আজ থেকে ৫০ বছর আগে চাকরি গিয়েছিল চিত্রশিল্পী হিরণ মিত্রের। কলকাতার এক স্কুলে আর্ট টিচার ছিলেন তিনি। এক প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষায় যাকে প্রথম বলে ঘোষণা করেছিলেন তিনি, সে ছবি কী করে প্রথম হতে পারে, সে নিয়ে আপত্তি তুলে পরদিন স্কুল প্রধানের কাছে নালিশ জানান এক বিখ্যাত শিল্পী। "চাকরি যাওয়ায় সেদিন খুব দুঃখ হয়েছিল, কিন্তু সেই বিদ্যালয় প্রধান, সেই নালিশ করা শিল্পী, ও সেই শিশু শিল্পীকে আমি আজ ধন্যবাদ দিই, চাকরি না গেলে আমার ছবি আঁকা হত না।" বলছিলেন হিরণ মিত্র। উপলক্ষ ছিল রুকুর গ্যালাক্সি প্রকাশ।
কলকাতা বইমেলায় ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হল এই বইটি। রুকু বা বিনায়ক রুকুর বয়স ১৭। সে অটিস্টিক।
একজন অটিস্টিক কি বই লিখতে পারে, পারে ছবি আঁকতে? এসব তো দূরের কথা, সে কি পারে নিজের কাজ নিজে করতে?
রুকুর মা সুমন গাঙ্গুলি ভট্টাচার্য। তিনি বললেন, "আসলে বাবা-মা-সন্তানকে একটা ইউনিট হয়ে উঠতে হয়। তাহলে পারে।" সুমন চাকরি করেন না। সুমন রুকুকে নিয়ে থাকেন। রুকুকে বই পড়ে শোনান। শোনাতেন। সেই ছোট থেকে।
রুকুর বাবা রণেণ ভট্টাচার্য অঙ্কের অধ্যাপক। তিনি বললেন, "আড়াই বছর বয়স যখন, তখন বোঝা যায় রুকু অটিজমের শিকার। ডাক্তার জে রাম আমাদের বুঝিয়েছিলেন, কী করতে হবে।" কী করতে হবে, তা জানাটাই যখন কঠিন, তখন সে যাপন কত কঠিন বাবা-মায়ের পক্ষে, তা অনুমেয়। বা অনুমেয়ও নয় এমনকী। রণেণবাবুই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রুকুকে কাগজ দেওয়ার। লেখার জন্য। যা খুশি লেখা। রুকু লিখতে শুরু করেছিল।
আর তারও আগে ছিল ছবি আঁকা। রুকুকে ছবি আঁকার কথা কেউ বলেনি। সে নিজেই ছবি আঁকতে শুরু করেছিল, যা হাতের কাছে পেত তাই দিয়ে। এমনকী, মেঝেতে। এমনকী, জল দিয়েও। তারপর খাতা। প্র্যাকটিকাল খাতা। একদিকে তার সাদা, অন্যদিকে রুল টানা। একদিকে ছবি আঁকার আমন্ত্রণ, অন্যদিকে লেখার। রুকু সাড়া দেয়। দিতে থাকে।
রুকু স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। টেকনো ইন্ডিয়ায়। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। তার পর টুটাফাটা রেজাল্ট করেছে। তারপর সে আর পড়ে না।
রুকুর মা সুমন বললেন, "আমরা না থাকলে ওকে খুব বড় হয়ে উঠতে হবে, এমন কিছু তো নয়। আসল কথা হল ম্যানেজ করা। ওকে ম্যানেজ করতে হয়। ওর আবেগ ম্যানেজ করতে হয়। খুব ছোট ছোট ওর পেরে ওঠাগুলো, আমাদের কাছে বিশাল হয়ে ওঠে। রুকু আসলে কৌণিক দেখে, বুঝলেন", বলছিলেন রুকুর মা। "তাই রুকু আমাকে যখন বলল, আমাকে একটা চশমা দেবে, অন্যদের না হলে অসুবিধে হবে, সবাই বুঝতে পারবে, তখন আমার খুব আনন্দ হল। এটা আমাদের কাছে কত বড়, তা অন্যদের বোঝা মুশকিল।"
রণেণবাবু বলছিলেন, "কলেজের চাকরি আমাকে কিছুটা সুযোগও দিয়েছে। ৬টার মধ্যে বাড়ি ফিরে বাকি সময়টা পরিবারকে দিই। এই ইউনিটটাকে যদি বৃত্ত ধরা যায়, তাহলে আমি তার খোলসটা, কেন্দ্রে রয়েছেন রুকুর মা।"
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা উঠতে রুকুর মা বলেন, "আমরা যখন থাকব না, তখন যেন ও নিজে নিজে বেঁচে থাকতে পারে, নিজের ন্যূনতম কাজ নিজে নিজে করে উঠতে পারে, এর বেশি কিছু তো চাই না।"
রুকুকে সবাই তাড়া করে।
মা বলেছে আঙ্গুল প্যান্টের পকেটে মোটকাবে।
প্যান্টের পকেট ছোট দশটা আঙ্গুল ধরে না।
দুটো বাইরে থাকে। পকেটের মধ্যে আঙ্গুল নাচে।
ও মেরি রানি রানি।
আমার ধ্যাগিন ধ্যাগিনা music ভালো লাগে।
টোটোর পিছনে জিলেলে জিলেলে।
সাদা ডিভাইডারে অটো নাচে।
রুকুর একটি লেখার কয়েকটি লাইন। রুকুর গ্যালাক্সিতে ছবি অনেক। রয়েছেন রুকুর মা, বই জুড়ে। রয়েছে মোহিত রণদীপের লেখা, বিষাণ বসুর ভূমিকা।
প্রকাশন সংস্থা গুরুচণ্ডালীর পক্ষে ঈপ্সিতা পাল ও সায়ন কর ভৌমিক এ বই নিয়ে ব্যাপক উত্তেজিত, আবেগী। রুকুর বই সাজিয়ে তুলতে বহু সময় ব্যয়ের কথা জানালেন তিনি।
একটু খটকা লাগে, মেলায় নানা বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশের জন্য অডিটোরিয়াম ভাড়া পাওয়া যায় যখন, তখন পড়ে আসা আলোয় এরকম একটা বই কেন প্রকাশিত হল আনুষ্ঠানিক। তারপর মনে হয়, প্রান্তবাসীর লেখার এ হেন প্রান্তিক উন্মোচনই তো যথার্থ সেলিব্রেশন।