দৃশ্য এক: স্টেজে সিন্থেসাইজার নিয়ে বসে এক দৃষ্টিহীন কিশোর। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, তার নাম রাতুল বসাক। জন্ম থেকেই পৃথিবীকে দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি রাতুলের। কিন্তু সেটাকে সে জীবনে বাধা হতে দেয়নি কোনোদিনই।
দৃশ্য দুই: দৃষ্টিহীন এক খুদে তিথি জানা বলছে, "আমার কালী পুজো বেশি ভালো লাগে। বাজির শব্দে বুঝতে পারি কতটা আনন্দ করছে সবাই।" সৃষ্টিকর্তা চোখে দেখার সুযোগ দেননি দিশা মন্ডলকেও, সে বারবার তার বন্ধুকে অতিষ্ঠ করে তুলছে একটাই প্রশ্নে, কেমন লাগছে তাকে দেখতে।
কোনো সেলেব জগতের কেউ নয় ওরা, কোনও শিল্পতেও তারা খুব একটা পারদর্শী নয়, কারণ ওরা দৃষ্টিহীন। দৈনন্দিন জীবনই তাদের কাছে যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু মনের মধ্যে আছে আর পাঁচজনের মতই কিছু হয়ে ওঠার চেষ্টা। সেই চেষ্টাকেই সম্মান জানিয়ে, চতুর্থীর দিন বরানগরের ফকির ঘোষ লেন পুজা কমিটি মণ্ডপ উদ্বোধনের ভার তুলে দিয়েছিল তাদের হাতে।
আরও পড়ুন: ‘থিম সংগের’ দাপটে কি চাপা পড়ে যাচ্ছে ঢাকের আওয়াজ?
ওদের মধ্যে কেউ কেউ পৃথিবীটাকে একটু আবছাভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছে। সেই সুযোগের ওপর ভরসা করে থাকে আরও জনাকয়েক দৃষ্টিহীন খুদে। কাঁধে হাত দিয়ে লম্বা লাইন করে একে একে মণ্ডপে ঢুকে, ফকির ঘোষ লেন পুজা কমিটির সদস্যদের সাহায্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে উদ্ধোধন করে তারা। যাদের অল্প দৃষ্টিশক্তি আছে, তারা সম্পূর্ণ চোখে দেখতে না পাওয়া বন্ধুকে বর্ণনা করে দিচ্ছে প্রদীপের আলো কতটা উজ্জ্বল, ফকির ঘোষ লেনের প্রতিমার মুখের আদল কতটা সুন্দর, কত লোক জমায়েত হয়েছে, এই সমস্তটাই। যাতে তার দৃষ্টিহীন বন্ধুটিও সাক্ষী থাকে এই সুন্দর মূহুর্তের। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ওরা বোঝার চেষ্টা করেছে তাদের নিয়ে কতটা সুন্দর দুর্গাপুজার এই চতুর্থীর মূহুর্ত।
এদিন তারা মনের চোখ দিয়ে কিভাবে দুর্গাপুজো উপভোগ করে তার বার্তা দিয়ে গেল গীতিনাট্যের মাধ্যমে। হ্যাঁ, গান নাচ সবকিছুর মাধ্যমে জানিয়ে দিল তাদের দেখা ছবির বর্ণনা।
আমরা সাধারণত টলিপাড়া বা রাজনৈতিক মহলের চেনা মুখ নিয়ে এসে মণ্ডপ উদ্ধোধনের নজির দেখে থাকি। ফকির ঘোষ লেনের সম্পাদক রবিন চৌধুরী ও দেবব্রত পাল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, "একটি মূল্যবান ইন্দ্রিয় ওদের নেই। শুধুমাত্র অন্ধকার জীবনটাকে একটু রঙীন করে দেওয়ার চেষ্টাই করেছি আমরা। কোণঠাসা জীবন থেকে নিয়ে এসে দুর্গাপুজোর আনন্দ দিতে এবং তাদের প্রতিকূলতা জয় করার চেষ্টাকে সম্মান জানাতে ফকির ঘোষ লেনের তরফ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।"
তাঁরা আরও বলেন, উত্তরপাড়ার লুই ব্রেল মেমোরিয়াল স্কুল থেকে ওদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়। ওদের যখন জামাকাপড় দেওয়ার কথা ওঠে, ওরা নিজেরাই জানায়, "আমাদের চিপ মেশিন Audio System Caravan লাগবে।" এই মেশিনে ওরা রেকর্ড করে রাখতে পারবে পড়াশোনার যাবতীয় খুঁটিনাটি। এদিন ওই খুদেদের সঙ্গে এসেছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা অনামিকা সাহা। যিনি নিজেও একজন দৃষ্টিহীন মানুষ। তিনি বলেন, "এই মেশিন তাদের সহায়িকা বই পড়তে সাহায্য করবে।" ফকির ঘোষ লেনের পুজা কমিটির সদস্যরা তাই ফেলতে পারেন নি তাদের এই আবদার। এদিন চারটি মেশিন তুলে দেওয়া হয় তাদের হাতে।