এখন সোশাল মিডিয়া মানেই নিজেদের স্কিল প্রদর্শনের জায়গা। কে কোনটা ভাল পারে সেই নিয়েই সর্বক্ষণ লড়াই চলছে। শহর থেকে গ্রাম এখন শুধুই নিজেদের পারদর্শিতা নিয়ে হাজির থাকছেন সকলেই। তবে দুজন মানুষের জনপ্রিয়তা কিন্তু আকাশছোঁয়া। তাঁদের বয়স কিন্তু অনেক, তবে পাল্লা দিয়ে ছোটদের টেক্কা দিতে জুড়ি মেলা ভার। পুরনো দিনের রান্নার রেসিপি, আর গ্রাম্য পদ্ধতিতে নিত্যনতুন আইটেম থেকে প্রতিদিনের খাবার - পুষ্পরানি সরকার এবং ছবিরানি বিশ্বাসের ফ্যান কিন্তু অনেকেই।
এক্কেবারে গ্রামের ফুরফুরে আমেজ, সবুজ ঘেরা চারিপাশ সঙ্গেই আগেকার দিনের মতো মাটিতে পাতা উনুন, পরিবেশটাই যেন অদ্ভুত সুন্দর। তার সঙ্গেই মনমাতানো সব খাবারের আইটেম। পুষ্প রানী দেবীর ইউটিউব চ্যানেল ভিলফুড ( Villfood ) এবং ছবিরানি দেবীর ইউটিউব চ্যানেল ট্র্যাডিস্বাদ ( Tradiswad )। এবং দুজনেই কিন্তু বেজায় জনপ্রিয়। বলা উচিত নাতি নাতনিদের জোড়াজুড়িতেই রাজি হয়ে যান সকলের সঙ্গে নিজের রেসিপি শেয়ার করতে। পুষ্পদেবীর নাতি কাজল সরকার এবং ছবিদেবীর নাতি তুষার বিশ্বাসের সঙ্গে কথোপকথনে ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করার নেপথ্যে কীরকম ভাবনা চিন্তা ছিল সেই বিষয়েই জানার চেষ্টা করেছিল দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।
ভিলফুড চ্যানেলের অন্যতম সদস্য কাজল সরকার বলেন, ছোট থেকেই মা ঠাকুমার হাতের রান্না খেয়ে বড় হয়েছেন তাঁরা। এবং গ্রাম্য এই পুরনো খাবারগুলোর রেসিপি শহর কিংবা শহরতলির অনেক মানুষ জানেন না, তাঁদের কাছ থেকে যেন এত দারুণ দারুণ রেসিপি হারিয়ে না যায়। সঙ্গেই তিনি বলেন, এছাড়াও যাতে মানুষ নতুন কিছু শিখতে পারেন। অপরদিকে, ট্র্যাডিস্বাদ এর সদস্য তুষার বিশ্বাস বলেন, আসলে ছোট ভাই সুরাজ বিশ্বাসের জেদের কাছে হার মেনে ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিলেন তিনি। সেরকমভাবে ইচ্ছে আর সময় ছিল না। অনেকে হাসাহাসি করতেন, পরেই ঠিক করলেন নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে চ্যানেলের একজন করে তুলবেন। সারাদিনে বেশিরভাগ সময়টাই এই চ্যানেলকে না দিলে পাল্লা দিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না।
এমন সুন্দর পরিবেশ এবং রান্নাঘরের ঝলক এখন শহরাঞ্চলে মেলে না। কাজল বলেন, গ্রাম বাংলায় এমন রান্নাঘর বেশিরভাগ বাড়িতে থাকে। ঋতু অনুযায়ী মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে সেগুলিকে ব্যবহার করেন। শীতকালে একটু খোলা জায়গা, রোদেলা হলে ভাল হয়, বর্ষায় চালা যুক্ত, যদিও এখন সর্বত্রই উন্নতমানের রান্নার ব্যবস্থা রয়েছে তারপরেও এটির গুরুত্ব অনেক আলাদা। নিজেদের সাফল্যের পিছনে মা ঠাকুমার কৃতিত্বই সবথেকে বেশি বলেছেন কাজল। জানান, তখন সেরকমভাবে কোনও কুকিং চ্যানেল ছিল না। হাতে গোনা কয়েকটি, ঠাকুমাকে এবং তাঁর রান্নাকে সকলেই এত ভালোবেসেছেন, সেটি ভাষায় প্রকাশ করার কথা নয়। প্রথমদিকে খুব একটা ভিউজ আসত না, তবে মন খারাপ করেননি কেউই, নিজেদের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। একসময় গিয়ে মানুষের এত ভালবাসা, উচ্ছ্বাস, ঠাকুমার প্রতি শ্রদ্ধা দেখে আজ আরও নতুন কিছু করার ইচ্ছে হয়।
ঠিক এই ক্ষেত্রে তুষারের বক্তব্য, "এমন কিছু করার ইচ্ছে ছিল যে গ্রাম্য পরিবেশে তো থাকবেই তবে অন্যরকম কিছু মানুষ দেখতে পাবেন। প্রচুর গ্রাম্য কুকিং চ্যানেল রয়েছে, তারপরেও মুড়ি ভাজার ভিডিও কোনও চ্যানেলে ছিল না, আর সেই ভিডিও থেকেই কেল্লাফতে!" ভাইরাল হয়ে যায় ভিডিওটি। ধীরে ধীরে ১০০০ জন সাবস্ক্রাইবার হয়। নানান জায়গায় সুন্দর সুন্দর রান্নাঘর বানিয়েছেন তুষার। আর যাই হোক ভিডিও বন্ধ করা যাবে না। এই জায়গায় সহজে সাফল্য আসে না। আর একবার যখন মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন সেটিকে ধরে রাখতেই হবে।
এত নিদারুণ রেসিপিগুলির ভাবনা চিন্তার দায়িত্বে কে আছেন? কোনওদিন কোনও রেসিপিটি মানুষের কাছে পৌঁছাবে সেই সিদ্ধান্ত কে নিয়ে থাকেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কাজল বলেন, "আগে শুধু মা আর ঠাকুমার কথা মতোই ঠিক হত, উনারাই রান্নার বিষয়টি ভাল বোঝেন।" তবে এখন কাজল ছাড়াও পরিবারের অন্যান্যরা তাতে অংশ নেন। তুষার জানিয়েছেন, প্রথম থেকেই মা ঠাকুমার সঙ্গে তিনিও থাকতেন। অনেক সময় মনেও করিয়ে দিতেন নির্দিষ্ট কোনও খাবার যেটি তার ভাল লেগেছিল, এইভাবেই নিজের দায়িত্বে করে চলেছেন সবকিছু।
ঠাকুমা এবং মা প্রথম থেকেই সঙ্গ দিয়েছিলেন? ভিলফুডের কাজলের স্পষ্ট উত্তর, "মা ঠাকুমাকে শুধু বলেছি রান্না করতে, আর আমি ভিডিও করব।" প্রথমে এতটা উৎসাহ না পেলেও ধীরে ধীরে যখন সাবস্ক্রাইবার বাড়ল, লোকের ভালবাসা সম্পর্কে ঠাকুমা জানলেন, তখন তাঁর আগ্রহও যথেষ্ট বেড়ে গেল। এখন নিজের ইচ্ছেতেই জোরকদমে রান্না করেন তিনি। তুষার বলেন, "ঠাকুমার এতই বয়স উনি এসব কিছুই বুঝতেন না। তাঁকে কষ্টে রাজি করিয়েছি।" ক্যামেরার সামনে আসতে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না, কথা বলতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। পরে চ্যানেলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে বিষয়টিকে একটু সহজভাবে নিতে শুরু করেন ছবিরানি দেবী। এখন অনেকটাই সাবলীল।
রমরমিয়ে চলছে দুজনের ইউটিউব চ্যানেল। অগুনতি মানুষের ভালবাসা, তাদের উচ্ছ্বাস থেকেই এতদুরের পথ অতিক্রম করেছেন দুই ঠাকুমা। কাজল বলেন, "ঠাম্মার জন্যই এত মানুষ আমাদেরকে ভালবাসেন। সকলের মন্তব্য আমাদের অনুপ্রেরণা জাগায়।" নিজেরা সময় বের করেই শুটিং থেকে এডিটিং সবকিছু করেন। ট্র্যাডিস্বাদ-এর তুষার নিজেও যথেষ্ট আপ্লুত মানুষের এত আন্তরিকতা দেখে। সারাজীবন এইভাবেই যেন মানুষ তাদের পাশে থাকে- নিজেদের সাবস্ক্রাইবার এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার পাঠকদের উদ্দেশ্যে অনুরোধ তাঁদের।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন