অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল প্রাইজ পাওয়ায় আরো একবার প্রমাণিত হল বাঙালিরা, বাঙালিই আছে। এই টুকু তফাৎ ঘটেছে বাঙালি এখন ভারতীয়ও বটে।
মিলটা কোথায় ও অমিলটাই-বা কোথায়?
রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পান ইয়োরোপে ও অংশত আমেরিকায় তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার ফলে। নোবেল প্রাইজ পর্যন্ত যে সেই খ্যাতির অর্জন হবে, তা কেউ ভাবেন নি। রবীন্দ্রনাথ তো ননই। কিন্তু তাঁর কবিখ্যাত ইংল্যান্ডে ও ইয়োরোপে ছড়িয়ে পড়তে না-পড়তেই বাংলা দেশে যেন ভীমরুলের চাকে চিল পড়ল। তাঁকে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার জন্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘আনন্দ-বিদায়’ বলে একটি প্রহসন লিখে স্টার থিয়েটারে টিকিট বিক্রি করে মঞ্চস্থ করেন। তাতে স্পষ্টই বলা হয়েছিল—কয়েকজনকে ধরে যদি একটা-দুটো কবিতা শুনতে রাজি করানো যায় ও অ্যান্ড্রুজের একটা সার্টিফিকেট যদি জোগাড় করা যায়, তা হলে পি.এল (পোয়েট লরিয়েট) হওয়া ঠেকায় কে?
শাহেবরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন শোনা মাত্র বাঙালি লেখকদের ইংরেজিতে অনূদিত বই ইংল্যান্ডের শাহেবদের কাছে পাঠানোর হিড়িক পড়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের না-দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী তো ইংল্যান্ড যাওয়ার আয়োজনও করে ফেলেছিলেন। প্রশান্ত কুমার পাল-এর ‘রবিজীবনী’র চতুর্থ খন্ডে এ-বিষয়ে সব খবর একসঙ্গে দেয়া আছে। সে এক কেলেংকারি-কাণ্ড।
বাঙালি তার নিজের কবিকে চিনতে পারে নি, শাহেবেরা যদ্দিন না চিনেছে- এই কলঙ্ক থেকে সেদিন বাঙালিকে বাঁচিয়ে ছিলেন দুজন। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ও আরো কয়েকজন রবীন্দ্রনাথের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবর্ধনার আয়োজন করেন। আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে সান্মানিক ডি-লিট দেয়ার প্রস্তাব সিনেট থেকে পাশ করান।
ঠিক এই সময়ই রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্কে একটা গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নোবেল পাওয়া উপলক্ষে বাংলার, পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় এই সব ঘটনাই পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এমন কি তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের প্রসঙ্গও। কারা এই রাজনৈতিক মন্তব্যাদি করেছেন তা খবরের কাগজে বিস্তারিত বেরিয়েছে। আমার এই তুচ্ছ লেখাটিকে তাঁদের নাম করে আমি কলঙ্কিত করতে চাই না। এই মূর্খদের মন্তব্য পড়ে মনে হয় নোবেল প্রাইজটা যেন কোনো গ্রাম-পঞ্চায়েতের সদস্যনির্বাচনের মত ব্যাপার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বা অন্য রাজ্যের বিশেষ রাজনীতির নেতারাও এই কলঙ্ক-ঘটানোর শরিক। ১০৬ বছর আগে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার নিয়ে যা যা ঘটেছিল অভিজিৎকে নিয়েও তাইই ঘটল—তা হলে এই ১০৬ বছরে বাঙালিদের বা ভারতীদের বয়সও বাড়ে নি, পৃথিবী সম্পর্কে ধারণাও বদলায় নি, ঔচিত্য বোধেরও কোনো বদল ঘটে নি।
কিন্তু এটা সত্য হলেও, এটাই একমাত্র সত্য নয়।
অভিজিৎ সারা ভারতবর্ষে একটা নজির হয়ে উঠেছে। তার শিক্ষাজীবন পুরোপুরি ভারতীয়। তার অর্থ—সাউথ পয়েন্ট স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগুণেই তিনি তাঁর বিষয় আবিষ্কার করতে পেরেছেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তাঁর এই বিষয়কে আবার দিতে পেরেছেন।
এই বিষয় আবিষ্কার তিনি করেছেন তাঁর নিজের জীবনরচনার পদ্ধতিকে তাঁর বিদ্যাচর্চারও বিষয় করে তুলে। তাঁদের মহানির্বাণ রোডের বাড়ির গায়ে-গা লাগানো বড় বস্তির হতদরিদ্র ছেলেদের সঙ্গে মিশে তিনি দারিদ্র্য ও অদরিদ্রের পার্থক্যটা ধরতে পেরেছিলেন। তিনি কী গভীর আত্মবীক্ষণে এই কথাটা বলেছেন—খেলার সময় দেখতাম আমার সব গুলি আমার ঐ বন্ধুরা জিতে নিয়েছে আর আমি আমার সব গুলি আমার ঐ বন্ধুরা জিতে নিয়েছে আর আমি আমার স্কুল কলেজ দিয়ে ওদের হারাতে পারি নি। তেমন যে হারানো যায় তা আমারও মনে আসে নি। ওদেরও মনে আসে নি।
অভিজিৎ-এর চিন্তায় সে বাল্য-কৈশোরের অভিজ্ঞতায় বুঝে ফেলেছিল—দারিদ্র্যই আকাঙ্ক্ষার নির্ণায়ক ও নির্মাতা। সাবালক গবেষক হয়ে সেটাকেই সে তার বিষয় করে তোলে—দারিদ্র্য এক রকমের নয়, একই কারণে সবাই দারিদ্র্য হয় না, কারণগুলি আলাদা করে জানলে তো সেই দারিদ্রের দারিদ্র্য দূর করা যায়। এই আবিষ্কারের মর্মার্থ হল—দরিদ্র কোনো জাত নয়, কোনো শ্রেণিও নয়।
তাঁর বাবা ও মা—দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ও নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় যে তাঁদের ছেলেদের নিজেদের মত বড় হওয়ার উপায় নিয়ন্ত্রণ করতে চান নি, বরং, চেয়েছেন তাঁরা দুই ছেলে, তাঁদের আত্মবিকাশের পথ খুঁজে নিক—এরই মধ্যে নিহিত আছে সন্তানদের বড় করে তোলার যাদু।
অভিজিৎ সেই যাদুর দেশের ছেলে।
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে