Advertisment

"আমাদের মতো মানুষরা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে চান না"

"পার্ক হোটেলে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম, রূপান্তরকামী বলে ইন্টারভিউ নেওয়া হয়নি। ভবানীপুরেও আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়নি। আমাদের মতো মানুষরা কাজ চান। কেউ সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে চান না।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
women's day, pallabi, নারী দিবস, পল্লবী

দেশের প্রথম রূপান্তরকামী গ্রিন পুলিশ পল্লবী চক্রবর্তী। ছবি সৌজন্যে: পল্লবী।

"তুই একটা ছেলে, ছেলের মতো থাকবি। গোঁফ রাখবি, বুক ফুলিয়ে ঘুরবি, স্মার্ট হবি একটু...।" কিন্তু বাবার সেই 'ইচ্ছে' কখনই পূরণ করতে পারেন নি তিনি। গোঁফ তো দূর অস্ত, শার্ট-প্যান্ট পরতেও চাইত না তাঁর 'নারী' মন। ছেলেবেলায় গামছা দিয়ে চুল বাঁধতেন তিনি। কখনও বা মায়ের শাড়ি-ব্লাউজ পরে আয়নার সামনে নিজেকে নারী হিসেবে দেখে তাঁর চোখ জুড়িয়ে যেত।

Advertisment

‘ব্যাটাছেলে’র চেহারা তাঁর, 'মেয়েছেলে' হবেন কীভাবে? এ সমাজ কি তাঁকে মেনে নেবে? এ প্রশ্নই রাতের পর রাত তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়েন নি। তিন-তিনবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু মৃত্যুও তাঁর কাছে হার মেনেছে। ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করার সাহস দেখিয়ে আজকের নারী দিবসে তিনিও এক 'নারী' হয়ে উঠেছেন। পল্লব থেকে তিনি আজ পল্লবী চক্রবর্তী, দেশের প্রথম রূপান্তরকামী গ্রিন পুলিশ। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে নারী দিবসে শোনালেন তাঁর ঘাত প্রতিঘাতের কাহিনী...

দেশের প্রথম গ্রিন পুলিশ! এটা তো একটা নজির...

হ্যাঁ, গ্রিন পুলিশের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলাম। রূপান্তরকামী হিসেবেই আবেদন করেছিলাম। কলকাতা পুলিশের সাউথ ডিভিশনে পার্ক স্ট্রিটে পরীক্ষা দিই। তারপর তো চাকরিটা পেয়ে গেলাম। দেশের প্রথম রূপান্তরকামী গ্রিন পুলিশ আমি।

কোন থানায় পোস্টিং?

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রিন পুলিশ হিসেবে কাজে যোগ দিলাম। ময়দান থানায় রয়েছি এখন। অনেক কষ্ট করে পেয়েছি চাকরিটা, নিজের যোগ্যতায় পেয়েছি। তাই এই অনুভূতিটা অন্যরকম।

কর্মক্ষেত্রে কোনও টিটকিরি, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ শুনতে হয়?

এক সহকর্মী ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো এবার বিকলাঙ্গদেরও সিভিক পুলিশের চাকরি দেবেন। এও বলতে শুনেছি যে, এবার থেকে সিভিক আইপিএস নেবে। খুব অবাক লাগে এসব শুনে। ওঁদের শিক্ষার বড় অভাব।

women's day, pallabi, নারী দিবস, পল্লবী তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন পল্লবী। কিন্তু হাল ছাড়েননি। ছবি সৌজন্যে: পল্লবী চক্রবর্তী

আরও পড়ুন, ‘প্রথমবার স্বাধীন প্রেমের ভ্যালেন্টাইন্স ডে’! সত্যিই?

পুলিশেই কি চাকরি করতে চেয়েছিলেন?

আমি আসলে শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যাই হোক, কাজটা পেয়েছি, তাই ভালবেসে করব। আসলে কাজটা কাজই, সে যে কাজই হোক না কেন।

আপনি তো কলকাতার প্রথম রূপান্তরকামী গাড়িচালক?

হ্যাঁ, দু’বছর গাড়ি চালিয়েছি। ড্রাইভিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। স্নাতক হওয়ার পর 'প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট' সংগঠনের উদ্যোগে ড্রাইভিং শিখি। কিন্তু গাড়িচালক হিসেবেও কাজ পেতে খুব সমস্যা হয়েছিল। রূপান্তরকামী বলে আমায় কাজ দেওয়া হত না। পার্ক হোটেলে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম, রূপান্তরকামী বলে ইন্টারভিউ নেওয়া হয় নি। ভবানীপুরেও আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হয় নি। আমাদের মতো মানুষরা কাজ চান। কেউ সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে চান না।

আরও পড়ুন, নারীদিবস ও মি টু আন্দোলনের তাৎপর্য

ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে বাছলেন, বাড়িতে কেউ আপত্তি করেননি?

না, আমি আসলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। তাই হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিলাম। সুযোগ পেলাম তাই ছাড়ি নি। তাছাড়া আমাকে নিয়ে আমার বাড়ির লোকের কোনও হেলদোল ছিল না।

তার মানে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে তো?

হ্যাঁ, তা তো বটেই। আমার জীবনে স্ট্রাগলটা অন্যরকম। অনেক সময় লেগেছে স্বপ্ন পূরণ করতে। বহু কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করেছি। ক্লাস টু-তে যখন পড়ি, তখন প্রথম মনে হত, যে আমি এক নারী। কিন্তু সেসময় আমার নারীসত্ত্বা প্রকাশ করতে পারি নি। সমাজের কাছে এই পরিচয় দিতে পারি নি। আমি একজন ছেলে, কিন্তু মনে মনে নিজেকে নারী হিসেবে ভাবতাম। আমার কখনও নিজেকে ছেলে মনে হতো না। সবসময় মেয়ে মনে হতো। মানসিক দ্বন্দ্ব চলত আমার। খুব অবাক হতাম। শরীরের সঙ্গে মনের লড়াই শুরু হল এরপর।

women's day, pallabi, নারী দিবস, পল্লবী কলকাতার প্রথম রূপান্তরকামী গাড়িচালকও পল্লবী। ছবি সৌজন্যে: পল্লবী চক্রবর্তী

আরও পড়ুন, আন্তর্জাতিক নারী দিবস কি শ্রম দিবস হিসেবেও পালিত হয়?

তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন?

(দীর্ঘশ্বাস ফেললেন) খুব কষ্টের জীবন ছিল। কেউ আমায় মেনে নেয়নি, কী বাড়ির লোক, কী সমাজ। খুব একা লাগত। একটা সময় বাধ্য হয়ে তিন-তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম, লুকিয়ে বাঁচব না। আমি যেমন, তেমন ভাবেই বাঁচব। তারপর থেকেই নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই শুরু করলাম।

শার্ট-প্যান্টের থেকে শাড়ি পরতে বেশি ভালবাসত তখনকার পল্লব?

বাড়িতে মায়ের শাড়ি-ব্লাউজ পরতাম, টিপ পরতাম। পিসির মেয়েরা এলে, ওদের জুতো পরতাম। এ নিয়ে বাড়িতে খুব ঝামেলা হতো। তখন থেকেই বাঁচার লড়াই শুরু হলো। বুঝলাম যে নিজের মতো করে বাঁচতে পারব না। তিন-তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম। বাবা বলত, "তুই ছেলে, ছেলের মতো থাকবি। গোঁফ রাখবি, বুক ফুলিয়ে ঘুরবি, স্মার্ট হবি একটু।" কিন্তু আমি মহিলাদের পোশাক পরতে চাইতাম।

আজ তো পরিবার আপনার পাশে। এখন কী বলেন বাবা-মা?

(তৃপ্তির সুরে) এখন তো বাবা আমার ছবি দেখিয়ে সবাইকে বলে, এটা আমার মেয়ে। এখন তো সবাই মেনে নিয়েছে।

আজকের নারী দিবসে আপনিও এক নারী!

খুব রঙিন মুহূর্ত এটা। আমি মনে করি, জন্মগতভাবে নারী বলেই সে নারী, আর রূপান্তরকামী বলে নারী নয়, এটা ঠিক নয়। আমি একজন সফল রূপান্তরকামী নারী। তবে আমাদের মতো মানুষকে নিচু চোখে দেখা, অবহেলা করা, এসব না করে সম্মান জানালে কোনও একটা নির্দিষ্ট দিন নয়, প্রতিটি দিনই নারী দিবস হয়ে উঠবে, প্রতিটি দিনই সুন্দর হবে।

gender equality Women's Day
Advertisment