Advertisment

সতীশ ও তার সময়চেতনা

অনেক হিন্দিভাষীই হয়তো বাংলা থিয়েটারে মাঝেমধ্যে অভিনয় করেছেন, কিন্তু তারা সতীশের মত ধারাবাহিক ছিলেন না, অনায়াস ছিলেন না, এতো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ছিলেন না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Theatre Activist Satish Dead

আদতে হিন্দিভাষী হলেও বাংলা থিয়েটারের কর্মী ছিলেন সতীশ (ছবি সূত্র- ফেসবুক)

টাইমিং ছিল সতীশের অভিনয়ে সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র, কমিক টাইমিং। ডেলিভারি একটু আগে পরে হলে আর কাঙ্ক্ষিত লাফটার পাওয়া যায় না অডিয়েন্সের থেকে। আসলে ট্র‍্যাজেডি আর কমেডি প্রায় একই আধার বা বেস থেকে উঠে আসে, শুধু ডেলিভারির তফাতেই তফাত। একজন ওজনদার মানুষ কলার খোসায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে, তার পা হয়তো ভেঙে গেছে, থেঁতলে গেছে মুখ, এখনই রক্তের ব্যবস্থা না হলে বিপদ হতে পারে, এই ঘটনা কাছ থেকে দেখলে আপনি মানুষটির ট্র‍্যাজেডির শরিক হয়ে পড়বেন। আর দূর থেকে যদি দেখেন একই ঘটনা, কলার খোসায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন এক বেজায় মোটা মানুষ পড়ার আগে চেষ্টা করলেন সামলাতে কিন্তু শেষতক আর পেরে উঠলেন না, আপনি এ ঘটনা দূর থেকে দেখলে, হেসে গড়িয়ে পড়বেন। একই ঘটনায় নৈকট্যে আপনি ব্যথিত হবেন আর নৈর্ব্যক্তিক দূরত্বে হেসে উঠবেন। সতীশের চরিত্রায়ণে এই নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব ছিল অনায়াস। ও অভিনয়ের সময় একইসঙ্গে চরিত্র হয়ে উঠতে পারতো, আবার চরিত্র সম্পর্কে নিজের একটা ইন্টারপ্রেটেশন রাখতে পারতো। এটা করতে গেলেই লাগে একধরনের বেখাপ্পা টাইমিং, যার থাকে তার থাকে, সতীশের ছিল। সেই কারণেই নিজের ফাইনাল এক্সিট নিলোও সেই অমোঘ অথচ বেখাপ্পা টাইমিং বজায় রেখে।

সতীশরা পূর্বপুরুষরা হাওড়ার সালকিয়ায় এসেছিলেন প্রায় দেড়শো বছর আগে, উত্তরপ্রদেশ থেকে। ব্রিটিশ শাসনে হাওড়া ছিলো প্রধান শিল্পাঞ্চল। সালকিয়ায় ছিল নানান মিল এবং শিপ বিল্ডার্স কারখানা। সতীশের ঠাকুর্দা সালকিয়ায় কাঠের ব্যবসা শুরু করেন, অর্থাৎ স-মিল। প্রথম থেকেই সতীশদের পরিবার হিন্দির পাশাপাশি ভাষা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলাকেও একইরকম গুরুত্ব দিয়ে আপন করে নেন। সতীশ নিজে হিন্দি মিডিয়ামে পড়াশোনা করলেও, বাংলা পড়তে পারতো। বাংলা উচ্চারণ ছিল, অনেক বাঙালীর চেয়ে ভালো। পারফর্মেন্সে সতীশের একটা ন্যাচারাল ফ্লেয়ার ছিল। ছোটবেলায় স্কুলে কোনো পিরিয়ডে শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে, সতীশের দায়িত্ব ছিল গোটা ক্লাসকে মিমিক্রি করে এন্টারটেইন করা। জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার অভিনেতা কেষ্ট মুখার্জির নকল সে এতো ভালো করতো, যে স্কুলে তার নামই হয়ে যায় 'কেষ্ট'! অল্প অল্প করে পারফর্মেন্সের প্রতি সতীশের আকর্ষণ বাড়তে থাকে, ও যুক্ত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শালকিয়া শাখায়। এই সময় থেকেই মোড় ঘুরে যায়। যা ছিল নেহাতই ভালোলাগা, তাই হয়ে ওঠে জীবনের ধ্যান। আরো ভালো করে থিয়েটার করার ইচ্ছে নিয়ে সতীশ যোগ দেয় চেতনা নাট্যগোষ্ঠীতে। সালকিয়াতেই সতীশের পাড়ার লোক দিলীপ সরকার, উনি চেতনার দীর্ঘদিনের অভিনেতা, তিনি সতীশের অভিনয় দক্ষতা বুঝতে পেরে সতীশকে নিয়ে আসেন চেতনায়। চেতনায় এসে, সুমন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় তিস্তাপারের বৃত্তান্ত নাটকে একটা ছোট চরিত্রে অভিনয় করে সতীশ। চরিত্রটির নাম ছিল ফাগুলাল, খুবই ছোট চরিত্র, কিন্তু সতীশের অভিনয়ের গুণে সে চরিত্র বাংলা থিয়েটারে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরপর থেকে সে প্রথমে চেতনায় পরে তৃতীয় সূত্র নাটকের দলে সুমন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় একের পর এক নাটকে নিজের অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। চেতনায় অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনাতেও সতীশ অভিনয় করেছে। কলকাতার থিয়েটার মহলে ওর অভিনয়ের কদর হতে শুরু করে, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ফ্যাতাড়ু নাটকে সতীশের অভিনয় ওকে বাংলা থিয়েটারের একজন প্রধান অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেয়।

Advertisment

আরও পড়ুন, এ সময় ওবিটের ওবিট লেখার

সতীশের মাতৃভাষা হিন্দি হলেও, সারাজীবন সতীশ বাংলা থিয়েটারেরই সেবা করে এসেছে। এরকম নজির সম্ভবত বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে নেই। অনেক হিন্দিভাষীই হয়তো বাংলা থিয়েটারে মাঝেমধ্যে অভিনয় করেছেন, কিন্তু তারা সতীশের মত ধারাবাহিক ছিলেন না, অনায়াস ছিলেন না, এতো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ছিলেন না। সতীশের একটা রাজনৈতিক শিক্ষার ভিত ছিল, সেই শিক্ষাই ওকে মানুষের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে প্রেরণা দিত, আর সে বুঝেছিল মানুষের সাথে সংযোগ তৈরি করতে হলে, তাদের ভাষা আর সংস্কৃতিকে নিজের করে নিয়েই করতে হয়। পারিবারিক ব্যবসায় জুড়ে গেলে সতীশের জীবন সহজ হত, বাংলার বদলে হিন্দি ভাষায় অভিনয় করলেও টাকাপয়সা বেশি জুটতো। সতীশ যে স্ট্যান্ডার্ডের অভিনেতা ছিল, কাজ পেতে অসুবিধে হত না। কিন্তু সহজ রাস্তা সতীশ নেয়নি। কঠিন রাস্তায় হেঁটেছে, কষ্ট করেছে, কষ্ট পেয়েছে, নিজের ট্র‍্যাজেডিকে নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব দিয়ে কমেডি করে তুলেছে।

কী আশ্চর্য, যে চেতনায় অভিনয় শুরু করেছিল সতীশ , সেই চেতনা নাট্যদলেই ওর শেষ অভিনয় 'ডন- তাকে ভালো লাগে' নাটকে, সুজন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়। আর সে নাটকে সতীশ অভিনয় করছিল সাঞ্চো পাঞ্চার চরিত্রে, যে ডন কিহোতেকে ভরসা দিয়ে বলে প্রভুর পাশে পাশে শেষতক সে যাবে। ডনের চরিত্রে অভিনয় করেন সতীশের নাটকের শিক্ষক, মুর্শিদ, সুমন মুখোপাধ্যায় ওরফে লালদা। যার হাত ধরে শুরু হয়েছিল সতীশের জার্নি, তার পাশেপাশেই শেষতক গেছে সতীশ। কথা রেখেছে, অথবা কথা এমন ছিল না। কিন্তু এমনই বৈপরীত্য, খাঁটি অভিনেতার রসদ।

একটু বেখাপ্পা টাইমিং।

সতীশ জাত অভিনেতা ছিল।

Theatre
Advertisment