সাদিয়া সুলতানা
এই নদী বড় দুর্ভাগা। যদিও এর সর্পিল দৈর্ঘ্য এখনো বর্তমান। কিন্তু কালে কালে শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের তলানি জমে গাণিতিক হারে এর গভীরতা কমেছে আর দ্বিপদী প্রাণির আগ্রাসনে নদীর প্রস্থ কমেছে জ্যামিতিক হারে। এখন দুই হাত গভীরতার নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়ালে এর তলদেশের প্রায় সবই দেখা যায়। এর নিরাভরণ জলজ শরীর যেন ভাঙা আয়না। আর সেই আয়নার টুকরো টুকরো কাঁচে ভেসে ওঠা নিজের বিক্ষিপ্ত মুখচ্ছবি দেখে আয়নামতি নিজেই লজ্জা পায়।
এই নদীর নাম আয়নামতি। যার প্রাণ আছে, প্রাণোচ্ছলতা নেই। আয়নামতির সৌন্দর্যের শেষ নির্যাসটুকুও নিঙড়ে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা। নদীর তীরে এখন গোটা পাঁচেক একতলা, দোতলা বাড়ি। সেসব বাড়ির ছাদে এক হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার নিচে বিশাল আকৃতির আকাশী নীল-সাদা, হলুদ-সবুজ পতাকা তরতরিয়ে উড়ছে। নদীর পশ্চিম তীরে একটা নির্মাণাধীন বহুতল ভবন পাঁচতলা অবধি উঠে এখন থমকে আছে। লোকজন বলে এ ঠ্যাটা ইলিয়াসের কাজ। হাইকোর্ট থেকে সে স্থিতাবস্থার আদেশ নিয়ে এসেছে। এইসব নিয়ে কোর্ট-কাচারি করতে গিয়ে ইলিয়াসকে ধূলারচরে নিজের পৈতৃক জমিতেও হাত দিতে হয়েছে তবু সে পিছু হটেনি। কিন্তু তাতে মানুষ নদী খাওয়া বন্ধ করেনি। বিগতযৌবনা নদীতীরে যেই বসতি গড়েছে সেই নদীকে খেয়েছে একটু একটু করে।
অনেকদিন হলো নদীর মধ্যে ঢালাই করে ভিত্তি তৈরির কাজ হচ্ছে। নতুন ভবন নির্মাণ ছাড়াও পশ্চিমতীরের বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে পাড় বাঁধাই করা হয়েছে। পূর্বপাশের তীর থেকে নদীর ভেতরের দিকে বিশ-পঁচিশ ফুট জায়গা নিয়ে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে চতুর্কোণ থেকে খেতে খেতে মানুষের খিদে বেড়ে গেছে আর নদীর খিদে গেছে মরে। অথচ এককালে এ নদী সব খেতো। জমি-জিরাত, ঘরবাড়ি, পথঘাট, মানুষ সব। এখন মানুষই নদী খায়। সিকস্তি-পয়স্তির হিশেবও চুকেবুকে গেছে। প্রশাসনের লোক আসে না বহুবছর। সরকারি দলের লোকজন জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে শুনে ঘর-গেরস্তির দাবীদাওয়া সমেত দলিলপত্র নিয়ে কেউ কোর্টকাচারিও করে না আজকাল।
কেবল এই ঠ্যাটা ইলিয়াসকে সামলানো মুশকিল। ইলিয়াসের ফড়ফড়ানি দেখলে আগে এলাকার লোকজন হাসতো, এখন তারা হাসেও না। তারা জানে, ইলিয়াসের চোখে এখন মৃত্যুর ছায়া ভাসে। ইলিয়াস নিজেও জানে, তার মৃত্যু আসন্ন। গতমাসে ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ার পর সে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ওর চোখে-মুখে ভয়ডর বলতে কিছু নেই। এই যে বৃহস্পতিবারে ইলিয়াসের ঘরের কাঠের দরোজা কে বা কারা রাতের আঁধারে কুপিয়ে রেখে গেছে, তাতে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বিষয়টা অন্য কারো সাথে ঘটলে সে এলাকা ছেড়েই চলে যেত। যেভাবে সামাদ মাস্টার, তিনু বৈরাগী এলাকা ছেড়েছে। কিন্তু ইলিয়াস তা না করে থানা-পুলিশ করেছে।
আরও পড়ুন, যশোধরা রায়চৌধুরীর ছোট গল্প সখিসংবাদ
কিন্তু পুলিশ ইলিয়াসের কথা শুনে সরজমিনে পরিদর্শন করতে আসেনি। তবু ঠ্যাটা ইলিয়াসের পাল্লায় পড়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সাধারণ ডায়েরি নিতেই হয়েছে। মাসছয়েক আগে ইলিয়াসের একটা এজাহার নেয়নি বলে সে মিডিয়াকর্মী এনে থানা ঘেরাও করে ফেলেছিল। পরে স্থানীয় পত্রিকায় সে খবর প্রকাশিত হয়ে একেবারে যা তা অবস্থা। এখন নিকলি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মতলব খন্দকার ঠ্যাটা ইলিয়াসকে সমীহ করে চলে। বাড়িতে রাতে ভাত খেতে খেতে প্রায়ই সে স্ত্রী-পুত্রকে ইলিয়াসের ঠ্যাটামির গল্প শোনায়। কীভাবে এই মফস্বল শহরে একটা শুকনো-পলকা লোক অনেকের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। এই গতমাসেও যে কিনা এলাকার ত্রাস জুয়েলের বিরুদ্ধে মামলা করতে এসেছিল। সেই মামলা নেবার ব্যর্থতার কথা গোপন রেখে মতলব খন্দকার মমতা মাখা কণ্ঠে স্ত্রীর কাছে ইলিয়াসের বীরত্বের গল্প করে। যদিও গল্পের উপসংহার টানতে গিয়ে মতলব খন্দকার পুনরায় গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়।
ওপরমহলের চাপে ইলিয়াসের বিরুদ্ধে তাকে দুটো মিথ্যে মামলায় দোষী মর্মে অভিযোগপত্র দিতে হয়েছে-এ তথ্য স্ত্রীর কাছে প্রকাশ করতে তার জিহবার কোথায় যেন বাঁধে। তাই সে পারতপক্ষে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এড়িয়ে গিয়ে চুম্বক অংশের বয়ান করতে করতে বলে,
‘বুঝলা শিমুল, একটা ক্ষমতাহীন দুই টাকার মানুষ এলাকার ক্ষমতাবানদের দৌড়ের উপরে রাখে। একবার প্রেসক্লাবের সামনে টানা তিন দিন তিন রাত অনশন করছে। শেষ পর্যন্ত এম.পি. সাব আইসা নিজ হাতে পানি খাওয়াইয়া তার অনশন ভাঙছে। এত ঠ্যাটার ঠ্যাটা সে। লোকটার সাহসও খুব। আমি তাকে বলছি, ভালো কাজকর্মে আমি তার সাথে আছি।’
অবশ্য এই শহরের কছিরউদ্দিন আইন মহাবিদ্যালয় থেকে আইন পাস করা ইলিয়াসকে বাহ্যিকভাবে দেখে মনে হয় না যে সে খুব সাহসী লোক। ছাত্রজীবনে সে ততোটা মেধাবীও ছিল না। দুইবার ঢাকা গিয়ে বার কাউন্সিলে আইনজীবী সনদ প্রাপ্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েও সে পাস করতে পারেনি। পাঁচ ফুট উচ্চতার অবিবাহিত ইলিয়াসের শরীর ভঙ্গুর, বয়স বিয়াল্লিশ। শহরের দুপিয়ার মোড়ে আড়াই শতাংশ জায়গার ওপরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক জমশেদ হাসানের তৈরি করা ব্রিক ফাইন্ডেশনের দোতলা বাড়ির নিচতলায় ইলিয়াস আর তার বাবা জমশেদ থাকে। এই বাড়ির চারদিকে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। এক ইঞ্চি জায়গাও নষ্ট না করে জমশেদ সাহেব বাড়িটা নির্মাণ করেছেন। নিচতলার ভাড়াটিয়া পাওয়া মুশকিল হয় বলে জমশেদ তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর দোতলায় ভাড়া দিয়ে ছেলেসহ নিচতলায় নেমে এসেছেন।
জমশেদ হাসান চাকরি থেকে অবসর নেবার পর থেকে নিজের মতো থাকেন। ছেলেকে নিয়ে মাথা ঘামান না। তবে ইলিয়াস রোজ বাবার খোঁজখবর নেয়। সে কমবেশি এলাকার সবারই খোঁজখবর নেয়। এলাকাবাসীর ভালমন্দ নিয়ে নানান ঠ্যাটামিও সে করে বলে কালক্রমে ওর নাম ‘ঠ্যাটা ইলিয়াস’ হয়ে গেছে। শহরের কোচিং সেন্টার বন্ধের জন্য প্রচার-প্রচারণা শেষে সম্প্রতি সে লেগেছে আয়নামতির পিছনে।
এই নদীকে সে বড়ই ভালোবাসে। সন্ধ্যে থেকে অনেক রাত অবধি সে নদীতীরের বাঁধানো পাড়ে বসে হাওয়া খায়। মাঝে মাঝে আঁজলা ভরে নদীর পানিতে মুখ ধুতে ধুতে ওর পিছনে ঘুরতে থাকা টোকাই জামিলকে আশার কথা শোনায়, একদিন এই আয়নামতি ঢেউয়ে ভাসবে। হাজারো ঢেউ এসে আয়নামতির তীর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আশেপাশের সব স্থাপনা তখন সেই ঢেউয়ের প্রচণ্ডতায় ধ্বসে পড়বে।
যখন সে এসব গল্প করে তখন তার জলে ভেজা মুখ দেখে মনে হয় আয়নামতির অগুনতি ঢেউ এসে ওকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। তা দেখে টোকাই জামিল হাসে। সে তার অপরিণত মস্তিষ্ক নিয়েও যা বোঝে, ঠ্যাটা ইলিয়াস বোঝে না। ভাবে, আসলেই লোকটা ঠ্যাটা।
আরও পড়ুন, বিমল লামার ছোট গল্প: পিকনিক
সেই ইলিয়াসের মৃতপ্রায় শরীর এখন আয়নামতির তীরে পড়ে আছে। ধীরে ধীরে নদীর অস্বচ্ছ জলে ওর শরীরের ক্ষত থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত মিশেছে, কেউ টের পায়নি। অথচ দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে যখন ইলিয়াসের শরীর আয়নামতির তীরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল তখন আশেপাশের বাড়ির কোনো না কোনো ঘরে আলো জ্বলছিল। সাদা-কালো বাকসের রঙিন দুনিয়ার সামনে বসে এসব বাড়িঘরের সদস্যরা বিশ্বকাপ ফুটবলের চরম উত্তেজনায় কাঁপছিল। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসির জাদুকরী পায়ের ছোঁয়ায় ঠিক যেই মুহূর্তে প্রতিপক্ষ নাইজেরিয়ার জালে বল ঢুকেছে ঠিক সেই মুহূর্তে ইলিয়াসের পেটে জুয়েলের হাতের তীক্ষ্ম ছোরাটি ঢুকে গিয়েছিল। তারপর দুর্বৃত্তদের এলোপাথারি আঘাতের তোড়ে ইলিয়াসের আধভাঙা শরীর আয়নামতির তীরে গড়িয়ে চলে গেছে। এখন পর্যন্ত চিৎকার করে ওঠার জন্য সামান্য শক্তিও ওর নেই।
চারপাশ কাঁপিয়ে কারা যেন সম্বস্বরে চিৎকার করে ওঠে, গোওওল...আরেকটা গোল খাইছে...। খেলা শেষে উৎফুল্ল লোকজন একেএকে ঘরের আলো নিভিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করে আর আয়নামতির তীরে শুয়ে ইলিয়াস আশায় থাকে, এ নদীর বুক জুড়ে এখনই স্রােত নামবে। উঁচু-নিচু অজস্র ঢেউ আছড়ে পড়বে নদীতীরের পাষাণ জমিতে। আশায় আশায় ইলিয়াসের চোখ ক্ষয়ে যায়। জীবনবাজি রেখে সে আশায় থাকে।
ইলিয়াস মারা গেছে কিনা তা সে নিজেও জানে না। এখন অন্ধকার শহরের সবাই ঘুমিয়ে গেছে। শুধু অদূরে দমকলসের ঝাড়ের আড়ালে আলোমাখা জোনাকিরা বিমূঢ় তাকিয়ে দেখে-কী করে আলো নিভে যায়। ইলিয়াসের আশার আলোখোচিত চোখজোড়া সেই জোনাকির দিকে তাকিয়ে কেবল বিড়বিড় করে, ‘ও নদী তুমি ঢেউ হও, ঢেউ হও... ঢেউ হও।’ কিন্তু অর্ধমৃত আয়নামতি তার সেই ডাকে সাড়া দেয় না।
আয়নামতি তার নিস্তরঙ্গ শরীর নিয়ে পড়ে থাকে। ইলিয়াসকে বাঁচাবার জন্য সে কাউকে ডাকতেও পারে না। মানুষকে না, ঢেউকে না। তাই কেউ আসে না। হঠাৎ আকাশের বুকে গুটিগুটি পায়ে দলে দলে মেঘ জড়ো হয়। রাতের বিরান আঁধারে নদীর ওপর জলবাহী সেই মেঘের বাহারি ছায়া পড়ে না। বিপরীতদিকে জলের দেখা পেয়ে মেঘের সোহাগী শরীর ভারী হয়। এখন আষাঢ় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলে। তবু এই শহর বৃষ্টিহীন। নদী তীরের বাতাসও এ রাতে ভীষণ শুষ্ক।
সেই শুষ্কতাকে আর্দ্র করে নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে। শব্দহীন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে আয়নামতির ক্ষীণকায় শরীর চিরদুঃখী মায়ের মুখের কোণে ক্ষণিকের জন্য ভেসে ওঠা একরত্তি হাসির মতো তিরতির করে কাঁপে। ইলিয়াস নদীর জলের কম্পন দেখে নিজেও কাঁপে। ওর রক্তহীন ফ্যাকাসে শরীরে বৃষ্টির ছাঁট লাগে। আবেশে ওর দুচোখের পাতায় বহুদিনের সঞ্চিত ঘুম নেমে আসে। তবু ইলিয়াস আশায় থাকে আর অস্ফুট স্বরে বলে, ও নদী তুমি ঢেউ হও, ঢেউ হও...।
কিন্তু হায়, ঠ্যাটা ইলিয়াস জানে না যে আশার মতো মিথ্যে নেই।