আঙুলের ছোঁয়ায় মাটি কথা বলে উঠছে। একটু একটু করে অসীম মমতায়, তীক্ষ্ণ শৈলীতে স্পষ্ট হচ্ছে মায়ের অবয়ব। একমনে দুর্গা মূর্তি তৈরিতে ব্যস্ত পাল মশাই । একমাস ধরে তিনি কাজ করে চলেছেন বাগচী বাড়ির মণ্ডপ ঘরে। আর কোনও প্রতিমা তিনি তৈরি করেন না এইসময়ে। দুর্গা পুজোর আগে এই একটিই তাঁর শিল্পকর্ম। প্রতিমা তৈরির দিনগুলিতে তিনি একদম অন্য মানুষ । কাউকেই মণ্ডপ ঘরে উঠতে দেন না। কেউ এলেই বলেন, “যা যা এহ্যান থেইক্যে যা”। এই বাড়িতেই থাকেন তিনি। কাজ শেষ হলে সবাই যখন মুগ্ধ হয়ে মায়ের রূপ দেখে, তখন খুব আনন্দ হয় পাল মশাই এর। সত্যিই তাঁর হাত শিল্পীর।
বাগচী বাড়ির প্রাণপুরুষ হৃদয়নাথ বাগচীর আগ্রহে এই দুর্গাপুজোর শুরু জলপাইগুড়ি শহরের উকিল পাড়ায়। সেটি ছিল সিপাহী বিদ্রোহের বছর, ১৮৫৭ সাল, পাবনা থেকে জলপাইগুড়ি এলেন হৃদয়নাথ বাগচী। পাবনার সুবিশাল জমিদারি ফেলে নতুন করে শুরু করলেন জয়যাত্রা। দেশ তখন একটু একটু করে জাগছে। পাবনার বাড়িতে পূজিতা দুর্গা এখানে শক্তিরূপে পূজিতা হলেন । কারণ এ বাড়ির সাথে জড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। হৃদয়নাথ বাগচীর পাবনা জমিদারি ছাড়াও ছিল একটি বর্ণময় পেশাগত জীবন। তিনি ছিলেন নামকরা ব্যারিষ্টার, প্র্যাকটিস করতেন ঢাকা কোর্টে। জলপাইগুড়িতে চলে আসার পর কোচবিহারের রাজা তাকে আইনি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। ইংরেজের বিরুদ্ধে কোচবিহার রাজের অনেকগুলি কোর্ট কেস জিতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। খুশি হয়ে রাজা পারিতোষিক দিয়েছিলেন প্রচুর। এই মামলা যে কোনও মামলা ছিল না, ছিল সম্মানরক্ষার লড়াই। এরপর ইংরেজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি পাবনা থেকে আগত জমিদারির টাকায় ডুয়ার্সে প্রথম বাঙালী চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। নাম ছিল মোগলকাটা চা বাগান। আরো ষোলটি চা বাগানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হৃদয়নাথ বাগচী জলপাইগুড়ি শহরের দুটি ব্যাঙ্কের মালিক হন। একটি লক্ষ্মী ব্যাঙ্ক ও অপরটি ট্রেডিং ব্যাঙ্ক। সবটাই ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে এক নীরব যুদ্ধ ঘোষণা। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এ বাড়ির দুই সন্তান নীরেন্দ্রনাথ বাগচী ও ধীরেন্দ্রনাথ বাগচী। নীরেন্দ্রনাথ বাগচী কারাবরণও করেছিলেন। সহিংস এবং অহিংস দুই মতেরই সমাদর করতেন এ বাড়ির মানুষরা। এমনকি মাটির নীচে একটি ঘরে ছিল বিপ্লবীদের গোপন আখড়া।
তাই এ বাড়ির দেবী মূর্তিতে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাম দিকে থাকেন কার্তিক ও ডান দিকে গণেশ। কার্তিকের পাশেই থাকে নবপত্রিকা। এখনো এইরূপেই তৈরি হয় মূর্তি। কালিকা পুরাণ ও দেবী পুরাণ এই দুই মন্ত্র ও শাস্ত্রীয় রীতি মেনে পুজো হয়। মহাস্নানে সপ্তসাগরের জল না এলেও নানা জায়গায় মাটি ও অন্যান্য উপকরণ পুজোয় ব্যবহার হয়।
আরও পড়ুন, প্রথা মেনে আজও নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ে রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোয়
শাক্ত মতে পুজো করা হয় বলে আগে পুজোতে মোষ ও পাঁঠা বলি হত। সপ্তমীতে সাতটি, অষ্টমীতে আটটি, নবমীতে নয়টি পাঁঠা বলি হত। বর্তমানে বন্ধ হয়েছে বলি প্রথা। তবে দেবীর ভোগ আয়োজনে থাকে দু-তিন রকমের মাছ। সবই রান্না হয় পেঁয়াজ রসুন বাদ দিয়ে। ভোগ রান্নার কাজে এবাড়ির বধূরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। আগে প্রতিদিন গড়ে নিমন্ত্রিত হতেন প্রায় হাজার জন । পরিবেশন করার কাজে হাত লাগাতেন বাড়ির ছেলেরা । এখন পারিবারিক আয় কমার সাথে সাথে কমেছে জৌলুস। কিন্তু নিষ্ঠার ভাগ কমেনি এতটুকুও। আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় নাড়ু, মুড়কি তৈরির কাজ। মা দুর্গা ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেন, অসময়ে যদি খিদে পায় তাই হয়তো নিবেদন করা হয় “রচনা”। পাঁচটি মাটির সরায় মুড়কি নাড়ু তক্তি সাজিয়ে, ঢেকে, প্রতিমার পাশে রেখে দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে থাকে ফলমূল ও নাড়ু মুড়কির ভোগ, দুপুরে অন্নভোগ, বিকেলে নিবেদিত হয় বৈকালিক পুজো ও লুচি তরকারি, ক্ষীর/পায়েস ভোগ, নবমীতেই তৈরি হয় দশমী পুজোর ভোগ। পান্তা ভাত, পুঁটি মাছ ভাজা, ইলিশ মাছ ভাজা ও শাপলার চাটনি।
আগে পুজোতে ১০৮ টি পদ্ম নিবেদিত হত, বর্তমানে ২৮ টি পদ্ম দেবীর চরণে নিবেদিত হয়। আর একটি প্রথা রয়েছে এ পুজোয়। নবমীর দিন হোমের পর ভরার থালা ওঠানো হয়। অনির্বাণ প্রদীপ ও নানা পুজোর উপকরণে সাজানো হয় থালাটি। বাড়ির কনিষ্ঠ পুত্রের মাথায় থাকে ভরার থালা, বাকি ছেলেরা ভরাটি চারদিকে ধরে থাকে। যে ঘরে ভরার থালা স্থাপন করা হয়, সেই ঘরেই হয় লক্ষ্মী পুজো। প্রদীপটি ততদিন জ্বলতে থাকে। নবমীর দিনই বাড়ির বধূরা সিঁদুর দান করেন দেবীর পায়ে। বিসর্জনের পর ঠাকুর স্পর্শ করাই এ বাড়ির রীতি। তাই নবমীর সিঁদুর দান হয় একটি কয়েন দিয়ে। সেটি রক্ষিত হয় বধূর ভরার কৌটোয়।
পূর্বে একচালার প্রতিমা আকারে বড় হবার কারণে বিসর্জনের দিন ভাড়া করা হত জোড়া নৌকা। জোড়া নৌকোয় কাঠের পাটাতন বেঁধে তোলা হত প্রতিমা। সেই নৌকোতে সওয়ারি হত বাড়ির সদস্যরা। বাগচী বাড়ির পুজোয় দেখবার মত বিষয় বাড়ির ছেলেমেয়েদের আরতি। জোড়া ঢাকের বোল, ধুনুচির ধোঁয়া, আরতির ছন্দে মেতে ওঠে পুজো প্রাঙ্গন। এ প্রসঙ্গে আরো একটি তথ্য না জানালেই নয়, পুজো উপলক্ষে আয়োজিত হয় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বাড়ির সদস্য সদস্যারা। যাঁরা অনেকেই প্রতিষ্ঠিত শিল্পী।
এ বাড়ির একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। হৃদয়নাথ বাগচীর পুত্র লোকেন বাগচী ছিলেন ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের একনিষ্ঠ সাধক। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় জলপাইগুড়ি শহরে ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রসার হয়েছিল। বর্তমানে দেবাশিষ বাগচী ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারাটি বজায় রেখেছেন। তাই পুজোর অনুষ্ঠানে বাড়ির সদস্য সদস্যাদের অংশগ্রহণ একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করে। বিখ্যাত কত্থক নৃত্যশিল্পী অসীমবন্ধু ভট্টাচার্যের সাথে এ বাড়ির রক্তের সম্পর্ক। দূর দূরান্ত থেকে ছেলে মেয়েরা পুজো উপলক্ষে বাড়িতে আসেন । পুজো তাই এবাড়িতে একটি মিলন অনুষ্ঠান। এ বছর থেকে পুজোর দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের হাতে। তাদের উৎসাহ উদ্দীপনায় এ বছর পুজো মণ্ডপ মুখর থাকবে। ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলন হবে আধুনিকতার ।