Advertisment

চরম ভাল ও চরম মন্দের সহাবস্থান, রাজেশের ছবিতে ঝটকা-কাব্য

রাজেশ দেব, এই সময়ের একজন শিল্পী, বয়সে এখনও তরুণ, প্রৌঢ়ত্বের দিকে যদিও ঝুঁকে পড়া, দিল্লিতে একটি একক প্রদর্শনী করছেন আর্ট হেরিটেজ গ্যালারিতে, যাতে আগা শাহিদ আলি ঝলকে উঠেছেন।

author-image
Nilarnab Chakraborty
New Update
NULL

শিল্পী রাজেশ দেব

আগা শাহিদ আলিকে বাঙালি প্রায় চেনে না। কেনই বা চিনতে যাব আমরা। মাঝে মাঝে মনে হয়, গোটা জাতির গাল-ভরা শিক্ষিত ভাগ, প্রথম ভাগ না পড়েই যাঁদের অনেকেই শিক্ষিত বলে 'উল্লম্ফন' করেন, তাঁরা ফেসবুকে-- অসাধারণ, দারুণ, কী লিখেছেন-- এ সব লিখতে লিখতেই দেহ রাখবেন। আগা শাহিদ আলি কাশ্মীরি, আমেরিকায় থাকতেন। কবিতা লিখতেন, যে বস্তুটি আমাদের আবার খুবই প্রিয়। বিদ্রোহ খুবই অপ্রিয় অথচ, এখন, যেটা শাহিদ করতেন কবিতায়, যেমন সব বড় লেখকই করে থাকেন। আসলে বিদ্রোহের প্রকৃত সারস উড়ে গেছে আমাদের এড়িয়ে সেই কবে। আমরা আগা শাহিদ তাই পড়ি না। বা তাকে নেক নজরে দেখি না। বিদ্রোহ মানেই আমরা বুঝে ফেলি বিপ্লব,মার্ক্সবাদের ভূত আমাদের মাথায় মর্মান্তিক হয়ে চেপে বসেছে সেই কবে। মার্ক্সবাদ না পড়ে বা না বুঝে। মোহনদাস গান্ধিকে আমরা তুলোধনা করতে বড্ড মশগুল আজও।

Advertisment
publive-image

মেধা বাড়ে সম্মীলনে, যোগ ও জারণে। যেটা আমাদের হয়নি, জাতিগত ভাবে তাই আমরা এখন পিছড়ে-বর্গ। আগা শাহিদ আলি ২০০১ সালে, ব্রেন ক্যানসারে মারা গিয়েছেন। কবি এবং ইংরেজির অধ্যাপক। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। নিজের জন্মভূমি কাশ্মীর তাঁর কবিতার কেন্দ্রে। 'পোস্টকার্ড ফ্রম কাশ্মীর' কবিতায় বলেছেন, 'কাশ্মীর আমার লেটারবক্সেই গুটিয়ে পড়ে আছে/ আমার বাড়ি চার বাই ছয় ইঞ্চির/ আমি সব সময় পরিচ্ছনতা-প্রেমিক। এখন আমি/ ধরে আছি আধ ইঞ্চি হিমালয়কে, হাতে।…' প্রতি মানুষের অন্তরে যদি বিদ্রোহ জেগে থাকত, ভিড় চেতনায় যদি বিদ্রোহ চলত, তা হলে বিপ্লব করে রক্ত ঝরানোর কোনও দরকারই পড়ত না কোনও দিন, সেই প্রশ্নটা জীবন্ত করে তোলে আগা শাহিদের কবিতা, আমাদের বিদ্রোহ-চেতনাকে ঘা মেরে জাগিয়ে দিতে চায়, কাশ্মীর তখন গোটা পৃথিবীর আশাভঙ্গের প্রতীক হয়ে ওঠে। পরভূমে নিজবাসী হয়ে থাকা আগার দুঃখের সঙ্গে নিজভূমে পরবাসীদের দুঃখযন্ত্রণা মিলে যায়। আগার বই-- কান্ট্রি উইদাউট আ পোস্ট অফিস। কাশ্মীর তাড়িত এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে, একটা লাইন যার খুব দাগ কেটে যায়, ডোন্ট টেল মাই ফাদার আই হ্যাভ ডায়েড, বাবাকে বোলো না যে আমি মরে গেছি।

publive-image

রাজেশ দেব, এই সময়ের একজন শিল্পী, বয়সে এখনও তরুণ, প্রৌঢ়ত্বের দিকে যদিও ঝুঁকে পড়া, দিল্লিতে একটি একক প্রদর্শনী করছেন আর্ট হেরিটেজ গ্যালারিতে, যাতে আগা শাহিদ আলি ঝলকে উঠেছেন। নেভারল্যান্ড পোস্ট অফিস, এই হল সেই প্রদর্শনীর নাম। রাজেশের কাজ আমি অনেক দিন ধরে দেখছি। বিদ্রোহ যাঁর ব্রেনে চঞ্চল হয়ে থাকে। ফলে আঙুল থেকে সেই আগুনও বেরিয়ে আসে। না, তা ভাঙচুরের কথা বলে না। দুই বা তার বেশি বিরোধ-বিন্দুকে পাশাপাশি রেখে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চান রাজেশ, বলেন-- এটাই হওয়ার কথা তো! আপনি বলবেন, কী হাস্যকর ভাই, যা হবে না, তা কেন করা, সময় নষ্ট করে। ধরা যাক, অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক, যাঁর ডায়েরির দারুণ কাটতি এখনও,হিটলারের শিকার অ্যানা, তো হিটলারের পাশে হাসিমুখ অ্যানাকে দাঁড় করে দিয়েছেন রাজেশ, তাঁর একটি ক্যানভাসে। এই চরম বাইনারি আপনাকে বিড়ম্বিত করবে, যা এক ধরনের মজাও তৈরি করে, আপনার ব্রেনকে বলবে-- হোক না এমনটা। চেতনায় নির্বিচার নিপীড়নের যে বাসনা, সেটা গুলিয়ে উঠে আপনাকে নাড়াতে থাকবে। বদলের ধারা প্রস্তুত হবে ধীরে ধীরে, রক্তের ভিতর।

publive-image

কেউ কেউ, মহাতাত্ত্বিক তাঁরা, বলতেই পারেন, 'আরে বাইনারি তো চার দিকেই আছে দাদা। এই যে আপনি সাজগোজ করে অফিস যাচ্ছেন, ওই যে আপনার মাছওলা খালি গায়ে বাজার থেকে ফিরছেন।' কিন্তু এই বিরোধ তো আপনার চোখে সয়ে গিয়েছে বড্ড, যাকে বলে গা-সওয়া গালাগালি-কথকতার মতো। এতে আপনার ভিতরে কোনও সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ তৈরি হয় না তো। তাই আপনাকে চরম একটা ছবি দেখাতে হবে, নয়তো নাড়ানো যাবে না। এটাই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পথ, রাজেশের মতো আরও অংসখ্য শিল্পী, আগা শাহিদ আলির মতো অসংখ্য কবি, নোম চমস্কির মতো অসংখ্য তাত্ত্বিকের এই রাস্তায় কাজ, ক্রমমুক্তির কাজ। মাও জে দঙেরটা পথটা ভ্রান্ত, ভ্রান্ত লেনিনের রাস্তাও, মনে হয়। নোম চমস্কি এক প্রশ্নের উত্তরে একবার বলেছিলেন,'…আমার মতে সহজ-সরল ব্যাখ্যা হচ্ছে লেনিন অত্যন্ত সুদক্ষ কৌশলী ছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে … টালমাটাল অবস্থায় জনসমর্থন পেতে হলে জনগণের ভাষায় কথা বলাই ভাল, তাই বাঁয়ে হেলেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর তিনি যেখানে চিরকাল ছিলেন সেখানেই ফিরে যান, অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে।'(গণতন্ত্র ও ক্ষমতা, সম্পাদনা জঁ দ্রেজ, অনুবাদ গৌরী চট্টোপাধ্যায়)

publive-image

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের একটি অতি বিখ্যাত নভেলা-- নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল। কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না। কর্নেল পেনশনের জন্য অপেক্ষা করছেন তো করছেনই। ১৫ বছর কেটে গিয়েছে অপেক্ষার শেষ হচ্ছে না, পেনশনের চিঠি আসছে না। কর্নেলের এই অপেক্ষা, সুদিনের অপেক্ষা, আচ্ছে দিনের প্রতীক্ষা। রাজেশের 'নেভারল্যান্ড'-এ যা এসে হাজির হয়েছে। এক ধরনের রূপকথা হয়ে। নেভারল্যান্ড আসলে সেই রূপকথারই দেশ, যা এসেছে স্কটিশ সাহিত্যিক জে এম ব্যারির (১৮৬০ - ১৯৩৭) 'নেভারল্যান্ড' থেকে। যেখানে পিটার প্যান, টিঙ্কার বেল-রা থাকে। অশেষ শৈশবের কথা বলে যে ভূমি। নেভারল্যান্ডের কোনও সীমাই নেই। অসীমতার ইশারা।

অদ্ভুত আঁধার পৃথিবীতে। জীবনানন্দ দেখেছিলেন যা, অনেক আগে কার্ল মার্ক্স যার অর্থনৈতিক ব্যাখ্যায় চমকে দেন। মাঝে মাঝে বেশি ঘন হয়ে যায় সেই আঁধার, তাকে ঘুরঘুট্টে আন্ধারও বলতে পারেন, যেমন এখন চলছে। এত দিন ছিল করোনা, এবার-- যুদ্ধ। রাজেশের তীব্র শ্লেষভরা এক ছবির শিরোনাম-- করোনা ধারায় এসো। রবীন্দ্রনাথের করুণা-কে পুনর্নির্মাণ করে এসেছে এই করোনা।

শেষকালে বলছি, আধ মড়াদের ঘা মেরে বাঁচানোর কথাই বলে চলেছেন এই পৃথিবীতে যুগে যুগে শিল্পীরা। আধমড়ারা তাতে বেশির ভাগ সময়েই ওঠেনি জেগে অথবা বেঁচে। না যদি ওঠে আর, বলে কিন্তু যেতে হবে, যেতেই হবে। অন্তর্গত শক্তির প্রকৃত সারস এক দিন জাগবে, এই আশায়। প্রকৃত শৈশব যে আশাবাদী। রাজেশ সেই সাধনাই করেছেন ছবিতে, তাঁর 'নিষ্পাপ' এক দুরন্ত ঝটকার নাম এর ফলে।

Art Exhibition Rajesh Deb
Advertisment