কখনও দেখেছেন বা শুনেছেন, ডিসেম্বর মাসে দুর্গাপূজা? কিন্তু এই তথাকথিত অঘটনই ঘটিয়ে আসছেন জলপাইগুড়ি রায়কত পাড়ার পন্ডিতবাড়ির ভট্টাচার্য পরিবার। বাংলাদেশর পর জলপাইগুড়িতেও পুরোহিত-যজমান সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে গত তিন পুরুষ ধরে কাত্যায়নী ব্রতকে দুর্গোৎসব বিধানে পুজো করে আসছেন তাঁরা। পুজো উপলক্ষে চতুর্থী থেকেই আত্মীয়রা আসা শুরু করেন। গতকাল, অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর, ছিল সপ্তমী।
ঢাকা জেলার হাটাইল গ্রাম থেকে আনা ভিটের মাটি দিয়ে গড়া মা কালীর থানে পঞ্চমী তিথিতে পাঁঠাবলি দিয়ে কালীপুজো করে শুরু হয় পুজোর কাজ। এরপর মুলো ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় মহা ধূমধামের সাথে প্রতিমা এনে বিল্বমূল দিয়ে মা দুর্গাকে আবাহন করা হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত শ'তিনেক যজমান বাড়ির সাথে কয়েক হাজার এলাকাবাসী, আত্মীয়রা পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে থাকেন। দশমীর পর প্রতিমা বিসর্জন হয় না। রাখা থাকে পন্ডিতবাড়ির নাটমন্দিরে। বছরভর দুবেলা ভোগ দিয়ে পুজো হয়।
পন্ডিতবাড়ির বড় ছেলে বিল্পব ভট্টাচার্যর কাছে আমাদের প্রশ্ন ছিলো, কেন অকালে দুর্গাপূজা করেন আপনারা? এই পুজোর মূল উদ্দেশ্য কি? বিপ্লববাবু জানান, "আমরা ঢাকার হাটাইল গ্রামের আদি বাসিন্দা। পৌরোহিত্য আমাদের পেশা। বছরভর আমরা বিভিন্ন পূজা-অর্চনা, বিয়ে, মুখেভাত বা আদ্যশ্রাদ্ধ নিয়ে যজমান বাড়িতেই ব্যস্ত থাকি। শারদীয়া বা বাসন্তী কোনো দুর্গাপূজার সময় আমাদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজনদের সময় দিতে পারি না। পরিবার সূত্রে জেনেছি, অন্তত ২০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা পুঁথি ঘেঁটে হেমন্তকালে চলা কাত্যায়নী ব্রতকে দুর্গোৎসব বিধানে পুজো করা শুরু করেন।
আরও পড়ুন: ভিন রাজ্যে স্বপ্নসন্ধানের বাহন, কর্মভূমি এক্সপ্রেস
"এরপরে ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে আমার ঠাকুরদা রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও তার এক ভাই যোগেশচন্দ্র ভট্টাচার্য জলপাইগুড়ি রায়কত পাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকার পৈতৃক ভিটে থেকে মাটি নিয়ে এসে তা দিয়ে এই বাড়িতে মা কালীর ভিত স্থাপন করেন। সেখানে কালীপুজোর পর দুর্গাপুজোর কাজ শুরু করেন, যা আজও চলে আসছে। আত্মীয় সমাগমের পাশাপাশি এই পুজোর মাধ্যমে আমরা আমাদের যজমান বাড়িগুলির সাথে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করি। এই পুজো করার সেটা আর একটা উদ্দেশ্য।"
বাড়ির মেজবৌ মীরা ভট্টাচার্য জানান, "পুজো উপলক্ষ্যে বাড়ির মহিলাদের এই ক'দিন নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না। কেউ ব্যস্ত তরকারি কাটতে, কেউ আবার পুজোর সচ করতে, কেউ ফল কাটতে, কেউ আবার ভোগের রান্না নিয়ে ব্যস্ত। পাড়ার মহিলারাও হাত লাগান আমাদের সাথে।"
ব্যারাকপুরের বাসিন্দা শঙ্কর বিশ্বাস জানান, "এটা আমার পিসির বাড়ি। ছোটবেলা থেকে আমরা এই দিনটার অপেক্ষা করে থাকি। ব্যারাকপুর থেকে সবাই মিলে চলে আসি এই বাড়িতে। পুজোর ক'টা দিন গানবাজনা, খাওয়াদাওয়া, হৈচৈ করে কাটিয়ে আবার যে যার বাড়ি ফিরে যাই। যাওয়ার সময় মন ভার হয়ে যায়।"
পুজো উপলক্ষ্যে বাড়িতে এসেছেন বাড়ির মেয়ে বন্দনা বিশ্বাস। তিনি জানান, "আমাদের প্রচুর আত্মীয়স্বজন, তাঁরা সপ্তমী থেকে দশমী, এর মধ্যে কোনও না কোনও দিন আসবেনই। পুজো উপলক্ষ্যে প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে দুবেলা মিলিয়ে গড়ে ৫০০ লোক পেটপুরে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, মিষ্টি খেয়ে যান। পুজোর মূল খরচ আমরা ভাইবোনেরাই দিয়ে থাকি। এছাড়া যজমানরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।"