তিনি নাকি অসূর্যাস্পর্শা। মানে সূর্যের আলো দর্শন করেন না। কোন্নগরের জাগ্রত শকুনতলা রক্ষাকালী দেবী সম্পর্কে এমনই নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। ১৮৩৬ সালে, ভিন্নমতে ১২৯৭ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শনিবার এই পুজো শুরু হয়। পুজোর বয়স কয়েকশো বছর। তখন কোন্নগরের ওই এলাকার বাসিন্দারা মিলিতভাবে একটি বারোয়ারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে পুজো শুরু করেছিলেন। সেই বারোয়ারি প্রতিষ্ঠানই এখনও অবধি এই পুজো পরিচালনা করে আসছে। এই বারোয়ারি সংগঠন শকুন্তলা শ্রীশ্রী রক্ষাকালী মাতা বারোয়ারি নামে ১৩৯৫ বঙ্গাব্দে সরকারি খাতায় নথিবদ্ধ হয়।
এই পুজো শুরুর পিছনে রয়েছে এক বিরাট ইতিহাস। কথিত আছে স্থানীয় বাসিন্দা স্বর্গীয় দেবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী থাকতেন বাঞ্ছারাম মিত্র লেনের চক্রবর্তী বাড়িতে। তাঁর পেশা ছিল পৌরোহিত্য। একদিন তিনি উত্তর কোন্নগরে যজমানের বাড়ি থেকে গড়ের খানার (বর্তমান, কালীতলা ক্যাম্পের পাশে অরবিন্দ বিদ্যাপীঠ স্কুল) ওপর দিয়ে হেঁটে আসছিলেন। বাঞ্ছারাম মিত্র লেনে ঢোকার আগে তিনি এলোকেশী শ্যামলা এক অপরূপা জ্যোতির্ময়ী নারীমূর্তি দেখতে পান। সেই নারীমূর্তি তাঁর পথ আটকে দাঁড়িয়ে ছিল। যা দেখে বিস্মিত দেবেন চক্রবর্তী বলেছিলেন, 'তুমি কে মা? এই ভাবে আমার পথ আটকে দাঁড়ালে কেন?'
সেই অপরূপা নারীমূর্তি কোনও উত্তর না-দিয়ে হেসে কিছুটা দূরে গিয়ে মিলিয়ে যান। কথিত আছে, দেবেনবাবু পরে ফের স্বপ্নে সেই অপরূপা নারীমূর্তিকে দেখতে পেয়েছিলেন। স্বপ্নেও তিনি ওই নারীমূর্তিকে একই জায়গায় মিলিয়ে যেতে দেখেছিলেন। এসব দেখে দেবেন চক্রবর্তী প্রতিবেশীদের গোটা ঘটনার কথা জানান। সেসব শুনে সবাই মিলে ঠিক করেন, যে জায়গায় দেবেনবাবু ওই নারীমূর্তি দেখেছেন, সেখানেই স্বপ্নে দেখা রূপের আদলে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করা হবে। প্রথম বছর পুজো ঘটেই হয়েছিল।
এখন যেখানে দেবীর মন্দির, সেখানে আগে ছিল বট, অশ্বত্থ এবং পাকুড় গাছের জঙ্গল। সেখানে গাছ ভরে শকুন বসে থাকত। সেখানেই অস্থায়ী মন্দির তৈরি হয়েছিল বলে দেবীর নাম শকুনতলা রক্ষাকালী। শাস্ত্রমতে, দেবী রক্ষাকালী হলেন দেবী দক্ষিণকালীর নাগরিক রূপ। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় নগর বা লোকালয় রক্ষার জন্য পাড়ার রাস্তা বা তিনমাথার মোড়ে দেবী রক্ষাকালীর পুজো প্রচলিত ছিল। দেবী শকুনতলার বর্তমান মন্দিরটি অবশ্য পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে। সেটা খুব একটা পুরোনো নয়। এই পুজো শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে অসংখ্য ভক্তের মনস্কামনা পূরণ হওয়ায় জাগ্রত দেবীর মাহাত্ম্য চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আজও এই দেবীর কাছে প্রার্থনা করে বহু ভক্ত ফল পাচ্ছেন। সেই জন্য পুজোর রাতে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে আসেন।
আরও পড়ুন- গৌড়বঙ্গে লক্ষ্মণ সেনের সময়ে প্রচলিত পুজো, যেখানে দেবী দূর করেন অন্ধত্ব
প্রধান সড়কের পাশে রয়েছে বিরাট নাটমন্দির। নাটমন্দিরের মাঝে রয়েছে হাঁড়িকাঠ। গর্ভগৃহে আছে একটি শ্বেতপাথরের বেদী। এর নীচে আরও একটি ত্রিকোণ লালরঙের বেদী আছে। সারাবছর আগে পাশের মাঠে একমাস মেলা হত। এখন চলে একসপ্তাহ। সারাবছর মন্দিরে মূর্তি থাকে না। গঙ্গাজল দিয়ে বেদী ধুয়ে দেওয়ার জন্য সারাবছর এখানে ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে। তবে, শনি ও মঙ্গলবার ছাড়া পুরোহিত পাওয়া যায় না। ২০২৩ সালের ১৩ মে, শনিবার এই জাগ্রত দেবীর বার্ষিক পুজো।