Advertisment

বই- তরণী: সার্থকতার ইতিবৃত্ত

বিশিষ্ট সমালোচক ও প্রাবন্ধিক অরুণ সেনের স্মৃতিকথার আলোচনায় আরেক বিশিষ্ট সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Book Review

অলংকরণ- অভিজিত বিশ্বাস

‘বৈষ্ণব’ হিসেবে কলকাতার সংস্কৃতি চর্চায় শ্রী অরুণ সেন সুপ্রচারিত। আর আশি পার হয়েও স্বয়ং অরুণ সেনের সে কথা জানাতে গৌরবের অন্ত নেই। আসলে গ্রন্থের প্রচ্ছদে কলকাতার বাঙাল উৎকীর্ণ থাকলেও পুরো বইয়ের একটি শব্দেও তাঁকে কেউ হাইকোর্ট চেনায়নি। লেখক বহতা নদীর মত সময়ের হাত ধরে স্মৃতিচারণ করে গেছেন। বরিশালের বাঙাল হলেও তাঁর আত্মস্মৃতিতে শশী বা বিপিন অথবা ইয়াসিন মকবুল ছায়া ফেলেনি যতটা সক্রিয় থেকেছে সাহিত্য : পত্র নামক অভিজাত সাহিত্যপত্র, অথবা দেবেশ রায় কিংবা শঙ্খ ঘোষের সান্নিধ্য। অর্থাৎ এই বইয়ের পাতায় পাতায় উত্তর-বিভাজন অভিজাত বাঙালি বামপন্থীর উচ্চবর্গীয় সাংস্কৃতিক জীবন ও সফলতার উৎস থেকে মোহনা। এই বিবরণীতে উদ্বাস্তু কলোনির পোড়া বিড়ি মুখে ন্যুব্জ শরীর ও লুঙ্গি পরিহিত প্রাথমিক শিক্ষকের স্থান খুবই লং শট।

Advertisment

অরুণ সেনের কৃতিত্ব যে তিনি তাঁর বনেদিয়ানা আড়াল করেননি। এমন কোনও ভান তাঁর নেই যে তিনি বাস্তুহারার নীচের মহল খুজে পেতে চান। বরং নিবিড় এক আস্তিক্যবোধ একেবারে সূচনা থেকেই লেখকের সঙ্গী। আর সেই কারণেই উনিশ শতকের প্রান্ত রেখায় রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি সম্বল করে নিজেকে উভচর আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর কাছে ভূগোল একটি সময়ের বুদবুদ মাত্র। সীমান্ত এমন কোনও অশ্রুরেখা নয় যে তা ট্রমা রচনা করবে, সাদাত হোসেন মান্টো বা ঋত্বিক কুমার ঘটকের জীবনে যা ক্ষতচিহ্নের মত জেগে থাকে। অরুণ সেনের পশ্চাদবলোকন তেমন কোনো দুঃস্বপ্নমথিত রাত্রি নয় বারং নাগরিক মার্ক্সবাদের পেছনে হাঁটার লাবণ্যময় স্মৃতি।

আরও পড়ুন, মাওবাদ: ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল’ এবং বম্বে হাইকোর্টের মন্তব্য

অরুণ সেনের আখ্যানে যা প্রশংসার বিষয় তা একধরনের নির্লিপ্তি বা দূরত্ববোধ।  জীবনের ছায়ারোদ্দুর ও চলমানতায় তাঁর মুক্তি। ফলে আমাদের নাগরিক সারস্বতচর্চায় গত ষাট বছরের ইতিকথা অরুণবাবুর স্মৃতিকথায় বেশ ঝরঝরে ভাষায় ধরা পড়েছে। সমর সেন যেমন বক্রোক্তি করেন তা অরুণ সেনের স্বভাব বহির্ভূত। তিনি কাদের পছন্দ করেন তা টের পাই। কিন্তু যাদের সংসর্গ তিনি পরিহার করেছেন তাদের প্রতিও কেমন কোনও বিদ্বেষে মলিন হন না। কী সুন্দরভাবে তিনি দেখেছেন উত্তর দিকে যার বিদ্যাসাগর স্ট্রিট, পূর্বদিকে আপার সার্কুলার রোড, ও পশ্চিমে হৃষিকেশ পার্ক সেই বৃন্দাবন লেনকে - সকালবেলায় ধাঙড়েরা রাস্তা পরিষ্কার করত, চাপাকল থেকে গঙ্গার জলে রাস্তা ধোওয়া হত। রাত্রে বৃন্দাবন লেন তো অন্ধকার গলি। গ্যাসবাতি টিমটিম করে জ্বলত - গোধূলিতে কাঁধে মই নিয়ে ছুটে ছুটে কর্পোরেশন কর্মীরা দেশলাই দিয়ে সেইসব বাতি জ্বালিয়ে দিত। দুই ল্যাম্পপোস্টের মাঝখানে জমাট অন্ধকার- ওই অংশটুকু ভূতের ভয়ে দৌড় দিয়ে পার হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বড় রাস্তায় পৌঁছাতাম। রাজাবাজার অ়ঞ্চলে মহরমের দিন, ৪৬ সালের নরকের ত্রাস, সবই তিনি খেয়াল করেন, দীনতারণবাবুর ইংরেজি, বাবার মৃত্যুর পর মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজে গৃহবধূ জননী বাড়ির বাইরে গেলেন। হয়ত পরিবারের গণ্ডি পেরোন হল কিন্তু সেনবংশ তত অনুদার ও রক্ষণশীল ছিল না। ভাগ্যিস ছিলেন না! আমরা একজন উজ্জ্বল প্রগতি পথিককে পেয়ে গেলাম।

এই যে তিনি বিষ্ণু দে র দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার মুহূর্তগুলি নিবেদন করেন, তাতে সময়ের কী আশ্চর্য সুগন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় কবিতা তখনও কী গভীর যত্নে পঠিত হত। ‘চাই না তুমি বিনা শান্তিও’ শোনামাত্র যে লেখকের হৃৎপিণ্ড থেমে থাকে অশান্তিতে তাও তো যৌবনের বিচ্ছুরিত কোমল গান্ধার! তার সঙ্গে আমরা হাঁটতে থাকি পাতিপুকুর, লেক টাউন আর কালিন্দীর নানা গলি-উপগলি-রাজপথ। দেখা হয় শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায় বা যোগেন চৌধুরীর সঙ্গে। আমরা দেখতে পাই এক যুবক সাহিত্য বা গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের বাইরেও আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস-এ আয়োজিত ধ্রুপদী চলচ্চিত্রসম্ভারে মনোযোগ দিচ্ছেন বা সহসা উৎসাহী হয়ে উঠছেন ফরাসি ভাষার চর্চায়। সাহিত্যপত্র নামের পত্রিকা সম্পাদনা বা মার্ক্সবাদী রাজনীতির একটি স্রোতের প্রতি সংশয়াতীত সমর্থন কোনও কিছুই অরুণ সেনের জীবন পরিক্রমার পরিপন্থী নয়। তাঁর পরমপ্রাপ্তি বিষ্ণু দে-র স্নেহাসিক্ত কৌতুক: তুমিই তো আমার মাঝি প্রবন্ধসাগরে। বাস্তবেও ভ্রমণ তাঁকে প্ররোচনা দেয়, তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় সপ্রেমে দেশের এ প্রান্তে, ও প্রান্তে বা বাংলাদেশেও। এই উভচর স্মৃতি আসলে বামপন্থী সারস্বতচর্চার একটি নীলাঞ্জনছায়াও - তাতে বিষাদ বা তিক্ততা নেই। কিন্তু মাধুর্য আছে।

চমৎকার ছাপা ও বাঁধাই। বইটি পড়তে চোখের আরাম হল।

কলকাতার বাঙাল- উভচর স্মৃতি ।। অরুণ সেন ।। রাবণ ।। ৪০০ টাকা

Book Review
Advertisment