই।
গরমের আরও একটা দিক হচ্ছে 'বীচে' যাওয়া। বিশ্বের বৃহত্তম চারটে লেক আছে ক্যানাডায় - লেক ওন্টারিও, লেক হিউরন, লেক সুপিরিয়র আর লেক ইরী। এদের মিলিয়ে বলা হয় ‘দ্য গ্রেট লেকস’। এরা লেক স্রেফ নামেই, এপার-ওপার দেখা যায় না, তটে গুঁড়িগুঁড়ি ঢেউ আছে, সমুদ্রের স্বাদ ঘোলে মেটে। এই লেকগুলোর তটেই ক্যানাডাবাসী সারা গ্রীষ্মকাল পড়ে থাকে। এরা এই তটগুলোকে বলে ‘বীচ’। বীচে যাওয়ার সে কী আনন্দ! রং-বেরঙের রবারের বল, সার্ফবোর্ড, পুতুল, হাঁস, ভেসে থাকার পাইপ, কান্যো, এমনকি ছোট ছোট সেইল বোট আর মোটর বোট গাড়ির সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চলল ‘বীচে’। গুঁড়িগুঁড়ি ঢেউয়ের মাঝে বাচ্চারা লাফাচ্ছে আর ভাবছে, এটা সমুদ্র। আহারে, চল ওদের ছেড়ে দিই পুরীর ঢেউয়ের মুখে। হরর্ সিনেমা দেখার মতন ভয় পেয়ে পালিয়ে আসবে!
সেদিন “বীচে যাব, বীচে যাব” বায়না ধরেছিলুম বরের কাছে। উনি জিপিএস কে জিজ্ঞেস করাতে জিপিএস ভদ্রমহিলা আমাদের গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে এক ‘ন্যূড বীচে’ নিয়ে এসে বললেন, “ইউ হ্যাভ রিচড ইওর ডেস্টিনেশন” । ন্যূড বীচের এক দিকে জামাকাপড় পরা আবশ্যক, আর এক দিকে তা নয়। লেখা রয়েছে, যারা জামাকাপড় পরতে চান না, তাঁদের যেন সম্মান করা হয়। ভাগ্যিস সেদিন অন্ধকার হয়ে গেছিল, আর বীচ বন্ধ হয়ে গেছিল। তা না হলে ছেলে-বর নিয়ে মহা বিপদে পড়তাম।
আমি ভাবছি, আগামী গ্রীষ্মকালে এখানে একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁ করব। সেখানে কাশ্মিরী ‘রোগন জোস’ থেকে শুরু করে কলকাতার ‘শুক্তো’, গিলগিটের ‘চাপশোরো’ (গো-মাংস দিয়ে ঠাসা রুটি) থেকে বালোচিস্তানের ‘দমপুক্থ’ রাখব। মাঝখানের পাকিস্তানেরও কিছু খাবার রাখব, ওদের বিরিয়ানি আমাদের বড়ো ভালো লাগে। যদি না আমার এই লেখাটা বেরোবার আগেই আর এক নাটকীয় আঁচড়ে ব্রিটিশ সংসদের সেই মহামূল্যবান এবং মহা-ক্রূর ভারতীয় ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট-এর শিরোচ্ছেদ হয়ে গিয়ে ভারত-পাক সীমান্তটাই খসে পড়ে! তাহলে তো কথাই নেই। এক ‘ঐতিহাসিক অবিচ্ছেদ্য ভারতীয় রেস্তোরাঁ’ খুলব।
যে হারে আইন ভাঙ্গতে শুরু করেছে, আর যে হারে সবাই তা মিটমিট করে হেসে মেনে নিচ্ছে, দেশে, বিদেশে প্রায় সকলেই, মনে হচ্ছে না সিন্ধু নদের জলের জোয়ার বেশিক্ষণ চাপা থাকবে, নদীপথও দিকভ্রষ্ট হতে চলেছে, তার ঢাল টাল সামলাতে পারছে না। অবশ্য তার আগে, ভারতের মাথার মুকুটকে আবার মাথায় বসানোর স্বপ্ন যা অমিত শাহ দেখেছেন, তাতে কিন্তু অনেক গোঁয়ার শর্ত আছে যা এইসব ঠাকুরমশাইদের মেনে নিতে হবে। ভারতকে আক্ষরিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে, শুধু খাতায় কলমে নয়। আর ‘মাইনোরিটি’ বলে কাউকেই রাখা যাবে না। সবাই মেজোরিটি। সবাই রাজা। অনেক দায়িত্ব।
এই 'গরমের দেশ' থেকে ঘামতে ঘামতে আমার দু'পয়সা (মাই টু সেন্টস)-র জ্ঞান!