কয়েক মাস আগের কথা। যে মুখ দিয়ে রোজ সন্ধ্যাবেলা মঞ্চে উঠে সংলাপ বলতেন, সেই মুখেই থাবা বসিয়েছে মারণ রোগ। প্রথমে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি। বলা ভাল, অবহেলা করেছিলেন। তারপর যখন শেষমেষ চিকিৎসকের দরজায় কড়া নাড়তে হল, তখন অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসক রায় দিয়ে জানিয়েছেন, "আর কিছু করার নেই।" এরপর থেকেই এখন রোজ একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছেন মঞ্চাভিনেতা সতীশ সাউ। ওই নাট্যকর্মীর এহেন পরিণতি দেখে স্বভাবতই বিচলিত নাট্যজগৎ।
তবে শুধু নাট্যমঞ্চই নয়, নাট্যকর্মীদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন নাট্যপ্রেমী চিকিৎসকরাও। তাই নাট্যকর্মীদের সুস্থ থাকার সহজ উপায় বাতলাতে এবার উদ্যোগ নিচ্ছেন একদল চিকিৎসক। তাঁদের পাশে রয়েছে 'থিয়েটার ফোরাম'। এভাবেই জন্ম নিয়েছে নাট্যকর্মীদের জন্য প্রথম স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির, 'আরোগ্য'। যেখানে আগামী রবিবার প্রথমবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারবেন নাট্যকর্মীরা।
এমন ভাবনা কেন? জবাবে অন্যতম উদ্যোক্তা তথা চিকিৎসক সায়ন্তন চক্রবর্তী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বললেন, "দু'জন নাট্যকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। যাঁদের মধ্যে সতীশ সাউ নামের এক নাট্যকর্মীর মুখে ক্যান্সার ধরা পড়ে। উনি প্রথমে অবহেলা করেছিলেন। এখন ডাক্তার বলে দিয়েছেন যে, কিছু করার নেই আর। আরেক নাট্যকর্মী গণপতি নস্করও অসুস্থ হন। ওঁদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। সেসময় ওই দুজনের চিকিৎসার জন্য থিয়েটার ফোরাম ফেসবুকে 'আরোগ্য' নামে একটা উদ্যোগ শুরু করে। যেখানে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। বহু নাট্যদলকে বলা হয়, আমরা স্টেজ দিচ্ছি নিখরচায়, আপনারা শো করুন, তাতে যা টাকা উঠবে, তা ওই কর্মীদের চিকিৎসায় খরচ করা হবে। এতে ব্যাপক সাড়া মেলে, বহু টাকা ওঠে। গণপতি নস্করের বাইপাস সার্জারি করা হয়। উনি সুস্থ আছেন এখন।"
সায়ন্তনের কথায়, "এরপর চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত, আমি ও আরও কয়েকজন আলোচনা করি, নাট্যকর্মীদের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির করা যায় কিনা। শুধু কর্মীরা নন, তাঁদের পরিজন যেমন বাবা, মা, ভাইবোন, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, এঁদের জন্য যদি স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির করা যায়। পুজোর আগে আমরা আলোচনায় বসি। ঠিক করি যে, আরোগ্য শুধু কেউ রোগাক্রান্ত হলে নয়, সারা বছর ধরেই চলবে। সতীশের যা হয়েছে, তা প্রথমে অবহেলা করার ফল। অনেকেই প্রথমে ডাক্তারের কাছে যান না বলে বাড়াবাড়ি হয় পরে। তাই আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, রোগ হলে আরোগ্য নয়, প্রথম দিন থেকে আরোগ্যের সঙ্গে থাকুন, যাতে রোগ না হয়।"
আরও পড়ুন: ‘সংবেদনশীলতার সঙ্গে’ ছাত্রীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি শেখান, স্কুলগুলিকে নির্দেশ শিশু অধিকার কমিশনের
বলাই বাহুল্য, এই উদ্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছেন নাট্যকর্মীরা। 'আরোগ্যের' জন্য নিজের বাড়ির একাংশ বিনামূল্যে দান করেছেন নাট্যকর্মী অচিন্ত্য দত্ত। জোড়াবাগান থানার কাছে অচিন্ত্যবাবুর বাড়িতেই বসছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির। এ প্রসঙ্গে সায়ন্তন জানালেন, "অচিন্ত্য দত্ত ওঁর বাড়ি (রবীরূপ মণ্ডপ) ব্যবহার করতে বলেছেন আমাদের। তারপর আমরা আলোচনা করে ঠিক করেছি, প্রতি মাসে একটা রবিবার করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা চেক-আপ করবেন। এ নিয়ে আমাদের পরিচিত কয়েকজন চিকিৎসককে বলি। ওঁরা রাজি হয়ে যান। চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে করা হবে। কবে কোন চিকিৎসক আসবেন, তা আগে থেকে থিয়েটার ফোরামের ফেসবুক পেজে জানিয়ে দেওয়া হবে। সেইমতো নাম লেখানো যাবে।"
আর পাঁচটা এই ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবিরের মতো বিনামূল্যে না হলেও, 'আরোগ্যের' খরচ নামমাত্র। প্রথমবার এই স্বাস্থ্য শিবিরে আসতে হলে দিতে হবে ৩০ টাকা। তারপর থেকে যতবার কেউ ডাক্তার দেখাতে আসবেন, তাঁদের থেকে ১০ টাকা করে নেওয়া হবে। কেন একেবারে বিনামূল্যে করা হচ্ছে না? উত্তরে সায়ন্তন বললেন, "বিনামূল্যে কোনও কিছু করা হলে, তাকে কেউ গুরুত্ব দেন না। তাই এই টাকা নেওয়া হচ্ছে।" তবে এই টাকাও নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হবে বলে জানিয়েছেন সায়ন্তন।
এ প্রসঙ্গে থিয়েটার ফোরামের সেক্রেটারি সত্যজিৎ বললেন, "আশা করছি ভাল হবে। এটা বাংলা থিয়েটারের জন্য খুব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। নাট্যকর্মীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকারও তেমন কোনও উদ্যোগ নেয়নি। সাধারণত নাট্যকর্মীরা নিজেদের শরীরের যত্ন নেন না। তাছাড়া ওঁদের বড় সমস্যা হল টাকার। সম্প্রতি সতীশ সাউয়ের পরিণতি দেখে আমরা ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে এমন উদ্যোগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অবসাদে ভোগা মানুষ থাকেন এই দেশে: সমীক্ষা
আপাতত শুধু এ শহরেই খোলা হচ্ছে 'আরোগ্য'। এক বছরে কেমন সাড়া মেলে, তা দেখার পর আরও পরিকল্পনা রয়েছে। এ ব্যাপারে সায়ন্তন জানালেন, "আগামী দিনে আমরা জেলাতেও নাট্যকর্মীদের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির করব। শুধু নাট্যকর্মী নন, পরবর্তী ক্ষেত্রে সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের জন্যও চালু করা হবে।"
আগামী ১৮ নভেম্বর জোড়াবাগান থানার কাছে রবীরূপ মণ্ডপে বসছে 'আরোগ্য'। আপনি যদি নাট্যকর্মী হন, তবে চেক-আপের জন্য নাম লেখান 98300 33191 এই নম্বরে।