পৃথিবী জুড়ে কেন হেমন্তেই হয় মৃত্যু-উদযাপন?

লাতিন আমেরিকা, থেকে ইউরোপ, ভারত, দক্ষিণ এশিয়া, সব অঞ্চলের ধর্মীয় বিশ্বাসেই রয়েছে এক অতীতের ফিরে ফিরে আসা। সব সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস, এই সময়ে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা ঘুরে ফিরে বেরান আমাদের মাঝেই।

লাতিন আমেরিকা, থেকে ইউরোপ, ভারত, দক্ষিণ এশিয়া, সব অঞ্চলের ধর্মীয় বিশ্বাসেই রয়েছে এক অতীতের ফিরে ফিরে আসা। সব সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস, এই সময়ে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা ঘুরে ফিরে বেরান আমাদের মাঝেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

২ নভেম্বর। সারা পৃথিবীর মৃতজনেরা কয়েক লক্ষ মানুষকে এক সঙ্গে নিয়ে আসে, কোনও ধারণা রয়েছে? এখন অবশ্য অনেকেই জানি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটায় পালন করেন 'অল সোলস ডে'। পরিবারের সদস্য অথবা নিকটাত্মীয়, যাদের সঙ্গে চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটেছে, দিনটিতে তাঁদের স্মরণ করা হয়।

Advertisment

আমাদের দীপাবলির মতোই দিনটা। যদিও আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই দু'টো উদযাপনের মধ্যে কোনও মিল পান না। অথচ দু'টো দিনের মাঝে তো মাত্র ক'টা দিন। আর সারা পৃথিবীতে হেমন্তেই কেন মৃতদের স্মরণ করা হয়, সেটাও তো বুঝতে হবে। কেন এই সময়েই জীবিত এবং মৃতের মধ্যে দূরত্বটা কমতে কমতে একটা সুতোর মতো হয়ে ওঠে?

আরও পড়ুন, মৃত্যু যখন জীবনে ফেরায়

লাতিন আমেরিকা, থেকে ইউরোপ, ভারত, দক্ষিণ এশিয়া, সব অঞ্চলের ধর্মীয় বিশ্বাসেই রয়েছে এক অতীতের ফিরে ফিরে আসা। সব সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস, এই সময়ে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা ঘুরে ফিরে বেরান আমাদের মাঝেই।

Advertisment

আরও পড়ুন, কোথায় গেল আকাশ প্রদীপ?

প্রাচ্যের মার্কন্ডেয় পুরান বলে পিত্রু অর্থাৎ পূর্ব পুরুষ তাঁর শ্রাদ্ধাচারে সন্তুষ্ট হয়ে উত্তরসূরির দীর্ঘায়ু, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সমৃদ্ধি কামনা করেন। আবার পাশ্চাত্যের ফরাসী ঔপন্যাসিক মারগুয়েরিট ইওরসেনার বলেছিলেন, "পূর্বপুরুষদের স্মরণের এই অনুষ্ঠান পৃথিবীর আদিতম উদযাপন। শস্য তোলা হয়ে গেলে ফাঁকা ফসলবিহীন মাঠে আত্মারা শুয়ে থাকেন, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সময়ে হয় স্মৃতির উদযাপন।

২ হাজার বছর আগে রোমানদের মধ্যেও একটা উৎসবের প্রচলন ছিল-'লেমুরিয়া'। মৃতজনেদের কবরে গিয়ে কেক এবং ওয়াইন ভাগ করে নিতেন রোমানরা। পেগান ধর্মের এই রীতিই পরে আপন করে নেন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা।

হিন্দু পুরানে আমাদের পূর্ব পুরুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ শুরু হয় মহালয়াতে। দীপাবলি উদযাপন পর্যন্ত নিবিড় থাকে বর্তমান আর অতীতের যোগাযোগ।

আরও পড়ুন, ভূত চতুর্দশীতে কেন জ্বলে চৌদ্দ প্রদীপ? খেতে হয় কোন কোন শাক?

বাংলা, আসাম এবং ওড়িশায় যে কালী পুজো হয়, তার সঙ্গেও রয়েছে মৃতদের জড়িয়ে থাকা। কালী পুজোর আগের দিন ভূত চতুর্দশীতেও স্মরণ করা হয় পূর্বজদের। এই দিন ১৪ রকমের শাক খাওয়ার চলও রয়েছে অনেক জায়গাতেই। আর ভাইফোঁটা তো আসলে যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়ার উদযাপন।

বেশি নয়, দু-তিন দশক আগেও কার্তিক মাস পড়লেই সন্ধে হলে বাংলার ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত আকাশ প্রদীপ। হেমন্তের বুক ঝিম করা ভাব, মন কেমন, উত্তরে হাওয়ার কাছে আসতে থাকা, দিন ছোট হয়ে আসা, ভোর বেলা ঘাসের আগায় জমে থাকা শিশির, সবের সঙ্গে মিশে আছে দিন ফুরোলে বাড়ির চাল অথবা ছাদের ওপর বাঁশের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া একটা প্রদীপ। আকাশ প্রদীপ। গ্রাম বাংলার বড় চেনা ছবি ছিল আকাশ প্রদীপ।

হিন্দু পুরাণ মতে আশ্বিন মাসের অমাবস্যায় মহালয়ার দিন পূর্ব পুরুষকে উদ্দেশ্য করে তর্পণ করা হয়। তার পরের একটা মাস মৃত পূর্ব পুরুষেরা ধরাধামে আসেন। থেকে যান আমাদের সঙ্গে। আনন্দ উৎসব উদযাপনে শামিল হন ক’টা দিন। কালী পূজার অমাবস্যায় তাঁদের ফিরে যাওয়ার পালা। ফিরে যাবেন পরলোকে। কে পথ দেখাবে তাঁদের? তাই আকাশ প্রদীপ জ্বেলে রাখা রাতভর। এই সংস্কৃতিতে বারবার ফিরে এসেছে অতীতের কাছে ফিরে যাওয়া। অতীত মানে স্মৃতি। প্রাচ্য দর্শণ সবসময় স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আর সেই শ্রদ্ধা মিশে রয়েছে, যত্ন মিশে রয়েছে ওই সাঁঝবেলায় জ্বালিয়ে রাখা আকাশ প্রদীপে।

আরও পড়ুন, খিদিরপুরের মুন্সীগঞ্জ, এক চাঁদাতেই পুজো-মহরম

উত্তর প্রদেশে কার্তিক পূর্ণিমার দিন উদযাপিত হয় দেব দীপাবলি। এ তো গেল আমাদের দেশের কথা। সুদূর মেক্সিকো তে ২ নভেম্বর পালিত হয় এল দিয়া দ্যা লস মুয়েরতস। খ্রিষ্ট ধর্মের জন্মের অনেক আগে থেকে উদযাপিত হত এই অনুষ্ঠান। এও মৃত পূর্বপুরুষের উদ্দেশে। নানা রঙের পোশাকে আসলে আত্মার নানা রূপ তুলে ধরা হয় এই উৎসবে। এদের বিশ্বাস, আত্মারা এই সময় প্রিয়জনদের ঘরেই থেকে যান। তাই ঘরের বাইরে ফেলে ছড়িয়ে রাখা হয়, খাবার, পানীয়, নানা উপহার।

ব্রাজিলে দিনটি উদযাপিত হয় ফিনাদোস হিসেবে। কম্বোডিয়ায় চুম বেন পালিত হয় মাস খানেক আগে। চিন, সিঙ্গাপোরে 'মন্থ অব হাংরি ঘোস্টস' হিসেবে পালিত হয়। সেপ্টেম্বরে কোরিয়ায় চুসিয়কের উদযাপন হয়। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের হয় সব-এ-বরাত।

সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মোটামুটি একই সময় উৎসর্গ করে দেওয়া হয় অতীতকে। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মানুষ যখন হারিয়ে যাওয়া সময়কে উদযাপন করতে পারে হাতে হাত রেখে, তবে বর্তমানকে পারবে না কেন? কেন একটু শান্তি বিরাজ করবে না এই আনন্দলোকে?