শাস্ত্রে দেবীর মদ খাওয়ার কথা সরাসরি কোথাও বলা নেই। আসলে দেবী মহিষাসুরকে বধের সময় বলেছিলেন, 'গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম, ময়া ত্বয়ি হতেহত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।' যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়- 'রে মূঢ়, আমি যতক্ষণ মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। তারপর আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা শীঘ্রই এখানে গর্জন করবেন।'
চণ্ডীতে দেবীর মুখ দিয়ে বর্ণিত এই 'মধু' আসলে সংস্কৃতে মদের প্রতিশব্দ। প্রকৃতপক্ষে বৈষ্ণবদের পঞ্চগব্য (দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, গোমুত্র, গোময়)-র মতই শাক্তদের পুজোর অঙ্গ মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন। অনেক পণ্ডিত অবশ্য মনে করেন যে, শাক্তদের এই পঞ্চ 'ম'-এর মধ্যে মদ কেবল কোনও পানীয় নয়। এটি আসলে ব্রহ্মরন্ধ থেকে গড়িয়ে আসা অমৃতধারা। তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে সাধকের কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে মস্তিষ্কের উপরিভাগ বা ব্রহ্মরন্ধ খুলে যায়। তখন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, সেটাই আসল মদ বা কারণসুধা।
কথিত আছে, মদ্য সহযোগে তন্ত্রসিদ্ধ পূজা পদ্ধতি বঙ্গদেশে প্রচলন করেছিলেন মহামুনি বশিষ্ঠদেব। তিনি বহু বছর তপস্যা করেও সিদ্ধিলাভ করতে পারেননি। এরপরই তিনি ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশে তিব্বতে রওনা দেন। সেখানে দেবী তারার উপাসনা পদ্ধতি আয়ত্ত করেন। সেখানই বশিষ্ঠদেব পঞ্চ 'ম'-কার বা মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন-সহযোগে দেবী আরাধনার পদ্ধতি আয়ত্ত করেন। পরবর্তী সময়ে তন্ত্রসাধনার সেই পদ্ধতিই বশিষ্ঠদেব নিয়ে আসেন এই বঙ্গে।
আরও পড়ুন- কীভাবে জন্ম হল দেবী কালীর, কেন তিনি রক্তপান করেছিলেন? পুজোর নির্ঘণ্ট
ব্রহ্মযামল তন্ত্র অনুযায়ী, বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কালী। এই বঙ্গে আট রূপে দেবী কালীর আরাধনা করা হয়। তার মধ্যে দেবীর দক্ষিণাকালী রূপই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। তিনি রক্তপানকারিণী। আর সিদ্ধকালী খড়্গ দিয়ে চন্দ্রে আঘাত হানেন। তা থেকে নিঃসৃত অমৃত পান করে দেবী তুষ্ট হন। আটটি রূপের মধ্যে কেবলমাত্র শ্মশানকালীর পূজাতেই মদ বা কারণবারির ব্যবহার চালু রয়েছে।
সেই সূত্র ধরে পরবর্তী ক্ষেত্রে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তাঁর বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে শ্মশানকালীর যে রূপ বর্ণনা করেছেন, তাতে মদের কথা আছে। বৃহৎ তন্ত্রসার অনুযায়ী শ্মশানকালীর বাঁ হাত মদ ও মাংসে ভরা। দেবীর গায়ে নানা অলঙ্কার থাকলেও তিনি উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠছেন। আবার বিন্ধ্যবাসিনী দেবী চামুণ্ডার পূজায় বলি এবং মদ উৎসর্গের প্রথা ছিল। সেসব থেকেই শ্যামাকালীর পূজায় মদ বা কারণবারির প্রচলন হয়েছে।