Advertisment

প্রবাসিনীর চিঠি: মাগুর মাছ, ইঁদুর, টিকটিকির ট্রেনিং দিতে দিতে কাহিল বাঙালি মা!

বেশ কয়েক বছর পরে পরে কলকাতায় গেলে যেটা সর্বপ্রথম গ্রাস করতে আসে, সেটা অবশ্য টিকটিকি নয়। সেটা হচ্ছে চারিপাশ থেকে ধেয়ে আসা অটো আর বাস।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Letter from Canada blog

অলংকরণ: অরিত্র দে

বাঙালী ছেলেমেয়েরা প্রবাসে এলে তাদের তিনটে ভাষা - বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দি - শুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে ঘেঁটে 'ঘ' হয়ে যায়। মায়েদের হয়রানির শেষ থাকে না সামান্য বাংলা কথা তাদের শেখাতে শেখাতে। আমার ছেলেকেই ধরুন না। মাছ খেতে চায় না বরাবরই। "কাঁটা, কাঁটা" বলে সব বাঙালি মাছ ওর বাদের খাতায়। মাগুর মাছের দর করেছিলাম একদিন, তাই জিজ্ঞেস করলাম, "খাবি?"

Advertisment

"মাগুর মাছ? Crocodile? না!"

Crocodile! মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মাগুর মাছ কি সর্পিল প্রজাতির? বললাম, "না না... মাগুর মাছ, মাগুর... শিঙি... কাঁটা ছাড়া... খেতিস না কলকাতায়?"

কিন্তু crocodile বলল কেন? অবাক হলাম।

রাতে সোনি চ্যানেলে বসে একটা হিন্দি সিরিয়াল দেখতে দেখতে মাথায় এল। মাগুর মাছ, মগরমছ্‌! Crocodile! হা ঈশ্বর!

ওকে নিয়ে এসব লিখছি জানলে আমায় ত্যাজ্য মা করবে। কিন্তু একা একা অত হাসি কেমন করে?

শাশুড়ি কলকাতা থেকে আমার বরের হাত দিয়ে পাটিসাপ্টার পুর পাঠিয়েছিলেন। দারুণ বানালাম পাটিসাপ্টা। আমার ছেলে খেয়ে বলল, "দারুন হয়েছে, আর একটা 'পাটিসাপ' দেবে?" আমি পেট চেপে হাসতে রেগে গেল। বলল, "আমি ভাবলাম একটা পাটিসাপ-কে তুমি পাটিসাপ-টা বলছ!"

আমার এক বন্ধুর বন্ধু বেশি দূরে নয়, দিল্লিতে থাকে। তার ছেলের ওখানেই জন্ম, ওখানেই মানুষ। বাংলা ভালই বলতে পারে। বাড়িতে বাংলাতেই কথাবার্তা চলে। কিন্তু...কলকাতায় এসেছে। পাশের বাড়ির কাকিমা তাকে ডেকে বললেন, "হ্যাঁ রে, মা বাড়িতে? একটু বলবি আমি ডাকছি?" ছেলে খুব সসম্মানে বলল, "হ্যাঁ আন্টি, মা'কে এক্ষুনি ভেজে দিচ্ছি।"

আরও পড়ুন: প্রবাসীনির চিঠি: যন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেতে চলুন যাই ‘ই-হারিয়ে’!

আমার ছেলের খুব রাগ হয় যদি আমি ওকে বলি, "আচ্ছা, বাংলায় বলতে হবে না, ইংরেজিতেই বল।" সত্যজিৎ রায় দু’দুটো ছবিতে বলেছিলেন, "বিদেশে বাংলা ভুলতে চাইলে এক দিনেই ভোলা যায়, আর না ভুলতে চাইলে সারা জীবনেও ভোলা যায় না" ('সোনার কেল্লা', 'আগন্তুক')। এই কথাটা বোধহয় ওর মজ্জায় ঢুকে আছে, তাই বাংলা কথা কিছু না বুঝতে পারলে ভয়ানক রেগে যায়। কিন্তু বেচারার বাংলার সঙ্গে যা কিছু সম্পর্ক সে শুধু তার মা-বাবার মাধ্যমে। তাই ক্ষেপানোর জন্য মাঝে মাঝে বাংলা বাগধারা আওড়াই, "খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল করল এঁড়ে গরু কিনে।" খেপে ব্যোম! "I didn’t understand anything of that!" আর আমি হেসে খুন!

একবার কলকাতায় আমার বাপের বাড়িতে একটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়েছিল। আমরা তখন দেশে বেড়াতে গেছি। আমাদের বাড়িটা অনেক পুরোনো। ছেলে ঘরে কম্প্যুটার নিয়ে খুটখাট করছে। হঠাৎ্‌ ইঁদুর দেখে আমার মা লাফিয়ে উঠে নাতিকে চিৎকার করে ডাকলেন, "গুট্টুউউ... ইঁদুর! খিলটা নিয়ে আয়! খিলটা নিয়ে আয়!" গুট্টু ঘর থেকে থতমত খেয়ে বেরিয়ে বলল, "খিল কী?"

দিদিমা যথারীতি ভুলে গেছেন, নাতি বহু বছর দেশের বাইরে। খিল তো দুরের কথা, ইঁদুরই দেখেনি কত বছর। আমার এক বন্ধুর ২০ বছরের ছেলে এখানে আসার অনেক বছর পর কলকাতায় গিয়ে দেওয়ালে টিকটিকি দেখে, "Mom, baby crocodile!" বলে চেঁচানোয় তাকে প্রচুর ঠাট্টার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আসলে, টিকটিকি যে কী জিনিস, সেটাই তাকে বলা হয়ে ওঠে নি। ক্যানাডায় টিকটিকি নেই। অতিরিক্ত ঠান্ডার প্রকোপে এদেশে পোকামাকড় জন্মায় খুব কম। দু-তিন মাস যে গরম থাকে তাতে বাগানে বিস্তর মাকড়সা, প্রজাপতি, ভিমরুল, এমনকি ইঁদুর আর মশাও দেখা যায়, কিন্তু টিকটিকি নেই। যতদুর জানি, টিকটিকি প্রধানত গরমের দেশের জীব, তাই কলকাতার দেওয়ালে যেটা আকছার ঘুরে বেড়ায়, যেটা কেউ অনেক সময় লক্ষ্যই করেন না, সেটা এখানকার বাচ্চাদের কাছে ভয়ঙ্কর একটা প্রাণী!

publive-image আবশ্যকীয় শিক্ষা

বেশ কয়েক বছর পরে পরে কলকাতায় গেলে যেটা সর্বপ্রথম গ্রাস করতে আসে, সেটা অবশ্য টিকটিকি নয়। সেটা হচ্ছে চারিপাশ থেকে ধেয়ে আসা অটো আর বাস। প্রথমত, গাড়িগুলো 'উলটো' দিক থেকে আসছে, তারপর রাস্তা পার হওয়ার কোন সিগন্যাল নেই, ফাঁক-ফোকর দিয়ে পার হতে হবে। মিনিবাসগুলো যেন মনে হয় তেড়েফুঁড়ে আসছে আমাকেই পিষবে বলে। জমে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি সরে যাওয়ার বদলে। "আরে দিদিইই, মরবেন নাকি? সরে দাঁড়ান!" সেই এক গলা, যা শুনে বড় হয়েছি, কানে এলেই আবার মনে হয় যে না, এই তো, আমি নিজের বাড়িতেই এসেছি।

আমরা তো অনেক বয়েসে দেশ ছেড়েছি। তাও দেশে গেলে এখন প্রথম কয়েকটা দিন গলির মুখ পার হতে ভয় লাগে। সবচেয়ে অবাক লাগে দেখলে যে কারোর প্রাণের মায়া নেই। মায়া থাকাটা যেন কাপুরুষতা। আমার মা ছিলেন সবচেয়ে ডানপিটে। পাঁই-পাঁই করে রাস্তা পার হতেন। আমি হাত চেপে বলতাম, "মা দাঁড়াও, ঐ দেখা যায় ওয়াক সাইন? ওটা সবুজ হলে রাস্তা পার হবে, হ্যাঁ?"

আরও পড়ুন: ক্যানাডায় মন ভরিয়ে দিল ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’

মা বলতেন, "ধুস! ওসব তোদের দেশে হয়। চল তো!" পরে একদিন গল্পের ছলে বলেছিলেন, আমাদের এখানে এসেও মা আর বাবা নাকি অমনি দৌড়ে বড় রাস্তা পার হয়েছিলেন একদিন একা একা বেড়াতে গিয়ে। আমাদের এখানে গাড়ি নির্বিঘ্নে চলে ন্যুনতম ৭০ কিমি স্পীডে। ইচ্ছে থাকলেও তারা নিয়ন্ত্রন করতে পারত না। কে জানে কোন দেবতার বরে বাবা-মা সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন।

এ বছর কলকাতায় অটোর সামনে বসে আমি একটু স্লিপ করছিলাম। বললাম, "দাদা, একটু চেপে বসবেন? আমি পড়ে গেলে খুব লাগবে।"

"হেঁ হেঁ, দিদি কী যে বলেন? পড়বেন কেন?"

"ও মা! আপনার সিটটা বাঁকা, পড়ে গেলে পাশের বাসের তলায় সটান। আমি বাসের তলায় মরতে চাই না দাদা।"

"আপনার এত মরার ভয়?"

মরার ভয় না থাকাটাই কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা এবং পার হওয়ার মুল ইউএসপি। মরার ভয় থাকলে রাস্তার এক ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে অনন্তকাল। আমার ছেলে এবার একা যাচ্ছে কলকাতায় বেড়াতে। টরন্টো থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে কলকাতা – অর্ধেক পৃথিবী পেরিয়ে যাওয়াতে আমার কোনো চিন্তা নেই, চিন্তা কলকাতায় গিয়ে রাস্তা পার হবে কী করে!

ভাবছেন, আহা কত বড়লোকই না বিদেশে থাকে যাহা তাহা! কলকাতায় যাতায়াত করে যেন পাশের বাড়ি। হক কথা। প্রত্যেক বছর পাল্লা দিয়ে সব বাঙালি কলকাতায় যায়। ওটা স্ট্যাটাস। যেমন কলকাতার লোক ইউরোপ যায়, মলডিভস্‌ যায়, ব্যাংকক যায়, তেমনি। তবে আমাদের বাৎসরিক কলকাতা ভ্রমণ অনেক সময় মূলধনের ভান্ডারে অনাবশ্যক কোদাল চালায়। না গেলে কিন্তু আমরা আরো বড়লোক হয়ে থাকতে পারতাম। কিন্তু ওই যে? ওই অটোতে বসে উলটো দিকের তেড়ে আসা বাসের বীরাঙ্গনার মতন মুখোমুখি হওয়ার কী যে টান, জানি না। লোকাল ট্রেনে লাফিয়ে উঠে আসানসোল, বর্ধমান যাওয়ার যে কী টান, বোঝাতে পারব না। "ছুপানা ভি নহি আতা, যতানা ভি নহি আতা... হামেঁ তুমসে মহব্বত হ্যায়, বতানা ভি নহি আতা..."

আরও পড়ুন: প্রবাসিনীর চিঠি: আমায় আবার বিয়ে করতে বোলো না

প্রসঙ্গত, ক্যানাডায় রাস্তায় চলার সর্প্রথম অধিকার পায়ে চলা পথিকদের । বড় বড় ট্রাক এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, পথচলতিরা হেলে-দুলে মোবাইল দেখতে দেখতে রাস্তা পার হতে পারে। যতক্ষণ 'ওয়াক সাইন' আছে, বা এমনি মোড়ে মোড়ে স্টপ সাইনে, যতক্ষণ না সে পথিক ফুটপাথে উঠছে, গাড়ির নড়ার কোন অধিকারই নেই। নড়লেই ফাইন। পথচলতিদের এমন অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে, যে 'ওয়াক সাইন' জ্বললেই চলতে শুরু করে, গাড়ি আসছে, না ব্রেক ফেল করল, তা দেখে না। সব দায় তখন চালকের। আইন অনুযায়ী। আমার বর তো বিড়বিড় করে বাংলায় গজরাতে থাকে, "শুয়োরের নাতি! দেখ, যেন বাবার বাগানে বেড়াচ্ছে! পড়ত কলকাতার গাড়ির কবলে, হর্ন আর গালাগালির চোটে দেখত মজা।"

আগের এক কিস্তিতে লিখেছিলাম, কীভাবে এখানকার ছেলেমেয়েরা বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত। সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার, হ-য-ব-র-ল, হীরক রাজার দেশে, পদিপিসির বর্মিবাক্স, সবই মুখস্থ। কিন্তু মা-বাবার সযত্নে গড়া বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতার বৃত্তের মধ্যেই তাদের বিচরণ। সিলেবাসের বাইরে কিছু এলেই তারা থতমত। তাই তো টিকটিকি দেখে ঘাবড়ে যায়, যতই ট্রেনিং দিন না কেন বাবা-মা। তাই তো 'খিল' কী জানে না। তাই তো আজকাল আমি বেশি করে বাংলা চ্যানেল চালাই, বাংলা বাগধারা আওড়াই, বাংলা বই পড়ে শোনাই, বাংলায় টাইপ করে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করি। নিজের শিকড়ের সাথে ওতপ্রোত হয়ে জাপটে রাখি। তা না হলে জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় - ফিরে গিয়ে দেশের মানুষের আপন হওয়া, আর কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা - পাশ করবে কেমন করে?

Advertisment