কুষ্ঠ এককালীন সময়ে ভারতের বুকে মানুষকে জর্জরিত করে রেখেছিল। সেই নিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতি, ওষুধ এবং প্রচার কম নেই। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ রবিবারকে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিনের পর দিন এই রোগ থেকে আতঙ্ক, দাগ পড়ে যাওয়ার চিন্তা এমনকি মানুষের ব্যবহারিক বিষয়ে পরিবতর্ন, একথা কারওর অজানা নয় যে কুষ্ঠ রোগীদের সঙ্গে অচ্ছুতের মত আচরণ করে থাকেন সমাজের একাংশ। এটিকে ছোঁয়াচে হিসেবেই বর্ণনা করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এবছর থিম ভাবা হয়েছে 'ইউনাইটেড ফর ডিগনিটি' - অর্থাৎ যেসকল মানুষ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত তাদের উদ্দেশ্যে সম্মান জানানোই আসল বিষয়। যদিও গতবছরের তুলনায় এবছর ৩৭% হ্রাস পেয়ছে এই রোগের ভয়াবহতা। এখন বার বার মানুষকে সচেতন করা হয়, চিকিৎসা পদ্ধতিতে সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব সেই সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। তবে কেস শনাক্তকরণ, কিংবা চিকিৎসাসহ রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুই কোভিড মহামারীর কারণে হ্রাস পেয়েছে।
কুষ্ঠ আসলে কী?
এটি আসলে এমন একটি চর্ম রোগ, আদতে সংক্রামক! গা হাত-পা এবং ত্বকের নানান অংশজুড়ে বিকৃত ত্বকের ঘা এবং স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে। চিকিৎসক অরবিন্দ জি এম জানাচ্ছেন, এই রোগের প্রকোপ মহাদেশের প্রতিটি স্তরে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০৮,০০০ জন মানুষ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দাবি তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের মানুষ।
কী ধরনের সমস্যা থাকে এবং কেন হয় এটি?
তিনি জানিয়েছেন, M LEPRAE নামক একটি ব্যাকটেরিয়া কুষ্ঠ রোগের কারণ। এটি ধীর গতিতে বেড়ে ওঠে এবং নিজের মত করে প্রভাব বিস্তার করে। যদি ব্যাকটেরিয়ার বিপরীতে কোনও মানুষের ইমিউন প্রতিক্রিয়া দুর্বল হয়, তবে এম লেপ্রে ত্বক, স্নায়ু এবং কোষের টিস্যু গুলিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদিও বা এখন অনেক সমাধান সম্ভব হয়েছে, ধীরে ধীরে এটি লুপ্তপ্রায়।
তিনি আরও জানিয়েছেন, বিশেষ করে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল এসব দেশেই কুষ্ঠ রোগীদের সংখ্যা বেশি। মনে করা হয়, যারা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন, তাদের জেনেটিক এরকমই হয়, সংস্পর্শে এলে সংক্রমণের জন্য সংবেদনশীল করে তোলে। এবং পর পর প্রজন্মের মধ্যে এই সমস্যা দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যেই এই সম্ভাবনা বেশি, তার সঙ্গেই যারা অন্যান্য রোগ যেমন ডায়াবেটিস, HIV, হৃদরোগ এসবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কুষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
করোনা কালে কুষ্ঠ রোগ এবং রোগীদের মধ্যে কী প্রভাব পড়েছে?
মহামারীর কারণে, কুষ্ঠরোগ প্রতিরোধে বেশ কিছু স্থগিতাদেশ দেখা গিয়েছে। অতিমারিতে মানুষ নিজের বেঁচে থাকার প্রতি বেশ ধ্যান দিয়েছেন। চিকিৎসক ঋতু চৌধুরী জানাচ্ছেন, কুষ্ঠ রোগ খুব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই অনেকেই এমন আছেন, যারা রোগের পূর্ব লক্ষণ টের পাননি। দেখা যাচ্ছে, সাধারণ উপসর্গ গুলিকে তারা উপেক্ষা করেছেন এবং যার ফলেই ট্রিটমেন্টে ব্যাঘাত ঘটেছে। তিনি আরও বলেছেন যারা এই রোগে আক্রান্ত তারা অনেকেই নিজেদের স্থানে ফিরে গিয়েছেন, চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছেন। বিধিনিষেধের কারণে অনেক হাসপাতাল কোভিড ওয়ার্দে রূপান্তরিত হয়েছে ফলে চিকিৎসায় অনেক ছেদ পড়েছে। তার বক্তব্য, হোম আইশলেশন এবং কোয়ারেন্টাইন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুষ্ঠ অনুসন্ধানের বিষয়টিকে প্রভাবিত করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে মহামারীর মধ্যেও কুষ্ঠ রোগকে ভুলে না গিয়ে সতর্কতার সঙ্গে এর চিকিৎসার বিষয়টিকে নজরে এনেছেন। তারা সচেতনতামূলক একটি প্রচার শুরু করেছেন। যাতে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অবহেলিত না হয় সেই আর্জিও জানানো হয়েছে।
একথা অজানা নয়, স্বয়ং মাদার টেরেসা নিজেও কুষ্ঠ রোগীদের সেবা করেছেন। চিকিৎসক অরবিন্দ বলছেন, অনেকেই মনে করেন কুষ্ঠ ছোয়াচে তবে এত সহজ নয়। হাত ধরলে কিংবা সংস্পর্শে এলেই যে আপনিও রোগটি দ্বারা আক্রান্ত হবেন, সেটি কিন্তু ভুল। তারা একেবারেই অচ্ছুত নন, তাদের সমানভাবে বেঁচে থাকার সকলের সঙ্গে থাকার অধিকার রয়েছে।