বিয়েবাড়িতে মহিলাদের "বাড়াবাড়ি" সাজের পাশে "ম্রিয়মাণ" পুরুষদের দেখে করুণা হতো তাঁর। মনে হতো, ওঁদের পোশাকও কেন আরেকটু রঙচঙে হতে পারে না? কেন আরও একটু বৈচিত্র্য আসতে পারে না তাতে? সেই অভাববোধ থেকেই যাত্রা শুরু 'মেনসওয়্যার ডিজাইনার' শর্বরী দত্তের। মূলত আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের জন্য একেবারেই ঘরোয়াভাবে পোশাক ডিজাইন করা দিয়ে শুরু, ১৯৯১ সালে। তার পরের তিন দশকে 'ব্র্যান্ড শর্বরী' হয়ে উঠেছে ভারতের এবং বিশ্বের ফ্যাশন মানচিত্রে রীতিমতো ওজনদার নাম, যে ব্র্যান্ডের অনুরাগীদের মধ্যে রয়েছেন শচীন তেন্ডুলকর বা কপিল দেবের মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে প্রয়াত এম এফ হুসেন অথবা গণেশ পাইনের মতো কিংবদন্তী শিল্পী।
বছর দুয়েক আগে পারিবারিক ঝড়ঝাপটা অতিক্রম করে 'শূন্য' থেকে ফের শুরু করেন শর্বরী, সঙ্গে বিজনেস পার্টনার রেশমি বাগচি। দুজনের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে নতুন ব্র্যান্ড 'শূন্য', যার 'ক্রিয়েটিভ' দিকটা আজও শর্বরীরই দায়িত্বে। সাম্প্রতিককালে মহিলাদের ফ্যাশনের জগতেও পা রেখেছেন তিনি, তবে আজও সম্ভবত শর্বরীই ভারতের একমাত্র মহিলা ডিজাইনার, যাঁর কর্মক্ষেত্র মূলত পুরুষদের ফ্যাশন।
শর্বরী নিজে অবশ্য 'ডিজাইনার' কথাটা পছন্দ করেন না। বরং তাঁকে 'রিভাইভালিস্ট' বললে বেশি খুশি হন। "আমি যা যা সৃষ্টি করেছি, তার কোনোটাই কিন্তু অজানা নয়, বা আমার আবিষ্কার নয়। এ সবই আমাদের ঐতিহ্যের অঙ্গ, আমি 'রিভাইভ' করেছি মাত্র," পূর্ণদাস রোডে 'শূন্য'র দোতলার কাচঢাকা ঘরে বসে বলছিলেন শর্বরী। "তবে আমি ট্রেন্ড ফলো করি না, ট্রেন্ড তৈরি করি। ১৯৯১-তে যখন ভারতীয় পুরুষদের জন্য ট্র্যাডিশনাল বা এথনিক পোষাক বানাতে শুরু করেছিলাম, তখন কোনও ধারণাই ছিল না যে ডিজাইনারের কাজ করছি। এবং পুরুষদের ফ্যাশনের আদৌ কোনও বাজার আছে কিনা, তাও ভাবি নি। অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছিলাম।"
বাস্তবিক, বাঙালিদের মধ্যে তখন ভারতীয় পোশাক পরতেন মূলত বয়স্ক পুরুষরা, অল্পবয়সীদের কাছে 'ফ্যাশন' মানেই ছিল পশ্চিমী পোশাক। সেই আবহে শর্বরীর রঙিন ধুতি-পাঞ্জাবি যেন এক ঝলক তাজা বাতাসের মতো এসে লেগেছিল বঙ্গের পুরুষকুলের গায়ে। তবে তখনও ডিজাইনার হওয়ার কোনও ভাবনাচিন্তাই ছিল না শর্বরীর মনে। রবীন্দ্রোত্তর যুগের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক-কবি-অধ্যাপক অজিত দত্তের কন্যা শর্বরী ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শনের ছাত্রী। কলেজে থাকতে থাকতেই বিয়ে, তারপর মন দিয়ে সংসার। শিক্ষা-সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা সেই মেয়ের ইচ্ছে ছিল, অধ্যাপক হবেন।
তাঁর পোশাকের প্রথম প্রদর্শনী করেন কিছুই না জেনে। হেসে বলেন, "আজকাল তো কেউ একটা মাটির পুতুল বানালেও মিডিয়াকে ডাকে। আর আমি জানতামই না যে প্রচার করতে হবে। তবু বন্ধুবান্ধবদের মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়ায় আমার সব পোশাকই বিক্রি হয়ে গেল। হলো না শুধু গোটা তিনেক রঙিন ধুতি। সবাই ভাবলেন শাড়ি! বড্ড মেয়েলি মনে হলো সবার।"
কিন্তু সেসব বদলে গেল শর্বরীর উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত 'পুরুষোৎসব'-এর দৌলতে। যেখানে শর্বরীর রঙিন ধুতি পরে 'ক্যাটওয়াকে' হাঁটলেন ভারতের নামীদামী পুরুষ মডেলরা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীকালের বলিউড অভিনেতা জন আব্রাহাম। তার পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি বড় একটা। স্রেফ অভিনবত্ব, নিজস্বতা, এবং শৈল্পিক ভাবনার জোরে ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠল পায়ের তলার মাটি।
আজ তাঁর গ্রাহক তালিকায় নেই, এমন বিখ্যাত পুরুষ ভারতে (এবং অনেক ক্ষেত্রে ভারতের বাইরেও) কমই আছেন, কিন্তু আজও শর্বরীর মনে আছে সেই দিনটা, যেদিন এম এফ হুসেন যেচে তাঁর পোশাক কিনতে এসেছিলেন। "আমি আমার কাজটাকে শিল্প হিসেবেই দেখি, তাই এম এফ হুসেন, গণেশ পাইন, পরেশ মাইতি, মনজিত বাওয়া, বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো শিল্পীরা যখন আমার কাজের প্রশংসা করতেন, মনটা ভরে যেত," বলেন শর্বরী।
আজও ভারতের ঐতিহ্যকে মাথায় রেখেই কাজ করে চলেছেন শর্বরী। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে আফ্রিকার লোকশিল্প, বা প্রাচীন মিশরের কারুকার্য, বা পিকাসো, বা প্রাচীন মেক্সিকোর শিল্পও। "আমাদের দেশে হাজার হাজার বছর আগের পুরুষদের পোশাকের কথা ভাবো। কী সৌন্দর্য, কত বৈচিত্র্য, কতরকম রঙ। এতে মেয়েলি ভাবের প্রশ্ন কোথায় আসছে?" কিঞ্চিৎ উত্তেজিত ভাবেই বলেন তিনি। "কে বলে দিয়েছে যে পুরুষ মানেই তাঁকে কালো বা নেভি ব্লু বা গ্রে স্ট্রাইপ অথবা চেকই পরতে হবে? এগুলো সব ভিক্টোরিয়ান যুগের প্রভাব, যার কোনও ভিত নেই আমাদের দেশে। আমি পশ্চিমী পোশাকের বিরোধিতা করি না, কিন্তু ঠিক যেমন আমরা মেয়েরা ইচ্ছেমতো ভারতীয় অথবা পাশ্চাত্য পোশাক পরি, তেমনি পুরুষরাও পরবেন।"
সুতরাং নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে 'সাম্যের গান' গেয়ে চলেছেন শর্বরী। "আজ যখন কোনও পুরুষের গায়ে কচি কলাপাতা বা তুঁতে রঙের শার্ট দেখি, ভেবে তৃপ্তি পাই যে এর পেছনে কিছুটা হলেও আমার অবদান আছে। পুরুষদের পছন্দ খুব নির্দিষ্ট ধরনের, মেয়েদের মতো চট করে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চান না, কিন্তু আমি যে এত মানুষকে অন্যভাবে ভাবাতে পেরেছি, এতেই আমার সার্থকতা।"