Advertisment

এই শহরের কোন দোকান থেকে কোট-প্যান্ট ধোয়াতেন বড়লাটেরা?

পূর্ব পুরুষেরা দায়িত্ব দিয়েছিলেন ব্যবসা রক্ষা করার, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরের প্রজন্ম এই পেশায় আর থাকবে বলে মনে হয়না

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

শশীভূষণ দে স্ট্রিট। শেয়ালদার দিক থেকে আসলে রাস্তার একেবারে শুরুতেই পড়ে দোকানটা। দ্য ক্যালকাটা শল রিপেয়ারিং ওয়ার্ক্স। নামের ওপর লেখা '১৮৭৬'। লকডাউন উঠে গেলে রাস্তা ধরে সকাল বিকেল হেঁটে গেলে চোখে পড়বে দোকানে বসে মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন চোখে চশমা আঁটা এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। মহম্মদ গলিব। চার পুরুষ ধরে কলকাতায় ব্যবসা করছেন ওঁরা। শহরজুড়ে বন্দিদশা নামার আগেই দেড় শতকের সেই ইতিহাস নিয়েই টুকরো টুকরো আড্ডা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে।

Advertisment

আদি বাস মায়াপুরে। সে সময় পেশার কারণে পদবী ছিল ওস্তাগার। মায়াপুর থেকে রুজির টানেই কলকাতা আসা। ঘোড়ায় চেপে কলকাতায় এসেছিলেন মহম্মদ গলিবের প্রপিতামহ। দিন চার পাঁচেক সময় লেগেছিল অবশ্য। সেই থেকে কলকাতায় ব্যবসার শুরু। কাগজে কলমে হিসেব থেকেছে ১৮৭৬ সাল থেকে, তবে দোকানের বয়স নাকি আসলে আরও অনেক বেশি।  এ শহরে যে ক'টি পুরনো শাল মেরামতির দোকান রয়েছে, ক্যালকাটা শল রিপেয়ারিং সেন্টার তার মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে পুরোনোও হতে পারে অবশ্য। ঠাকুমার কাছে গল্প শোনা, ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনিক পদে থাকা গন্যিমান্যিদের অনেকেই তাঁদের কোট প্যান্ট ধুতে দিতেন এই দোকানেই। একাধিক বড়লাটেদেরও বাঁধাধরা ছিল এই দোকান।

publive-image দোকান মালিক মহম্মদ গালিব

এখন ব্যবসা কেমন চলে? প্রশ্ন করতেই কিছুটা আনমনা গলিব। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, "আমার ব্যবসায় সুবর্ণ যুগ ছিল ১৯৭০ থেকে ১৯৮৫। এখনও পসার যে নেই, তা নয়, তবে আমার কারিগর কমে আসছে। নামী দামি খদ্দের নিয়মিত এখনও আসেন। তবে এই পেশায় মজুরি কম। তাও এতদিন আমার সব কারিগর আসতেন মায়াপুর থেকে। পূর্ব পুরুষেরা দায়িত্ব দিয়েছিলেন ব্যবসা রক্ষা করার, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরের প্রজন্ম এই পেশায় আর থাকবে বলে মনে হয়না। দুই ছেলেই কলকাতার বাইরে যে যার মতো করে প্রতিষ্ঠিত"।

publive-image দোকানের দেওয়ালে টাঙানো তিন পুরুষের ছবি।

বাংলার অশান্ত রাজনৈতিক হাওয়া কি কোনো প্রভাব ফেলছে না? উত্তরে গালিবের স্পষ্ট জবাব, "আমার পোশাক, চলনে আমার ধর্ম বোঝা যায় না। দীর্ঘদিনের খদ্দেরও অনেকসময় না বললে বুঝতে পারেননি আমি মুসলমান। দোকানে তিন প্রজন্মের যে ছবি রয়েছে, তাতেও ধর্মের কোনো চিহ্ন নেই। চিহ্ন যে বহন করতেই হবে, তা মনে করিনি আজীবন, তবে যে ধর্ম নিয়ে জন্মেছি, তাকে ভালোবাসিনি, এমন তো নয়। নাম শুনে ছিটকে যান অনেকেই, সে আগেও যেত। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় দাঙ্গায় আমার বাবাঠাকুরদারা  এ অঞ্চলের হিন্দু পড়শিদের জন্যই বেঁচে গেছিলেন। বাষট্টির দাঙ্গাতেও। অথচ এই শহরেই আবার অনেক সময় হিন্দু পাড়ায় ঘর ভাড়া পাইনি। তবে আজকের এই পরিস্থিতি আগে ছিল না। এখন চারপাশে ভয়ের আবহ"।

তবে গালিবের বিশ্বাস, একদিন সময় পালটাবে। মানুষের পরিচয় আর লেখা থাকবে না, ধর্মে কিমবা পদবীতে। নিজের ছেলেরা "জীবনসঙ্গী বেছে নিলে আপনার কিছু বলার থাকবে"? প্রশ্ন শুনে সহাস্যে উত্তর- "চাকরিসূত্রে ছেলেরা বাইরে। অফিসে পাশের টেবিলে বসা মেয়েটিকে যদি জীবনসঙ্গী করতে চায়, করবে। তার ধর্ম কী, ভাষা কী এসব ভেবে কী করব"।

Advertisment