গৃহপ্রবেশের তখন আর আধঘণ্টা মতো সময় বাকি। তার আগেই নিজেদের নতুন ঘর পেয়ে আহ্লাদে আটখানা রানি ও তিতি। একজন তো নতুন ঘরে দাঁড়িয়ে শুঁড় নাড়ছিল, আরেকজন এমন ভাবে দাঁড়িয়েছিল, যেন অপেক্ষা করছিল কখন মন্ত্রীমশাই এসে ফিতেটা কাটবেন। রানি-তিতির দেখভাল যাঁরা করেন, অন্য দিনের তুলনায় তাঁদের এদিন ব্যস্ততা একটু বেশি ছিল। গৃহপ্রবেশ বলে কথা, আর যাদের গৃহপ্রবেশ তাদের রেডি করতে হবে তো! মন্ত্রীমশাইয়ের সামনে তাদের সাজুগুজু করে দাঁড় করাতে হবে তো। ওরা তো বাচ্চাই, একজনের বয়স ৫, অন্যজন সবে ৩-এ পা দিয়েছে। রানির থেকে দু’বছরের বড় তিতি। আর তো কেউ নেই, নতুন ঘরে খেলে বেড়াবে ওই দু’জনই।
সালটা ২০১৪, সে বছর নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ নাগাদ উত্তরবঙ্গ আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয় ওই দুই হস্তিনীকে। কেটে গেছে ৪ বছর। এতদিন বাদে নিজেদের থাকার জন্য ঝকমকে ঘর পেল ওই দুই খুদে হস্তিনী। বিশ্ব হাতি দিবসে রানি ও তিতির সেই সাধের ঘরের গৃহপ্রবেশ হল, থুড়ি উদ্বোধন হল মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের হাত ধরে। পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণও। রীতিমতো ঘটা করে ফিতে কেটে আলিপুর চিড়িয়াখানায় উদ্বোধন হল নবরূপে হাতিঘরের।
ঘর হো তো অ্যায়সা...হ্যাঁ, একথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। আলিপুর চিড়িয়াখানায় আগেও হাতিদের ঘর ছিল। কিন্তু সেই ঘরের স্থান যেমন বদলেছে, তেমনই আকারে-আয়তনও ভোল পাল্টেছে। কী রয়েছে নতুন হাতিঘরে? দুটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। বাহারি রঙ দিয়ে যেন ক্যানভাস তৈরি করা হয়েছে ঘরের দেওয়ালে। যে ক্যানভাসে ধরা দিয়েছে হাতি। দুটি ঘরের সামনে সবুজ ঘাসে মোড়া বিশাল লন। শুধু তাই নয়, গাছও লাগানো রয়েছে। শাওয়ারের জলে রানি-তিতির গা ভেজানোর যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনই রয়েছে পুল। যেখানে আরাম করে স্নান সারতে পারবে ওরা।
হাতিঘর প্রসঙ্গে চিড়িয়াখানার এক কর্মী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে জানালেন, ‘‘আগে তো এখানে চিতাবাঘ, হায়নাদের থাকার ঘর ছিল। পরে চিতাবাঘকে অন্যত্র রাখা হয়। এ জায়গাটি সংস্কার করে হাতিদের জন্য নতুন ঘর করে দেওয়া হল।’’ তারমানে, আগে যে জায়গায় চরে বেড়াত চিতাবাঘরা, সেখানে এখন হেঁটে বেড়াবে ওই দুই হস্তিনী। হাতিঘরের এক কর্মী বললেন,‘‘আগে হাতিদের জন্য যে ঘর ছিল, তার থেকে এই নতুন ঘরের চেহারা পাল্টে গেছে।’’ তা চেহারা ঠিক কীরকম বদলাল? আগের ঘরের সঙ্গে নতুন ঘরের ফারাক কী? চিড়িয়াখানায় ঢুঁ মেরে জানা গেল, আগে যে হাতিঘর ছিল, তার আয়তন ছিল ১৯৯১ বর্গমিটার। আয়তনে নতুন ঘর প্রায় ১২ হাজার বর্গমিটারের। শুধু কী তাই, আগে হাতিঘরে আরসিসি পুল ছিল ৪৫০ বর্গফুটের, গভীরতা ছিল ৪ ফিট, যেখানে ৯,৪০০ গ্যালন জল ভরা যেত। এখন রানি-তিতির নতুন ঘরে আরসিসি পুল ৩ হাজার বর্গফুটের, গভীরতা ৬ ফিট, যেখানে ৬০ হাজার গ্যালন জল ভরা যাবে। নতুন ঘরের পাশে তৈরি করা হয়েছে একটি লেক, যার আয়তন ৩৩৪৮ বর্গমিটার। হাতিদের জন্য নতুন যে রাত্রীনিবাস তৈরি করা হয়েছে, তার আয়তন ১৭৭ বর্গমিটার। রানি, তিতির নতুন ঘরে আরও একটা চমক রয়েছে। পুরনো রাত্রিনিবাসের সামনে ২০ ফুট উচ্চতার একটা শাওয়ার বসানো হয়েছে।
আরও পড়ুন, মুনিয়ার দৌড় আর শিম্পাঞ্জিদের খেলা, জমজমাট চিড়িয়াখানা
দুই হস্তিনীর থাকার জন্য এই এলাহি আয়োজন করতে কত টাকা গুণতে হল? চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা গিয়েছে, হাতিঘরকে ঢেলে সাজাতে খরচ হয়েছে প্রায় ১.৭২৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১.৫১ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। বাকি টাকা চিড়িয়াখানার অনুদান থেকে নেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব হাতি দিবসে কী বললেন রাজ্যের বনমন্ত্রী? pic.twitter.com/BEaq4Vn6Jc
— IE Bangla (@ieBangla) August 12, 2018
অন্যদিকে হাতিঘরের উদ্বোধনে এসে রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণ বলেন,‘‘সারা বাংলায় এখন প্রায় ৮০০ হাতি রয়েছে। উত্তরবঙ্গেই প্রায় ৬০০-র মতো হাতি রয়েছে। হাতিদের যাতায়াতের পথে বহু বাধাবিপত্তি আসছে। উত্তরবঙ্গে চা বাগানের মালিকরা ব্লেড জাতীয় কিছু দিয়ে কাঁটাতার দিচ্ছেন। ফলে হাতি বস্তিতে ঢুকছে। মানুষ-হাতি সংঘাত যাতে বন্ধ করা যায় সে নিয়ে আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।’’ ট্রেনে কাটা পড়ে হাতির মৃত্যুর ঘটনা তো এখন কার্যত রোজনামচা হয়ে গিয়েছে! এ প্রসঙ্গে রেলকেই দুষে মন্ত্রী বললেন,‘‘এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে ট্রেনে কাটা পড়ে হাতির মৃত্যু হচ্ছে। এটা রোধ করার জন্য রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছি। আশপাশের রাজ্যগুলো মিলে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলাম। যে মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল যে, জঙ্গল এলাকায় রাতে মালবাহী ট্রেন চালানো যাবে না। যাত্রীবাহী ট্রেন চললে, তার গতি কমাতে হবে। কিন্তু আদালতের নির্দেশ মানা হচ্ছে না। ট্রেনের গতি বেশি থাকেই বলে হাতির মৃত্যু হয়।’’
হাতিঘরের ফিতে কাটা হয়ে গেছে। নতুন ঘরে যে দেদার মুডে খেলে বেড়াবে রানি ও তিতলি, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কাজের ফাঁকে হাতে সময় পেলে একবার ঢুঁ মেরে রানি-তিতির শাওয়ার কিংবা পুলে জলকেলি অথবা সবুজ ঘাসে ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্ত চাক্ষুষ করে আসুন।