তাঁদের ক্ষেত্রে আজ নতুন জীবনের সপ্তম বর্ষ পূর্তি। কোচবিহারের এক দম্পতির অমোঘ প্রেমকে ভালোবাসার দিনে স্যালুট জানালো গোটা উত্তরবঙ্গ। ভ্যালেন্টাইন্স ডে'তে সাধারণত প্রথা মেনে প্রিয়জনকে কেউ উপহার দেন লাল গোলাপ, কেউ বা চকলেট, কেউ হীরের গহনা। কিন্তু ক'জন প্রিয়জনকে বাঁচাতে সমর্পণ করেন জীবনের সেরা সম্পদ? এই অভিনব উপহারের দৌলতেই আজ থেকে সাত বছর আগে স্বামীকে অঙ্গদান করে আজও তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন কোচবিহারের শিখা পাল।
এ এক অন্য ভালবাসার গল্প। ভ্যালেন্টাইন্স ডে ২০১৯-এ সাত বছর আগের উপহার, স্ত্রীর প্রদত্ত কিডনি নিয়ে নতুনভাবে সপ্তম বার ভ্যালেন্টাইন্স ডে দেখলেন বীরেশ পাল। তবে পেশায় ব্যবসায়ী পাল দম্পতি শুধু কিডনি দানেই থেমে থাকলেন না। এবারে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারও করলেন।
শিখা দেবী জানান, তিনি কোচবিহার রেল গুমটি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। আজ থেকে ৩০ বছর আগে কোচবিহারেরই গুঞ্জবাড়ি এলাকার বাসিন্দা বীরেশবাবুর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। এরপরে আর দশজন গৃহবধূর মতোই এক মেয়ে নিয়ে সংসার ধর্ম পালন করে আসছিলেন। ২০১১ সালে ঘটে ছন্দপতন। দীর্ঘদিনের ব্লাড সুগারের রোগী বীরেশবাবুর দুটি কিডনিই ফেল করতে শুরু করে। চিকিৎসার জন্য তাঁরা ছুটে যান কলকাতায়। শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে শুরু হয় ডায়ালিসিস, কিন্তু চিকিৎসকরা জানান, এভাবে বেশিদিন চলবে না। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে, প্রয়োজন ও-পজিটিভ দাতার।
আরও পড়ুন: ‘প্রথমবার স্বাধীন প্রেমের ভ্যালেন্টাইন্স ডে’! সত্যিই?
শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে শিখা দেবীর। শুরু করেন কিডনি দাতার খোঁজ। তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে একজনকে খুঁজেও পান। কিন্তু চেক আপের পর সেই দাতার শারিরীক সমস্যা থাকায় তাঁকে বাতিল করে দেন চিকিৎসকরা। শিখা দেবীর কথায়, "ডোনর বাতিল হয়ে যাবার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই যে আমিই কিডনি দান করব। গোপনে রক্ত-সহ বিভিন্ন পরীক্ষা করাই। জানতে পারি আমি নীরোগ এবং কিডনি দানে সক্ষম। এরপর ২০১২ সালের ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে আমার একটি কিডনি নিয়ে আমার স্বামীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। সেদিন ছিল আমার জীবনের সেরা দিন।"
কিডনি দানে বাধা দিয়েছিলেন অনেকেই, কান দেন নি শিখা দেবী। "আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকি। আমি সম্পুর্ন ফিট আছি। এখন আমিই বাজারহাট সব করি। পাশাপাশি আমি অনেককে কিডনি দান নিয়ে সচেতনও করি। তাদের সাহস যোগাই। এখনো নার্সিং হোম থেকে মাঝেমধ্যে ফোন আসে। আমি অনেককে মোটিভেশন দিয়ে থাকি।"
বীরেশবাবু জানান, "২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আমার স্ত্রীর কিডনি দানের ফলে আমি সাক্ষাৎ যমের দুয়ার থেকে ফিরে আসি। ওকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই আমার। অপারেশনের কয়েকদিন পর আমাকে ডাক্তারবাবুরা জানান, আমি সুস্থ, কিন্তু নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। এক ডাক্তারবাবু আমাকে প্রশ্ন করেন, 'স্ত্রী তো আপনাকে কিডনি দিলেন, আপনি রিটার্ন গিফট হিসেবে কী দেবেন?' উত্তরে আমি বলি, লাল রঙের ইন্ডিকা গাড়ি উপহার দেব। স্ত্রীকে আমার মনের কথা জানালে ও বলে, 'তুমিই আমার ইন্ডিকা। আমার আর কিছু চাই না।' কিছুতেই গাড়ি কিনতে দিল না।"
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভলান্টারি ব্লাড ডোনরস অর্গানাইজেশনের সম্পাদক রাজা বৈদ্য জানান, "আমরা জানতে পারি ওঁরা মরণোত্তর দেহদানে আগ্রহী। খবর পাওয়ামাত্র আমরা ছুটে যাই। আমাদের কাছ থেকে দেহদান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর ওঁরা দেহদানের অঙ্গীকার করেন। আমরা দ্রুত অফিশিয়াল কাজকর্ম সেরে ফেলব। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত আগামী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে। আজ প্রেম দিবসে এহেন দম্পতিকে আমরা সমগ্র কোচবিহারবাসী ও আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কুর্নিশ জানাই।"