আফসার আমেদ ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’, যিনি এক আধুনিক রূপকথার মতোই আমাদের এই বাংলা সাহিত্যে এনে দিয়েছিলেন নিম্নবর্গ ও মুসলিম সমাজের ভাষ্য, তাঁদের জীবনযন্ত্রণা, কাহিনি ও সমাজের অন্দরমহলের কথা। প্রাদেশিক ভাষার যে তেমন চর্চা বাংলা ভাষায় হয় না, এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন বলেই হয়তো নিযুক্ত ছিলেন অনুবাদের কাজে। ‘ঘর গেরস্তি’ দিয়ে যাঁর সাহিত্যের পথে যাত্রা, সেই মানুষটি মিশে গেলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ অসামান্য কিছু কিসসা-য়। উপন্যাসের একটি অর্থ যে কথন, যা প্রায় আমরা ভুলতে বসেছি এই সময়ে, তা আফসার আমেদ তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যকর্মে নানা ভাবে প্রতিফলিত করতে করতে গেছেন। তবু, এই কথন, সোজাসাপ্টা ন্যারেটিভ নয়। এর মধ্যে মিশে যায় পরাবাস্তবের নানান স্পর্শ, নানান গলিঘুঁজি, আলো-অন্ধকার। মূলত, বাস্তবের এক পরাবাস্তবিক রূপের মধ্যেই তিনি বাস্তবের কঠিন কাঠামোগুলিকে তুলে ধরেন আমাদের সামনে। পাই হলুদ পাখির কিসসা, মেটিয়াবুরুজে কিসসা, এক ঘোড়সওয়ার কিস্সা, হিরে ভিখারিনি ও সুন্দরী রমণী কিস্সা-র মতো অসামান্য কিছু উপন্যাস। এই কিসসা সিরিজের উপন্যাসগুলি বাংলা সাহিত্যের এক চিরকালীন সম্পদ হয়ে থাকবে বলাই বাহুল্য। হরি মেটোয়ানির সিন্ধি উপন্যাস আশ্রয় এবং আব্দুস সামাদের উর্দু উপন্যাস সাড়ে তিন হাত ভূমি অনুবাদ করেছিলেন তিনি।
মুসলমান সমাজের অন্দরমহলের কথা, তাঁদের জীবনযাত্রার কথা, জীবনের নানান মনস্তাত্বিক সংকটের কথা যেমন তিনি লিখেছেন, তেমন তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে ভারতের বিভিন্ন নিম্নবর্ণীয় মানুষের জীবনসংগ্রাম ও যাপনের কথাও উঠে এসেছে। কিন্তু তাঁর লেখনীর মাধ্যমে আমরা মুসলমান সমাজের ক্যানভাসটি আরও ভাল করে পড়তে পারি। এক ধরনের সাহিত্য হয় দূর থেকে লেখা, সেখানে যে লেখকের আদর্শ নৈতিক ‘ভিশন’ থাকেনা, তা নয়, কিন্তু শ্রেণিকে, শ্রেণিচেতনাকে, তাদের মধ্যবর্তী সংকটগুলি কীভাবে যাপনে আর বাকধারায় ফুটে ওঠে, তা সৎভাবে অনেক সময় ফুটে ওঠে না। বোঝা যায়, লেখকের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও শ্রেণিগত কারণেই এই সব লেখার মধ্যে রক্তমাংস নেই। কিন্তু আফসার আমেদের লেখনী ছিল অন্যরকম, কারণ তাঁর যাপনের মধ্যে ‘নির্মাণ’ ছিল না বলেই তিনি পেরেছিলেন বাংলার মুসলিম সমাজের ভাষাকে সঠিক ভাবেই ধরতে। কিন্তু অন্ত্যজ মুসলমানের কিসসা ধরতেও তাঁর লেখনী থেকে বেরিয়েছে জাদুবাস্তবতা বা কুহকী বাস্তবতার এক অপরূপ প্রেক্ষাপট, যার মধ্যে দিয়ে আমরা পেয়ে যাই সেই নিখুঁত বাস্তবতার অন্তর্জগতের ছবি। ঘরগেরস্থি, হিরে ও ভিখারিনি, সুন্দরী রমণী কিস্সা, দ্বিতীয় বিবি, এক আশ্চর্য বশীকরণ কিস্সা, হত্যার প্রমোদ জানি, ধানজ্যোৎস্না, ব্যথা খুঁজে আনা – তাঁর সেই সব উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যে কথন-এর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বলা যায়।
সেভাবেই বলা যায় তাঁর ছোটগল্পগুলির কথা। ঘটনার আপাত বর্ণনার মধ্যে দিয়ে যে প্রতীকী বাস্তবতার ক্যানভাস তিনি রচনা করতেন, তা যেন গল্পগুলির মধ্যে অন্য এক বৃত্তান্ত-ও হাজির করত। কিন্তু তা লেখা থাকত না, পাঠককে চলে যেতে হত তার পাঠক্রিয়ার মধ্যে। ফুটে উঠত ভিতরের বাস্তবতা। কাহিনি চলছে একধরনের, পাশাপাশি উঠে আসছে আরেকধরনের কাহিনি।
প্রথম-জীবনে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও অচিরেই তিনি গদ্য লিখতে শুরু করেন। প্রাতিষ্ঠানিক, বাণিজ্যিক, অবাণিজ্যিক – সব রকম কাগজেই তিনি লিখেছেন। তবে মূলত তিনি লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। তাঁর লেখা গল্পগুলো বেরোতে থাকে 'পরিচয়', 'কালান্তর', 'বারোমাস', 'সারস্বত' ইত্যাদি পত্র-পত্রিকাগুলিতে। 'বাঙালি মুসলমানের বিয়ের গান' তাঁর এক উল্লেখযোগ্য কাজ। প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে 'পরিচয়' পত্রিকায়। এই কাজই তাঁকে বাংলার বিদ্বজ্জন সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি ঘটায়। ১৯৮০ সালে প্রথম উপন্যাস 'ঘরগেরস্তি' প্রকাশিত হয় 'শারদীয়া কালান্তর'-এ। অল্প সময়ের জন্য 'প্রতিক্ষণ' পত্রিকায় চাকরি করেন। ২০০০ সালে উর্দু-কবি কলিম হাজিখের সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদের জন্য সাহিত্য আকাদেমি অনুবাদ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৭ সালে ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’ – উপন্যাসের জন্য পেয়েছিলেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।
মনে হয়, সারা জীবন এক আউটসাইডারের মতো, এক নিখোঁজ মানুষের মতোই তিনি কাটিয়েছেন। তাই পুরস্কার পেলেও, তাঁর জীবন কখনওই স্বচ্ছল হয়নি। প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যে কেটেছে। মহানগরীর কুলীন সাহিত্য সমাজে ঘুরে বেড়ালেও তাঁর গায়ে লেগেছিল এক চিরকালীন মাটির জায়মান গন্ধ। সেই মাটির কাছেই তিনি চিরকাল স্বচ্ছন্দ ছিলেন। আর হয়ত কলম ধরবেন না তিনি। আসলে মৃত্যু এক এমন জাদুবাস্তবতা যার দরজা দিয়ে একবার ঢুকে গেলে আর বাস্তবে ফেরা যায় না। হয়ত এ জীবনটাই ছিল তাঁর উনষাট বছরের নিঃসঙ্গতার জীবন। অথবা এখন তিনি যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তার কিসসা হয়ত কখনও লিখবেন। অন্য কোনও কলমে।
প্রণাম লেখক আফসার আমেদ। মনে মনে আমিও মাটি দিলাম। গ্রহণ করুন।