Advertisment

আমার বইবেলা

দূরে থাকা ভাল। টীকা নেওয়া ভাল। কাজে বাইরে যাওয়ার বাধ্যতা ভাল। অমুকদা আর তমুকদার সঙ্গে দেখা হলেই সেলফি নেওয়া আর পোস্ট করার প্রয়োজন নেই এ বছর।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Kolkata Book Fair

ছবি- শশী ঘোষ

Advertisment

একেবারে ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে। যখন দিদির বইগুলোয় প্যাস্টেল ঘষে “ছবি আঁকছি” না আর… তার চেয়ে বড় হয়েছি। কে জানে ছয় বছর না সাত বছর। প্রথম পড়ে ফেললাম ছবিতে ভরা সোভিয়েট গল্পবইয়ের একটা গোটা গল্প। এখনো মনে পড়ে সে উল্লাস। শেষ করেছি ২০ পাতার গল্পটা!!!! এতখানি পড়তে পেরেছি! যদিও সে পাতাগুলোর অর্ধেকটাই ভরা ছিল অসামান্য ছবিতে। ছোটদের সব বইয়ের ছবিগুলো আজও চোখে ভাসে। আজো আমি সোভিয়েট বই এর প্রেমে মশগুল। গুছিয়ে রেখে দিয়েছি সব বই। সম্প্রতিই সোমনাথরা পি ডি এফে সোভিয়েট বইগুলো আনছে, সোভিয়েট বুকস অনলাইন নামের সাইটে। সে কাজে ওদের কিছু কিছু বই দিতেও পেরেছিলাম, সোশাল নেটওয়ার্কিং এর কল্যাণে। তা, এমনই সব বইয়েদের মাঝে আমার ছোটবেলা।

এছাড়া ত ছিলই সহজ পাঠ। ছিল “আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন” বা “চুপ করে বসে বসে ঘুম পায়। আজ খুব শীত।“ মা জোরে জোরে পড়ে শোনাতেন লক্ষ্মীর পরীক্ষা। ব্রাউন বাঁধাই, সোনার জলে লেখা রবীন্দ্র রচনাবলী। আহা কী সেই মোটা মোটা সাদা পাতাগুলোর সুগন্ধ ছিল। আর না জানা না বোঝা এক রত্নখনির আকর্ষণ !

ভালবাসার তালিকায় ধীরে ধীরে কিছুদিন পরে যোগ হবেন উপেন্দ্রকিশোর সুকুমার রায় লীলা মজুমদার পুণ্যলতা  চক্রবর্তী সুখলতা রাও সত্যজিৎ রায়। তার আগে সব ভাল ভাল ছোটবেলার বইগুলি যা মা-ই হাতে তুলে দিয়েছিলেন, পড়েছি লাল শানের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে। ছোটবেলায় ভীষণ ভালবাসতাম বই, একেবারেই ছোট্ট থেকে সুর,  ছবির আর বইয়ের জগতেই বড় হয়েছি। মা ছিলেন পেন্টার এবং গায়ক। মায়ের হাত ধরেই গেছি অ্যাকাডেমিতে ছবির একজিবিশনে। গেছি গান শুনতে। তেমনই,  প্রথম যখন মায়ের হাত ধরে বইমেলায় যাওয়া শুরু হয়, সে এক অন্য উত্তেজনা। ঐ উত্তেজনার সঙ্গে মিলেমিশে ছিল নতুন বইয়ের গন্ধ। নতুন বইয়ের গন্ধ আবার দু রকম, ইংরিজি নতুন বই আর বাংলা নতুন বইয়ের গন্ধ আলাদা।

Kolkata Book Fair 2019 ভালবাসার তালিকায় ধীরে ধীরে কিছুদিন পরে যোগ হবেন উপেন্দ্রকিশোর সুকুমার রায় লীলা মজুমদার পুণ্যলতা  চক্রবর্তী সুখলতা রাও সত্যজিৎ রায় (ছবি- শশী ঘোষ)

আবার নতুন বই আর পুরনো বইয়ের গন্ধও তো কত আলাদা। আর দুটোই কী প্রিয়! পুরনো বই পড়তাম দিদার বাড়িতে। আমার দাদামশায় একদা কারমাইকেল কলেজ, রংপুরে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন।  সাংঘাতিক জাঁদরেল অঙ্ক শিক্ষক তথা ভারতীয় জনসঙ্ঘের একদা প্রেসিডেন্ট দেবপ্রসাদ ঘোষ। পণ্ডিত হিসেবে খুবই নামডাক ছিল তাঁর। চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলা হত। আমরা যে দাদুকে দেখেছি তিনি অশীতিপর , স্মৃতি চলে গেছে। কিন্তু তাঁর উত্তর কলকাতার বৈঠক খানায় অসংখ্য পুরনো বই, আর সেই সব বইয়ের ধুলোর একটা মাদক গন্ধ ছিল। মূলত দাঁত ভাঙা ইংরিজি বই। ওপরের তলাতেও অসংখ্য বই, এবং সেই সব বই ঘেঁটে ছোটদের পড়ার উপযোগী একটিও বই পেতাম না বটে, কিন্তু যা পেতাম তাই চেটেপুটে পড়ে ফেলতাম। নিচের তাকে পঞ্জিকাগুলো নিয়ে বসে পাঁজির সেই সব মহাবিখ্যাত বিজ্ঞাপন পড়তাম। আমাদের শৈশবে পাঁজির বিজ্ঞাপন এখনকার ছেলেমেয়েদের শৈশবে ফ্যাশন টিভি বা বড়দের সিরিয়াল দেখে পেকে ওঠার বিকল্প ছিল।

তাছাড়া কাশীদাসী মহাভারত কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং যাবতীয় ধর্ম গ্রন্থ, ধর্মসংক্রান্ত গ্রন্থ এগুলো দেখতাম মূলত ছবির টানে ।

ততদিনে উঠেছি ক্লাস ওয়ান থেকে টু, টু থেকে থ্রি ফোর ফাইভ।  ইতিহাস ভূগোল জঘন্য লাগত আমার। অঙ্ক খারাপ লাগলেও, চ্যালেঞ্জ ছিল একটা। বিজ্ঞান খুব ভাল লাগত। আর বাংলা ইংরিজি সবচেয়ে আনন্দ দিত।

সেই সব পড়ার মধ্যে, পরীক্ষা আর মায়ের তাড়নাগুলো জঘন্য ছিল আমার কাছে।কিন্তু বইয়েদের স্মৃতি সদা সুখকর।

পড়ার বইয়ের তলায় রেখে শরদিন্দু পড়া , পুজোসংখ্যায় সমরেশ বসু সুনীল গাঙ্গুলি পড়া, শুরু হয়ে গেছে ক্লাস সেভেন থেকেই। ফেলুদা খুলে রেখে পাতা উলটে উলটে রমাপদ চৌধুরীর পিকনিক বা এখনই-র মত অসাধারণ উপন্যাস পড়া, তরুণ তরুণীদের প্রেম-ভালবাসা-আশা আকাংক্ষার গপ্পো। সঙ্গে সুধীর মৈত্রর সেই অনবদ্য স্কেচ ইলাস্ট্রেশনগুলো ।

এরই সমান্তরালে আমাদের জীবনের বইমেলার শুরু। তখন ১৯৭৫। সম্ভবত। আমি তখন ক্লাস ফোর তার মানে।

রবীন্দ্রসদন উপকূলে ভিক্টোরিয়া সংলগ্ন মাঠে, ছড়ানো ছেটানো বইমেলার সূত্রপাত। ছিয়াত্তর। বেয়াল্লিশ বছর আগে। ক্লাস ফাইভে পড়ি। ইশকুল থেকে দিদিমণিরা বাসে চাপিয়ে নিয়ে গেলেন বইমেলা দেখাতে। খোলামাঠে রোদ্দুর পড়েছে, সবুজ ঘাস তখনো পায়ে পায়ে মরে যায়নি। সেই গন্ধটা আর পেংগুইনে দেখা নতুন বইয়ের গন্ধ মনে পড়ে গেল হঠাৎ। লক্ষ্য করেছি তখনই, বইয়ের গন্ধ তিন প্রকার। ইংরিজি বইয়ের আলাদা, বাংলা বইয়ের আলাদা। বাংলা নতুন বইয়ের গন্ধ আর বাংলা পুরনো বইয়ের গন্ধ ও আলাদা।

সেবার না তার পরের বার। ইশকুল ফেরত এসেছি। তখনো সাদা সবুজ স্কুল ড্রেস পরা। মা আমাকে আর দিদিকে নিয়ে সোজা মাঠে।  বই কিনেছি। দুটো কি চারটে বড়জোর। নানা বই ঘেঁটে দেখার সুযোগ এই প্রথম। বই পড়ার চেয়ে এখানে বই দেখা, অনেক অনেক বই একত্রে দেখা, এই অনুভূতিটাই নতুন। বিশেষ করে একেবারে আকাশ ছোঁয়া দামের ইংরেজি বইগুলোকে ছুঁয়ে ধরে দেখার সুযোগ। উফ সে যে কী অনুভূতি। তারপর , একটা জায়গায় বসে পড়েছি আমরা। রুমাল পেতে। খাচ্ছি মেলায় কেনা ফিশ অর্লি, বিজলি গ্রিলের স্টল থেকে। অথবা, বাড়িতেই চটপট করে সেদ্ধ কড়াইশুটি -বিন গাজর  আর শশা-টমেটো লেবু বিটনুন মাখিয়ে  মা চাট বানিয়ে এনেছেন, টিফিন বাক্স ভরে।  সে স্বাদ আর সন্দেশের স্টলে  লীলা মজুমদার নলিনী দাশকে দেখার বিস্ময়।  আনন্দের স্টলের সামনে সুনীল শক্তির নাচ, সাওঁতাল করেছে ভগবান রে… গানের সংগে।  এসবের মুগ্ধতা, সব লেগে আছে আজো মনের পরতে পরতে।

বইমেলার স্মৃতি এভাবেই , এখনো  টাটকা। বছরগুলো কেটেছে, প্রতিবার নতুন করে নিজেকেই খুঁজে পেয়েছি। ১৯৯৬ এ প্রথম বই বেরনোর আনন্দ। প্রভাত চৌধুরী, কবিতা পাক্ষিকের স্টল, সেই সব উত্তেজনার আলাপ আরো অনেক কবির সংগে। নতুন লিখতে আসা মেয়েকে উৎসাহ দিয়েছিলেন সেসব  নতুন আলাপের অগ্রজরা। অনিল আচার্যের অনুষ্টুপ থেকে উত্তম দাশের মহাদিগন্ত, বাসুদেব দেবের কালপ্রতিমা থেকে  প্রদীপ ভট্টাচার্যের একালের রক্তকরবী।

এবছর আমার বইমেলা যাওয়া হল না। এ যেন এক বেদনা, এক ক্ষত। খচ খচ করা এক আঘাতের শোক।

গুগুল বাবার ম্যাপ অবতার বলল, ৫৪৯২ কিলোমিটার দূরে আছি। এটাই কলকাতা থেকে আদ্দিস আবাবার দূরত্ব। তা হোক। আপাতত শুক্রবার সন্ধেতে ত্রাতোরিয়া গুস্তো নামের অসামান্য রেস্তোরাঁ, আমার হোটেলের ঠিক তলাতেই যা, সেখানে চীৎকারের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সান্ধ্য ফুর্তি , গান , হল্লা, উইকেন্ডের আনন্দ যাপনের। তরুণ তরুণীদের গলা। এই ত্রাত্তোরিয়া, যে কথাটার মানেই হল গে “ইতালিয়ান রেস্তরা” ফুলে ফেঁপে ওঠে লাঞ্চ টাইমে। এখানে ইউনাইটেড নেশন্স এর সব ছেলেপিলে কর্মরত কর্মরতাদের আড্ডা হয় লাঞ্চে । আবার রাতেও, কাছাকাছি নানা হোটেলে, অ্যাপার্টমেন্টে বাসা ভাড়া নেওয়া কর্মীদল এসে আড্ডা জমায়। নিঃসঙ্গ, পরিবারহীন , আফ্রিকা পোস্টিং এর একমাত্র সুখ এইই। শুক্রবার আর শনিবার গান বাজনা করা। পার্টি করা। ত্রাত্তোরিয়ার পিৎসা চমৎকার। তেমনি চমৎকার হল এদের দ্বিপ্রাহরিক বুফে। সেখানে পাস্তা থাকে আবার চাইনিজ মাছের পদ থাকে। থাকে ইথিওপিয়ার ইনজেরা আর তার সঙ্গে আমাদের কালি দালের মত মুখরোচক ঘন লেনটিলস। বাঁধাকপির শুকনো তরকারি আর অসংখ্য রকমের স্যালাড।

ত্রাত্তোরিয়ার সামনেই আজ দেখলাম একটা চাকা লাগানো সরু ঠেলাগাড়িতে আমহারিক ভাষায় লেখা বই বিক্রি করছে এক কৃষ্ণবর্ণ কৃশকায় যুবক। সেদিন দেখেছি ট্রাফিক সিগনালে বই বিক্রি হচ্ছে। অক্ষর গুলো আমহারিক, কিন্তু বইগুলো পেপার ব্যাক, সস্তা, একেবারে আমাদের উইলারে বিক্রি হ ওয়া বইএর মত। ট্রেনে বই বিক্রি হয়না? সেরকম। জাত্যাভিমান নেই, সাধারণ মানুষের ভালবাসার ছাপ আছে।

আমাদের বেড়াতে নিয়ে গেল যে ড্রাইভারটি, সে বলল সে খুব বই পড়ে। কী কথায় বলল কে জানে। গাইড, ড্রাইভার, এখানে এরা অসম্ভব বন্ধুত্বপূর্ণ, হাসিমুখ, বিনয়ী। আর প্রচুর কথা বলে আমাদেরই মত। সিনেমায় শাহরুখ আর অক্ষয় কুমার প্রিয়। আর বইয়ের মধ্যে নভেল প্রিয়। লাভ স্টোরিজ।

আমহারিক ভাষায় কারা লেখেন? তাঁদের বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে নাম ওঠেনি হয়ত। তৃতীয় বিশ্বের লেখক ইংরেজিতে লিখলে পাত্তা পান। তাই নাম হয়েছে কানাডাবাসী নেগা মেজলেকিয়া অথবা আমেরিকাবাসী হাইলে গেরিমার। তবু অক্ষর আর বই আর সস্তা ছাপা পেপার ব্যাকের গন্ধ আমাকে ভুলিয়ে দেয় এখন কলকাতায় চলছে অমুক তম কলকাতা বইমেলা।

এ বছর বইমেলা যাওয়া হল না। সারাজীবনে কতবার বইমেলা গেছি? হিসেব ত নেই কোন। বেঁচে থাকার প্রায় শুরু থেকে। যখন বছর দশ, তখন থেকে, বইমেলা আমাদের জীবনের অঙ্গ। আমার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বইমেলাও বড় হয়ে উঠল।

একেবারে ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, বইমেলায় যাওয়া আমার কাছে তীব্র এক চাপের বিষয় ছিল। বেড়ে ওঠার মুহূর্তে রাশি রাশি বইয়ের সঙ্গে কাটিয়েছি যা সব আমার নিজস্ব। হাতে ধরা ছোঁয়া প্রিয়, প্রতি পাতা নেড়ে দেখা। গন্ধ শোঁকা। পুরনো বই, নতুন বই, ইংরেজি বইয়ের গন্ধ , সব আলাদা আলাদা। সেই একান্ত ব্যক্তিগত অসামাজিক সম্পর্ক আমার বই নামক বিষয়টির সঙ্গে। আর বইমেলা মানে বিশাল লোকসমাগমের মধ্যে, পুরো সমাজের মধ্যে, বই এর পর বইকে দেখা। বই হঠাৎ তখন আমার কাছে হয়ে উঠছে নৈর্ব্যক্তিক। আমি বুঝতে পারছি আমার মায়ের নির্ধারিত , একটা আলমারির কয়েকটা তাকে “বাচ্চাদের বই” যেখানটায় আছে, যেখানে লীলা মজুমদারের কানভাঙা দিন দুপুরে আর সত্যজিতের মলাট খুলে আসা এক ডজন গপ্পো কেতরে শুয়ে আছে, আম আঁটির ভেঁপুর সবুজ কালো মলাটটা বা প্রাইজে পাওয়া বই দেশ বিদেশের উপকথা এ ওর ঘাড়ে হেলান দিয়ে বসে আছে, এই সব চেনা চেনা বন্ধু বইয়েদের বাইরেও আরো হাজার হাজার বই আছে। যেমন এ পৃথিবীতে আমি ছাড়া আরো হাজার হাজার পাঠক আছে।

এতদিন আমার ভুবনে আমি ও আমার ওইকটা বই ছিল। এক ছিলাম। বহু হলাম। তার কি চাপ কম? সেই রবীন্দ্র সদনের উল্টোদিকের বইমেলায় হঠাৎ যেন আমি হারিয়ে যাই, যেন আমার হঠাৎ বাথরুম পেতে থাকে। টেনশনে পেটের ভেতর মোচড় দেয়।

Kolkata International Book Fair আলমারির কয়েকটা তাকে “বাচ্চাদের বই” যেখানটায় আছে, যেখানে লীলা মজুমদারের কানভাঙা দিন দুপুরে আর সত্যজিতের মলাট খুলে আসা এক ডজন গপ্পো কেতরে শুয়ে আছে (ছবি- শশী ঘোষ)

উল্টোটাও হয়,  মাকে বললাম ওরিয়েন্ট লং ম্যানে যাব, লাইন দিয়ে ঢুকলাম, কিন্তু প্রতি বই টানলেও বাজেটে যদি না কুলোয় ভয় পেলাম। দাম শুনে মা ভুর কুঁচকোলেন। তারপর বললেন পড়বি ত, তাহলে ঠিক আছে। কিনে দিলেন। হয়ত সে বই বুকে জড়িয়ে বেরিয়ে আসার মধ্যে এক ভয়ানক আনন্দের ঘনঘটা ছিল।

আরো বড় হবার পর, বই দেখতে দেখতে চেনা বেরনো , বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবার অবাক আনন্দ ছিল। প্রেসিডেন্সির বন্ধু, কলেজ স্ট্রিটের বন্ধু, ইলেভেন টুয়েলভের বন্ধু ইশকুলের বন্ধু।  চেনা বেরনোর আনন্দ, কফি হাউজে কফি আর পকোড়ার আনন্দ। ভাবলেই,  বিশ্রি সেই চিলি সসের গন্ধটাও আসে আমার মাথায় , এখুনি এল।

এখন, শুধু চেনা আর চেনা। স্টল হপিং । লেখকদের দূর থেকে দেখার সুখ নেই। নিজেকে লেখক ভেবে মাথা ফুলে ঢোল। শুধু বন্ধুদের দেখা দেওয়া। আমি আসছি আজ, কে কে থাকছ, বলে ঘোষণা। সেলফি। হি হি হি। দাঁত চোয়াল সবকিছু ব্যথা।

বইয়ের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক নেই। পড়ার সঙ্গে তীব্র আশ্লেষ হারিয়েছে। শুধু “অমুক স্টলে গেছে? আমার বইটা দেখলে” বলব আদেখলার মত আর সই দিতে চাইব? এসব কতদিনের? ক বছরের? আদৌ এই সব ক্রিয়া কলাপের কোন রিমঝিম মূর্ছনা কি আছে? গোঁ গোঁ করে উত্তেজনার ভেতর চলে যাচ্ছে জীবনের একটা বইমেলা থেকে আরেকটা বই মেলা, কটা বই বেরল এবার? বলতে বলতে?

এ বছর দূরে থাকা ভাল। টীকা নেওয়া ভাল। কাজে বাইরে যাওয়ার বাধ্যতা ভাল। অমুকদা আর তমুকদার সঙ্গে দেখা হলেই সেলফি নেওয়া আর পোস্ট করার প্রয়োজন নেই এ বছর। বাঁচা গেছে। অনেকের বই পাওয়া, আর তারপর সারা বছর সেগুলো পড়ে না পড়ে ফেলে রাখা, আর মাঝে মাঝে তাদের তাগাদা, আমার বইটা পড়লেন, দিদি, আমার বই নিয়ে একটা ফেসবুক পোস্ট দিননা… শোনার থেকে এক বছর বিরতি থাকা ভাল।

ফিরে গিয়ে বইমেলা পাব না, কলেজ স্ট্রিট তো থাকবে। পরিকল্পনা করে কেনা যাবে কটা বই। আর মনে করা যাবে, দূর কোন ইথিওপিয়ান গ্রামের ঝকঝকে শানবাঁধানো ইশকুলে গরিব ছেলেরা বই খুলে পড়ছে… এই দৃশ্যটার আলাদা করে মানে আছে। টাটা সুমো চালায় যে যুবক সে প্রেমের উপন্যাস পড়ছে আমহারিক ভাষায়। বই ও সে , দুজনে এক নিবিড় একান্ত নির্জন সম্পর্কে সম্পর্কিত থাকছে ত কোনভাবে।

যেমন আমি থাকছি।  প্রচুর কাজের মধ্যে মাথা ফেটে যাচ্ছিল যেদিন, সেদিন আমার লেখক বান্ধবী বলেছে, লীলা মজুমদার নিয়ে যাওনি? হঠাৎ মনে পড়ল ল্যাপটপে পি ডি এফে বাংলা বলতে দু তিনটে বই আছে। শরদিন্দু অমনিবাস… আর , হ্যাঁ অনীশ দেব সম্পাদিত সেরা কল্পবিজ্ঞান। আশির দশকে প্রকাশ পেয়েছিল।

পড়তে বসে যাই। জগদীশচন্দ্র বসুর পলাতক তুফান… লীলা মজুমদারের ব্যাঘ্রবিজ্ঞান… আরো কত, কত, চেখে চেখে পড়ার মত লেখা। সিদ্ধার্থ ঘোষের মহাশূন্যের মণিমুক্তো। হাড়কাঁপানো ডিসটোপিয়া।

এতদিনে বইটা আমার তন্ন তন্ন করে পড়া হল। এতদিনে!!!

নির্জনতা ভাল। পাঠকের। আবার সেই ছোট্টবেলার মত।

Kolkata Book Fair
Advertisment