Advertisment

"বইমেলার আগুনের কারণ একটি দায়িত্বজ্ঞান সিদ্ধান্ত"

হাত জোড় করে বলেছিলাম, কিছু স্টল ভেঙে দিন। ফায়ার ব্রিগেড ভাঙল না। গ্রামে তো এটা হয়। একটা বাড়িতে আগুন ধরলে পাশের বাড়ির চাল কেটে দেয়। বলেছিলাম, গাড়ি দিয়ে স্টল ভেঙে দিন, আমরা আবার বানিয়ে দেব।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Anushtup Anil Acharya Book Fair

৫৪ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে অনুষ্টুপ পত্রিকা

সেদিন বৃষ্টিতে বইমেলায় সামান্য বিপর্যয়ের পর উঠে আসছিল বইমেলার আগুনের কথা। অনেকের স্মৃতিতে সে আগুন দগদগে, আজও। বইমেলায় কেন আগুন লেগেছিল, কেন তা ছড়াল, এসব নিয়ে খোলাখুলি কথা হল তৎকালীন গিল্ড কর্ণধার অনিল আচার্যর সঙ্গে, যিনি ৫৪ বছর ধরে প্রকাশ করে চলেছেন অনুষ্টুপ পত্রিকা। যে পত্রিকা ও প্রকাশনা মননশীল পাঠকের বলে দাবি করে সে সংস্থাই।

Advertisment

দীপেশ চক্রবর্তী, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, অরিন্দম চক্রবর্তী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত চিন্তাবিদদের বই ও লেখার প্রকাশ করে চলা অনুষ্টুপ পত্রিকার সম্পাদক, অনুষ্টুপ প্রকাশনীর কর্ণধার তথা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের প্রাক্তন সম্পাদক অনিল আচার্যর সঙ্গে বেশ কিছু কথাবার্তা হল। সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ-

আমি অনুষ্টুপের টাকা ছুঁই নি কখনও

অনুষ্টুপ কি লিটল ম্যাগাজিন?

আমি তো তাই মনে করি। এখন সমস্যা হচ্ছে বুদ্ধদেব বসু ১৯৫২ সালে লিটল ম্যাগাজিনের যে ধারণাটা দিয়েছিলেন, আমি ঠিক সেই ধারণাতে খুব একটা বিশ্বাস করি না। অনেকে ভাবে, লিটল ম্যাগাজিন মানে হচ্ছে কবিতা, নিজেদের একটা গোষ্ঠীবদ্ধতার ব্যাপার। আমাদের ঐতিহ্য হল পরিচয়, এক্ষণ। এখন পরিচয় বা এক্ষণকে লিটল ম্যাগাজিন বলা যাবে কিনা জানি না। লিটল ম্যাগাজিন বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ মানুষের কাছে পৌঁছনো, মানুষের কাছে নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে যাওয়া, এবং আরও এমন কাজ করা, যার মধ্যে দিয়ে মানুষ সমাজকে আরও ভাল ভাবে বুঝবে, অর্থাৎ সোশাল সায়েন্সের বিভিন্ন দিক... আবার অন্যদিকে বিজ্ঞানের চিন্তাভাবনা। আমার একটা সুবিধে হচ্ছে যেহেতু আমি দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছি, ৩৭ বছর পড়িয়েছি প্রায়, তার ফলে একটা জিনিস বুঝতে পারি, কেবল নিজের কথা বলার জন্য কিন্তু পত্রিকা নয়। পত্রিকার উচিত হচ্ছে অন্যের কথা বলা। অপর-কে ধরা। The Other। আমার মনে হয় এই আদারকে ধরার ক্ষেত্রে অন্যরা যে ভাবে কাজ করেন, আমরা তার থেকে একটু ভিন্ন গতিপ্রকৃতিতে কাজ করি। ফলে এখনকার সময়ে দেখা যাবে অনেকেই পত্রিকা করেন বিশেষ সংখ্যা। আমরা কিন্তু সেভাবে পত্রিকা করি না। আমরা স্পেশাল ইস্যু করি না। আমরা সব সময়েই জায়গা রাখি নতুন যাঁরা লিখছেন, তাঁদের জন্য। আর প্রবন্ধ তো অনুষ্টুপের নিজস্ব জোরের জায়গা। ফলে সে জায়গা থেকে অজস্র নতুন লেখকরা তো অনুষ্টুপে লেখেন। একটা লিটল ম্যাগাজিন তো এ কাজই করে। আর লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্ক আরেকটা কথা বলা হয় - অবাণিজ্যিক পত্রিকা। অনুষ্টুপও অবাণিজ্যিক এই অর্থে নয় যে তা বাজারে বিক্রি হয় না বা অর্থ উপার্জন করে না। নিশ্চয়ই তা করে। কিন্তু এ পত্রিকার উদ্দেশ্য প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন নয়। আমি নিজে অনুষ্টুপের সম্পাদক। আমি আজ পর্যন্ত কখনও অনুষ্টুপের থেকে কোনও আর্থিক সহযোগিতা পাই বলে আমি জানি না। আমি অনুষ্টুপের টাকা ছুঁই নি কখনও।

আসলে শুরু যখন করেছিলাম, তখন আমার বয়স খুবই অল্প। ৫৪ বছর হয়ে গেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, এত বছর ধরে কোনও লিটল ম্যাগাজিনের বেঁচে থাকা উচিত নয়। তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো আমরা মরে ভূত হয়ে গেছি। অনুষ্টুপ সম্পর্কে আরেকটা কথা যেটা বলা হয় সেটা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা নিয়ে। আমার নিজের মনে হয় অনুষ্টুপ এখনও পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিকতায় বিশ্বাসী নয়।

Anushtup Anil Acharya ২ই নবীন কুণ্ডু লেন তস্য গলি হতে পারে, কিন্তু এখান থেকেই প্রকাশিত হয় তাবড় স্কলারদের লেখালিখি (ছবি- শশী ঘোষ)

ফলে বুদ্ধদেব বাবু লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে যে কথা বলেছিলেন, তার অনেকটাই আমাদের সম্পর্কে প্রযোজ্য। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন যে ঠিক কী, তা আমি এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।

পশ্চিমের লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আমাদের লিটল ম্যাগাজিনের অনেক তফাৎ রয়েছে। পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে প্রাচ্যের সংগীতের যতটা পার্থক্য, এও প্রায় ততটাই। আবার লিটল ম্যাগাজিনেরও অনেক ঘরানা রয়েছে। কেউ নিজেদের গোষ্ঠীগত লেখালিখির জায়গা থেকে ম্যাগাজিন করে, কারও কারও আমার রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে, সেখান থেকে পত্রিকা তৈরির কথা মনে হয়। অনুষ্টুপ কিন্তু অনেক মুক্তমনের পত্রিকা।  এখানে বহু দৃষ্টিভঙ্গির লেখা ছাপা হয়। আমরা বহু মতে বিশ্বাসী। ফলে সে দিক থেকে আমাদের লিটল ম্যাগাজিন বলা যায়, আবার দীর্ঘদিন বেঁচে আছি, নিয়মিত পত্রিকা বেরোয়, সেদিক থেকে আমরা ব্যতিক্রমী। এবার ভেবে দেখতে হবে আমরা লিটল ম্যাগাজিন কিনা। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি বলব, প্রাতিষ্ঠানিকতার দাসত্ব যেহেতু করি না, সে জন্য অনুষ্টুপ লিটল ম্যাগাজিনই।

অজিত চৌধুরীর মত লেখকদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার

পুরনো লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস ঘাঁটলে যেসব পত্রিকা, বিভিন্ন ধারার পত্রিকার কথা বলা হয়, তাতে বারবারই অনীক-অনুষ্টুপ এক ব্র্যাকেটে উচ্চারিত হয়। অথচ গত ৩ দশক ধরে লিটল ম্যাগাজিন পাঠ করলে বোঝা যায়, এ দুটো পত্রিকার ধরন আলাদা। এই ব্র্যাকেটবন্দি হওয়ার কারণ কি প্রায় একই সময়কাল ধরে পত্রিকা চালানো?

অনীক আর অনুষ্টুপ এক নয়। দুটো আলাদা ধরনের পত্রিকা। অনীক একটু রাজনৈতিক পত্রিকা। আর অনুষ্টুপ সেই দিক থেকে অনেক মুক্তচিন্তার পত্রিকা। কিন্তু তার যে দৃষ্টিভঙ্গিগত জায়গা তারও মূল্য রয়েছে। প্রতিবাদী জায়গার বিষয়টা যদি দেখা যায়, অনীক যতটা প্রতিবাদ করেছে... আমাদের মনে হয়েছে কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রতিবাদ করাটাই যথেষ্ট নয়। সে্খানে সংস্কৃতি বলে যে বস্তুটি আছে, সেগুলোকেও ধরা উচিত। ফলে আমরা সংস্কৃতিমনস্ক অনেক বেশি। আমরা রাজনৈতিক প্রবন্ধ ছাপি না, তা নয়। বিভিন্ন মতে রাজনৈতিক প্রবন্ধ এখানে ছাপা হয়েছে। প্রতিবাদী প্রবন্ধও আমরা প্রকাশ করেছি। যেমন অজিত চৌধুরী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিল। অজিত আমার কাছে এমন একজন ব্যক্তি যার চিন্তার গভীরতা এবং একইসঙ্গে তার অসাধারণ পাগলামির ক্ষমতা আমি কারোর মধ্যে দেখিনি। কেননা সে সত্যি কথা বলতে ভয় পায় না। বন্ধুদের ত্রুটিবিচ্যুতির কথা বলতেও পিছ পা নয়। অজিত সেক্সুয়ালিটি নিয়ে অনেক কথা বলে, যা আর কেউ বলে না। ব্যক্তিগত জীবনেও তাকে দেখেছি, সে কোনও কিছু প্রত্যাশা করে না। আমেরিকা থেকে অত সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে এসেছে, প্রাতিষ্ঠানিকতায় বিশ্বাসী হলে অর্থনীতিবিদ হিসেবে ও অনেক বড় জায়গায় যেতে পারত। অজিত আমার বন্ধুও। কিন্তু আমি ওকে মূলত শ্রদ্ধা করি। অজিতের লেখা ছেপে আমি গর্বিত। আমি জানি অনেকে অনেক কথা বলেন, কিন্তু অজিতের মত লোকেরা যদি স্পেস না পায়, তাহলে কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির দুর্দিন। দুর্দিন অবশ্য শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু অনুষ্টুপ অজিতের তিনটে বই করেছে। দুটো ইংরেজি বই একটা বাংলা বই। এই কদিন আগে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক অজিতের ইকোয়ালিটি বিয়ন্ড ইকোয়ালিটি নিয়ে আমাকে বললেন, এরকম চিন্তা ভাবনা কেউ করতে পারে আমরা ভাবতেও পারি না।

দেরিদা যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন দেরিদার ওপরে একটা মনোগ্রাফ তৈরি করেছিলাম আমরা। তাতে দেরিদাকে বলা হয়েছিল, আপনি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের লোক, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড অ্যানালিসিস করছেন.. মার্ক্স কোনওদিন সেই অর্থে মারা যেতে পারেন না। কারণ যেখানে দারিদ্র্য আছে, সেখানে মার্ক্স বেঁচে থাকবেন। ভারতবর্ষেও বেঁচে থাকবেন। এই যে মনোগ্রাফ, যেটা অজিত করেছিল, সেখানে ওর চিন্তা ভাবনা দিয়ে বুঝিয়েছিল দেরিদার ত্রুটির কথা। দেরিদা পরে বলেছিলেন, যেহেতু তিনি অর্থনীতি ভাল বোঝেন না, সেজন্য এটা তাঁকে ফ্রান্সে গিয়ে ভাল করে পড়ে বুঝতে হবে। অজিতকে দেরিদার সামনে দেরিদা প্রসঙ্গে ভাষণ দিতেও আমি ডেকেছিলাম বইমেলার সময়ে গিল্ডের সম্পাদক হিসেবে, তাতেও আমার তীব্র সমালোচনা হয়েছে। কেন এত প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতিবিদ থাকতে, বা ডিকনস্ট্রাকশন থিওরি নিয়ে যারা মাতামাতি করে, তাদের না ডেকে অজিতকে ডাকলাম।  অজিতকে নিয়ে এত কথা বললাম, তার কারণ এই যে অজিতের মত অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং ক্ষমতাসম্পন্ন লেখককে আমাদের সবসময়ে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।

আমরা প্রতিবাদী ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার জায়গা নির্মাণ করতে পেরেছি

এ কথাটা যখন উঠেই পড়ল, তখন একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, ৫৪ বছর ধরে পত্রিকা করে এরকম ভিন্নস্বরের ক্ষমতাসম্পন্ন লেখক কতজনকে পেয়েছেন, যাঁদের লেখা ছাপতে পেরে আপনি গর্বিত না হোন, আনন্দিত হয়েছেন?

এরকম বেশ কয়েকজন আছেন। মজার কথা হল আমরা ভারতীয় দর্শন, ভারতীয় চিন্তাভাবনা, সুদূর অতীত থেকে যা হয়েছে, সেটা নিয়ে অনুষ্টুপ প্রথম দিকে ভাবেনি। আমরা কিছুটা করেছিলাম দেবীপ্রসাদকে নিয়ে। আমরা তো দেবীপ্রসাদের প্রায় ২০টা বই বের করেছি। তাঁর কাছ থেকেই আমি প্রথম জানি, সত্যি সত্যিই যদি মানুষের জন্য চিন্তাভাবনা করতে হয়, তাহলে তাকে দুটো জিনিস করতে হবে। একটা হল তাকে কুসংস্কারমুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে, আরেকটা হল, তাকে দর্শন দিতে হবে। দেবীপ্রসাদকে একটু পার্টিজান ধরা হয়, উনি ওঁর মত করে বলেছিলেন। কিন্তু অরিন্দম (চক্রবর্তী)কে যখন আমি নিয়ে এলাম, সে কিন্তু সমর সেন স্মারক বক্তৃতা দিল 'ভাত কাপড়ের ভাবনা'। অর্থাৎ সে তো এক অর্থে ওঙ্কারনাথের শিষ্য কিন্তু তাই বলে তাকে বর্জন করে ফেলা হল, তার কাছ থেকে কিছু নেওয়া গেল না, সেটা খুব খারাপ হবে। অরিন্দম চক্রবর্তী তো চিন্তাভাবনার জগতে নতুন ক্ষেত্র নির্মাণ করছেন। কেউ বলতে পারে যে সে বিখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়, এনআরআই, কিন্তু সেই এনআরআই হবার সুবাদেই তো এই পৃথিবীটাকে অনেক বড় করে দেখতে পাচ্ছে। আমরা যেখানে খুব সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে থেকে দেশ দেখছি, সে তো গ্লোবালি একটা জিনিসকে দেখতে পাচ্ছে। তার চিন্তা ভাবনা এবং ভারতীয় দর্শনের যে প্রভাব আজ পাশ্চাত্য দর্শনের ওপরেও ঘটেছে... আমরা শুধু জানি যে সাহেবরা এসে ভারতীয় দর্শনের উপর কাজ করে, আর আমাদের এখানে যারা ভারতীয় দর্শনের উপর কাজ করে, সেটাকে আমরা খুব একটা গুরুত্ব দিই না। আমি অরিন্দমকে নিয়ে এসেছিলাম সেই একটা কারণে। আমার ধারণা আমার সেই চেষ্টাটা সফল হয়েছে। এ কথা বলছি, তার কারণ হল অরিন্দম দর্শনটাকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেছে। আমাদের পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা, দ্বেষ, আমাদের যে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, শরীর, এসব নিয়ে আমরা এভাবে ভাবিনি, যেভাবে ভারতীয় শাস্ত্রে ভাবা হয়েছিল। ও কিন্তু একই সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্র, পাশ্চাত্য দর্শন, এবং আমাদের সে বিশাল সাংস্কৃতিক পরিসর, যেখানে কবিতা আছে, গল্প আছে, উপন্যাস আছে, সব মিলিয়ে ও একটা অন্য ভুবন তৈরি করতে পেরেছে। আমরা অরিন্দমের কাছ থেকে শিখেছি। অরিন্দম খুব আদর্শ শিক্ষক।

তারপর আমাদের আরেক বন্ধু পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সে যেভাবে লেখালিখি করে, বন্ধু কল্যাণ সান্যাল মারা গেছেন, তিনি যেভাবে ভাবতেন, এই সমস্ত মানুষ, যাঁদের মধ্যে কেউ আছেন কেউ নেই, এই যে রঘু, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তার অসম্ভব শক্তিশালী কলম, আমরা তার একটি বইই বার করেছি, কিন্তু সে তো অনুষ্টুপের সঙ্গে কিছু পরিমাণে যুক্ত ছিল।

একদিক থেকে আমরা একটা ক্ষেত্র নির্মাণ করেছিলাম, যেখানে মুক্ত চিন্তার আরও একটা স্পেস, এবং বিশেষ করে প্রতিবাদী ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার জায়গা। সেইদিক থেকে আমি খুব গর্বিত বোধ করি। কে বাদ আছে অনুষ্টুপে লিখতে! আবার সেখানে প্রতিবাদের জায়গাটাও বহাল রয়েছে।

আমি শুধু লোকাল ভাবব, গ্লোবাল ভাবব না, সে তো একটা বিরাট সমস্যা। 

কিন্তু এদিক থেকে আরেকটা সমালোচনার জায়গাও আছে, আপনি যাঁদের কথা বলছেন, তাঁরা সকলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আপনি কি অপ্রতিষ্ঠিত তেমন কাউকে স্পেস দিয়েছেন, যিনি এখান থেকেই হয়ে উঠছেন?

এরকম অনেক লেখক রয়েছেন।

অনেকে একটা বা দুটো লেখা লিখেছেন মাত্র...

প্রথম কথা বলছি, এইযে অনেক গল্পকার আজকে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় তিনজন এখান থেকে উঠেছে। আমি বলব স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, এরা এখান থেকে উদগত প্রায় সবাই। সুতরাং ক্রিয়েটিভ লিটারেচারের জায়গা আছে। এখানে সৃজন সেনের কবিতা বার হয়েছে। সেটাও কিন্তু অপ্রতিষ্ঠিতই...এবং প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও, অনেক গ্রাম থেকে আসা, আমি নাম করতে পারব না, যারা গবেষণা করছে, সেখানে থেকে চারপাশটা দেখতে পাচ্ছে, যেটা আমরা শহরে বসে দেখতে পাই না, তাদের অজস্র লেখা অনুষ্টুপে ছাপা হয়। আমরা দেখতে পাই না। আমরা বড় নামগুলো দেখি, আমরা ছোট নামগুলোকে অগ্রাহ্য করি। কিন্তু এই একই সময়ে এটাও ঠিক, যেহেতু বড়রা লিখছে, তার পাশাপাশি ছোটরা লিখতে চায়, তার কারণ হল তার একটা দৃষ্টিভঙ্গিগত জায়গা রয়েছে। সে স্পেসটা কিন্তু অনুষ্টুপ দেয়। অনেক লেখক, অজস্র লেখক। কজন আর বড় মানুষের লেখা ছাপতে পারি! তাদের তো সময় নেই। যে অর্থে প্রতিষ্ঠিত কথাটা উঠে এল, তাদের পড়াতে হয়, তাদের পিএইচডি করাতে হয়, তাদের ইংরেজি বই বার করতে হয়, ইংরেজি কাগজে লিখতে হয়, কিন্তু তার মধ্যে থেকেও, যেমন মৈত্রীশ ঘটক, সে লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের নামী অধ্যাপক, কিন্তু তার গড়ে ওঠা তো ঘটকবাড়ি থেকে। সে যখন অনুষ্টুপে লেখে, তখন কিন্তু সে আর বিদেশের লোক থাকে না। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক লিখছেন এখন অনুষ্টুপে। গায়ত্রীদিকে সবাই খুব ভয় পায়, তিনি দেরিদার অনুবাদ করেছেন, তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, কিন্তু একটু মিশে দেখলে বোঝা যাবে, এই মানুষটা বীরভূমের পাঁচটা গ্রামে যে কাজ করছেন, সেটা তো অগ্রাহ্য করা যাবে না। তাঁর দেশের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটাকেও তো জায়গা দিতে হবে। তাঁর চিন্তাভাবনার জায়গাটা তো অনেক বড়। আমি শুধু লোকাল ভাবব, গ্লোবাল ভাবব না, সে তো একটা বিরাট সমস্যা।

এবার কয়েকটা নাম বলি।

যেমন বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত নিয়ে আমিনুল ইসলামের লেখা আমাদের এখানে ছাপা হয়েছে। সাবির আলি, সতীশ বিশ্বাস, সায়ন্তন মজুমদার, সুমিত তালুকদার, চণ্ডী মুখোপাধ্যায়, অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়, দীপক গোস্বামী- এদের লেখা তো নিয়মিত ছাপা হয় অনুষ্টুপে।

আরেকটা বিষয় হল, বড় নামের পাশে থাকতে পারলে, তাঁদের লেখাগুলো কিন্তু অন্যরাও পড়ে। সুতরাং বড় বলে যদি অগ্রাহ্য করে কাউকে যদি উড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ছোটদের স্পেসটাও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রতিষ্ঠিত বলেই কেউ ব্রাত্য হতে পারে না

একটা কথা বাজারে চালু আছে।  যখন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, অরিন্দম চক্রবর্তী, আরও এরকম দুএকজন বিশিষ্টের লেখা, যা দিয়ে অর্ধেক অনুষ্টুপ হবে, সেগুলো এসে যায়, তখন বাকিদের লেখা নিয়ে অনুষ্টুপ ছাপা হয়।

এইভাবে দেখলে মুশকিল হয় কোথায়, চিন্তা আর চৈতন্যের জগতে যারা এগিয়ে থাকে, তাদেরকে তো এগিয়ে থাকার স্পেসটা দিতে হয়। কিন্তু পাশাপাশি তো এঁরাও লেখেন। যাঁরা নামী নন, গবেষণার কাজ করছেন, তাঁরা যদি পার্থর পাশে থাকেন, অরিন্দমের পাশে থেকে লেখেন, তখন কি তাঁদেরও এ কথা মনে হয় না যে আমি এঁদের পাশে লিখছি! একটা পত্রিকার গুরুত্বও তো আছে। একটা জেনারেশনের কথা আছে। এই যে দীপেশ চক্রবর্তী, অরিন্দম, পার্থ, রাঘব, সুদীপ্ত কবিরাজ- আমরা কিন্তু একই প্রজন্মের। আমরা ওই সত্তর দশকে বেড়ে ওঠা মানুষ। সেই যে বেড়ে ওঠা, তাঁরা অবশ্য কেউ আমার মত অনুষ্টুপ করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে নেই, তাঁরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, তাঁদের অনেকখানি জায়গা আছে। কিন্তু তাঁরাই তো সব নন এখানে। এবং বেশিরভাগ লেখাই তো যাঁরা গবেষণা করছেন, নিজেদের মত কাজ করছেন, তাঁদের। এরা বছরে কটা লেখে! অনুষ্টুপে যত লেখা ছাপা হয়, তার দশ শতাংশও হবে কিনা সন্দেহ। এঁদের কি আমি বাদ দেব! আর এঁরা অনুষ্টুপে লেখেন কেন, সেটাও তো ভাবতে হবে। পার্থ আমাকে পরিষ্কার বলেছে, অনুষ্টুপ থেকে বই বেরোনো, অনুষ্টুপে লেখা মানে আমি যে পাঠক পাচ্ছি, সে পাঠক আমি আনন্দবাজারে লিখে পাব না। সে পাঠক আমি অন্য বড় কাগজে লিখে পাব না। আর সেটা হবে একদিনের লেখা। কিন্তু অনুষ্টুপে লিখলে, সে লেখাটা থাকে। এবং সে লেখা পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিতও হয়। অনুষ্টুপ প্রকাশনার কারণও কিন্তু তাই। লেখাগুলো যাতে হারিয়ে না যায়। এই যে সমর সেনকে নিয়ে এত বড় একটা কাজ। সুতরাং প্রাচীন ও নবীনের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলা একটা কাজ। প্রতিষ্ঠিত বলেই তো কেউ ব্রাত্য হতে পারে না। এদের চিন্তাভাবনার দিকে তাকাতে হবে। এদের চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণভাবে জনভিত্তিহীন, প্রতিক্রিয়াশীল এমন তো নয়। তাহলে পাশাপাশি এঁদেরও থাকতে হবে তো। এক প্রজন্ম তো আরেক প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শাস্ত্রেই আছে তিনকাঠির কাছ থেকে পরামর্শ নেবে। তিনকাঠি মানে কী! দুটো পা আর যে লাঠি হাতে চলে। আমাদের শাস্ত্রেই আছে পূর্বপক্ষ আর উত্তরপক্ষ। সব রকমের চিন্তাভাবনাই তো নিয়ে চলতে হবে।

যারা দেশটাকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে থাকব না

আপনি নিজে শিক্ষাজগতের মানুষ বলে কি অনুষ্টুপ একটু অ্যাকাডেমিয়া ঘেঁষা?

হ্যাঁ এবং না। এই অর্থে, যে অ্যাকাডেমিয়া ব্যাপারটা কী! ইউনিভার্সিটি কি কলেজের ক্লাসে পড়ালেই কি অ্যাকাডেমিয়া! আমাদের যাঁরা অ্যাকাডেমিয়াতে আছেন, তাঁদের ৯৫ শতাংশ পড়িয়েই কাজ শেষ করে ফেলেন। আর লেখেন পাঠ্যবই। তার বাইরের যে ৫ শতাংশ, তাঁরা যখন সামাজিক পরিসর নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন, তখন ওই অ্যাকাডেমিয়াটাকে পত্রিকায় তুলে আনতে হয়। কারণ তাঁরা বিশ্লেষণ করছেন। আর তার পাল্টা বিশ্লেষণ আসে প্রতিবাদী জায়গা থেকে। যাঁরা গ্রামে-শহরে গবেষণা করছেন, ভিন্ন মত পোষণ করেন, তাঁদের কাছ থেকে। আমি এই দুটো জায়গা মেলানোর চেষ্টা করি। এটা নয় যে ওরা লিখলে অনুষ্টুপ ভীষণ বিক্রি হবে, ভীষণ নাম হবে। কিন্তু হয়। তার মানে একটা দুর্বলতা বাঙালি সংস্কৃতিতে আছে। যারা বিখ্যাত, তাদের লেখা থাকলে লোকে তাড়াতাড়ি পড়ে নেয়, কিন্তু আমরা তো দুটো শিবিরকেই একজায়গায় রাখছি, রেখে প্রেজেন্ট করছি। তাতে সামাজিক চিন্তাভাবনার অগ্রগতি হচ্ছে। অনুষ্টুপ অগ্রগতির পক্ষে, পশ্চাৎপদতার পক্ষে একেবারেই নয়। সেই সত্তর দশকে কবে কী হয়েছিল আর সেই ভাবনা নিয়ে পড়ে থাকলাম... অনেকে তো এখনও পোস্টমডার্নিজমকে, পোস্ট কলোনিয়ালকেও অ্যাকসেপ্ট করতে রাজি নন, কিন্তু তা কী করে হবে! আমি কি এখনও রোমান্টিসিজমের পিরিয়ডে পড়ে থাকব! আমরা একটা জিনিস কিছুতেই মানব না। ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কারের পক্ষে আমরা কিছুতেই যেতে পারব না। এটা পরিষ্কার বলে দিচ্ছি। যাই হোক না কেন, যারা ধর্মান্ধতাকে কাজে লাগিয়ে এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে আরও সেদিকে ঠেলে দিয়ে দেশটাকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যায়, সেই রাজনীতির সঙ্গে আমরা সংশ্লিষ্ট থাকতে পারব না।

বইমেলার আগুনে দমকলের জল স্প্রে করার মেশিন কাজ করেনি

বইমেলায় যেবার আগুন লাগল, তখন আপনি দায়িত্বে। একটা সরাসরি প্রশ্ন করি। বইমেলার আগুন কি নাশকতা ছিল না দুর্ঘটনা?

দেখুন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত আছে। একটা জিনিস আমি বলছি, সাংগঠনিক দুর্বলতা বিরাট ছিল। বিভিন্ন ধরনের লোক থাকে তো, আমি বরাবরই নিয়ম মেনে চলার পক্ষপাতী। এবার আমার যদি কোনও ঘনিষ্ঠ, পরিচিত বা রাজনৈতিকভাবে আমার কাছের লোক, তাকে যদি আমি বইমেলার মধ্যে একটা প্রাইম জায়গাতে, ম্যাপের বাইরে একটা স্টল পাইয়ে দিই... এবং আমরা কেউ জানতামও না সেটা। আমি কাউকে বিশেষভাবে দোষী করব না, কিন্তু সেখানে একটা স্টল হল। সে স্টলে বসে ফায়ারব্রিগেডের লোকেরাও লুচিভাজা খাচ্ছেন, প্রাইম জায়গা যেহেতু, সবাই স্বাভাবিক ভাবেই বসে খাচ্ছে। সেখানে ব্যবহার করা হল পাম্প দেওয়া স্টোভ, যা থেকে আগুন প্রায়ই উপর দিকে উঠে যায়, কেরোসিন তেলের স্টোভ বলেই। এই রকম একটা ফুড স্টল করা হল। আমি জানতেও পারিনি এবং ম্যাপের মধ্যেও সেটা ছিল না। যে কারণে আমি সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও আমাকে কেউ কখনও কোনও প্রশ্নও করেনি। ওখান থেকে আগুনটা ছড়াল। হঠাৎ করে আগুন ওপরে উঠে গেল এবং তখন তো দাহ্য পদার্থের কোনও সীমা ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে ওপরের ছাউনিটায় আগুন ধরল। আমরা যখন দমকলকে বারবার পায়ে ধরে অনুরোধ করলাম, ওদের যে জল স্প্রে করার মেশিনটা ছিল, তার মধ্যে ফুটো। মেশিনটা চালাচ্ছে, জল বেরোচ্ছে না, অল্প জল বেরোচ্ছে। তখন হাত জোড় করে বলেছিলাম, কিছু স্টল ভেঙে দিন। ফায়ার ব্রিগেড ভাঙল না। গ্রামে তো এটা হয়। একটা বাড়িতে আগুন ধরলে পাশের বাড়ির চাল কেটে দেয়। বলেছিলাম, গাড়ি দিয়ে স্টল ভেঙে দিন, আমরা আবার বানিয়ে দেব। কে কার কথা শোনে! একদিক থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, আর আমাদের দিক থেকে ওই ত্রুটি। আমার সেদিন ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা কমিটির প্রতিনিধির সঙ্গে মিটিং ছিল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। কেউ যদি এরকম একটা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কাজ করে... সেটাই তো দুর্ঘটনার কারণ। কেউ না কেউ দায়িত্বজ্ঞানহীন না হলে তো দুর্ঘটনা ঘটে না।

তবে বইমেলার ব্যাপারে আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশংসাই করব। সমস্তরকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাদ দিয়ে বইমেলাকে মুক্তচিন্তার জায়গা করে তোলার ব্যাপারে উনি আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

বইমেলায় এন্ট্রি ফি তুলে দেওয়া ঠিক হয়নি

এখনকার বইমেলা নিয়ে কীরকম মনে হয়?

একটা জিনিস ওরা ভাল করেছে, যদিও সেটা আরও ভালভাবে করা যেত, সেটা হল লিটারারি ফেস্টিভ্যালটা। সেটা একটা বড় সংযোজন। তবে এটা তো অনুকরণ। ভিক্টোরিয়ায় একটা এরকম হয়, পার্ক স্ট্রিটেও একটা হয়। এটা অরিজিন্যাল নয়। আর এটা আরও ভালভাবে করা যায়। কিন্তু একটা ঘরের মধ্যে কিছু লোককে নিয়ে এসে বক্তৃতা দেওয়ানো, এভাবে লিটারারি ফেস্টিভ্যাল হয় না। আর নামীদামী লোকেরা এসে সব ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। কেন! আর যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের আগডম বাগডম বক্তৃতা দেওয়া, আর রেডিও জকি... এগুলো কী!

আর সারা মাঠে সবাই মাইক বাজাচ্ছে কেন! সবাই মাইক নিয়ে অনুষ্ঠান করছে, নাচাগানা করছে। নাচগানের জন্য তো জায়গাটা নয়। সারা মাঠ জুড়ে খাবার জায়গাও। এবারেই আমার খাবার জায়গার পাশে স্টল পড়েছে, জানি না কী হবে!

আরেকটা ব্যাপার আমি কিছুতেই মানতে পারি না যে এন্ট্রি ফি-টা কেন উঠিয়ে দেওয়া হল! তাতে কী লাভ হল!

বেশি লোক, বেশি ফুটফল

বেশি ফুটফল করতে গিয়ে তো মর্যাদা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ হল। একটা নিয়ন্ত্রণ  কোথাও থাকা উচিত। আরে আগে দু টাকা ছিল, তারপর পাঁচটাকা। এখন পাঁচটাকা লোকের কাছে কিছু না। কিন্তু যারা মেলায় আসত, তারা একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে দিয়ে যেত। এটা বন্ধ করা হয়েছে যাতে ট্যাক্স না দিতে হয়। আমি এটা সমর্থন করিনি। প্রবীণ নাগরিকদের ফ্রি করে দেওয়া যেত। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের তো রবিবার ফ্রি ছিল।

তারপর বইমেলায় বই কিনলে গাড়ি দেওয়া হবে। এটা কী হচ্ছে! গাড়ির সঙ্গে বইয়ের কী সম্পর্ক! এটা যে কার মস্তিষ্কপ্রসূত! সোনার গয়নার দোকান বইমেলায়। বইমেলায় কে সোনার গয়না কিনতে যায় আমি জানি না।

অনুষ্টুপের সব লেখাই তো আমার

আপনি এত বছর ধরে পত্রিকা করছেন, লেখালিখির সঙ্গে থাকলেন এতটা জীবন, নিজে লেখক হয়ে উঠলেন না কেন?

একসময়ে মনে হত, আমি একা লেখক হয়ে কী করব! খবরের কাগজের লোকেরা নিয়ে গিয়ে লিখিয়েছে, অন্য পত্রপত্রিকার চাপে লিখেছি। দুটো বইও আছে। নিজের পত্রিকায় সম্পাদকের লেখা ছাপায় আমি বিশ্বাস করি না। সম্পাদকের উচিত অন্যের লেখা ছাপা। আমি নিজে বরাবর মনে করেছি, অনুষ্টুপে যে লেখাটা ছাপা হয়েছে, সেটা আমারই লেখা। আসলে ছোট বয়স থেকে শুরু করলে যেটা হয়, আর সেটা সত্তরের সেই সময়, তখন মনে হত, লিখব কী! আমার কাজ তো সমাজকে বদলানো। এখন বুড়ো বয়সে এসে মনে হয়, নিজের লেখা একেবারে বরবাদ করা উচিত নয়। কিন্তু সময় পাই না। ৭২ বছরের বেশি বয়স হয়ে গেল। পুরনো অভ্যাসও তো ছাড়তে পারি না। তবে লিখব।

সাংস্কৃতিক ইতিহাস লিখতে চাই

আত্মজীবনী লিখবেন?

আত্মজীবনী লেখার কোনও মানে হয় না। নিজেকে বড় আর অন্যকে ছোট করা। আমি একটা ছোট সাংস্কৃতিক ইতিহাস লিখতে চাই, সবাইকে নিয়ে। নাম দিয়ে নয়। সেখানে সবাই থাকবেন। এরকম একটা লেখার পরিকল্পনা আছে।

Book Fair Little Magazine
Advertisment