(বাংলা ভাষার মত এত বেশি সংখ্যায় ক্রমান্বয়ে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের উদাহরণ, অন্যান্য ভাষায় খুব বেশি সম্ভবত নেই। বাংলায় বহু ছোট পত্রিকা জন্মায়, তাদের আয়ু হয় নেহাৎই সীমিত। আবার অনেক লিটল ম্যাগাজিন ক্ষীণকায় হিসেবে শুরু করে কলেবর বৃদ্ধি ঘটায়, হয়ে ওঠে তালেবর। স্রোত বহমান থাকে। সে স্রোতের ইতিহাস-ভূগোল সময়ের সঙ্গে মিলিয়েও যায়, পরবর্তীরা জানতেও পারে না। এসব পত্রিকার পদক্ষেপ ছোট হতে পারে, কিন্তু তাদের পায়ের ছাপ সুগভীর। এই পথ চলার কাহিনি লিপিবদ্ধ রাখতে চাইছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা। অন্তত তিন বছর মুদ্রিত আকারে যেসব পত্রিকা প্রকাশ হয়ে চলেছে, তাদের কথা, তাদের নিজস্ব বয়ানে লেখা থাকবে এই কলামে। শুরু করার জন্য ভাষা দিবসের চাইতে উপযুক্ত দিন আর কী-ই বা হতে পারত!)
আয়নানগর পত্রিকার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৩-র শীতে। ১৯৯৪ সাল থেকে টানা প্রকাশিত হয়ে আসা ছোট পত্রিকা ‘অপর’, যার সঙ্গে আয়নানগরের নানা অর্থে নাড়ির যোগ রয়েছে, সে বছরই তার শেষ সংখ্যা বার করে বন্ধ হয়ে যায়। সেভাবে দেখলে, আয়নানগর তৈরি হয়েছিল অপর-এর শূন্যস্থান পূরণ করতে চেয়ে, বা তাকে বন্ধ হতে না দিতে চেয়ে। আসলে আয়নানগর যাদের হাত ধরে শুরু, তাদের লেখালেখি বা প্রকাশনার জগতে ঢোকা অনেকাংশে অপর পত্রিকার হাত ধরে। তাই এ গল্প খানিকটা ব্যক্তিগত বটে। কিন্তু আয়নানগরের মূল যে রাজনৈতিক অবস্থান ও দর্শন – সাধারণ ভাবে ছোট পত্রিকার যে রাজনৈতিক অবস্থান ও দর্শন – সেসবও এই ব্যক্তিগত গল্পের ভিতরে ঢুকে আছে। আকার, সংখ্যা, অর্থমূল্য, স্পন্সরশিপ – এসবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সৎ, মানবিক ও স্বাধীন সাহিত্যচর্চা, নিজেদের লেখালেখিকে একটা সমষ্টিগত জায়গায় ফেলে দেখা ও সমালোচনা করা, লেখকের পাশাপাশি পাঠক খুঁজে বেড়ানো এবং তাঁদের সাথে সম্পর্ক তৈরির একটা প্রক্রিয়াতে ঢোকা – এইসব জায়গা থেকে আয়নানগর শুরু হয়। একা-একা চর্চা নয়। কয়েকজন মিলে, দল বেঁধে। এটা স্বাভাবিক ভাবেই একদিনে হয় না, করতে-করতে, শিখতে-শিখতে হয়। সে শেখা এখনও চলছে।
আবার পুরোটাই শূন্যস্থান পূরণ নয়। আয়নানগর যে সময়ে শুরু হয়, তার কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও ছিল। অনলাইনে এবং অন্যত্রও, লেখালেখির গুণবিচার এই সহস্রাব্দে অনেকটা সোশ্যাল-মিডিয়ার ‘লাইক’-সাফল্যের উপর নির্ভর করে, আমরা না চাইলেও করে। তার উপরে রয়েছে আঞ্চলিক ভাষায় লেখালেখিকে দাবিয়ে রাখা ইংরিজি ভাষার ‘গ্লোবাল’ লেখাচর্চার ছক। রয়েছে ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং ল্যাব’-জাতীয় ঝাঁ চকচকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক খোপবদ্ধতা। রয়েছে ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে চোখ রাঙ্গানো নিয়মবিধি। এসবই, সহজেই, অনেক লেখাকে, এবং তার পিছনে থাকা অনেক রক্তমাংসের মানুষকে তার সমস্ত ‘ক্ষমতা’-‘অক্ষমতা’ সমেত নির্দ্বিধায় বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেয়। শুধু পত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে নয়, জীবিকার ক্ষেত্রে, সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান সমস্ত ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। আয়নানগর চেয়েছিল, স্বল্প সামর্থ্য নিয়েই, এই সহজে ছুঁড়ে ফেলার নিয়মটার বিপরীতে দাঁড়াতে।
আরও পড়ুন, ব্যবসা থাক, খিদেও পাক, কিন্তু রাজত্ব হোক বইয়ের
যেমন, চেষ্টা ছিল লেখক-সম্পাদক ভেদ বস্তুটার বিরুদ্ধে যথাসম্ভব লড়াই করে সাহিত্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি সমান উৎসাহে মানবিক সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব গড়ে তোলার। প্রবন্ধ-গল্প-কবিতা মিলিয়ে লেখালেখিকে একটা বিস্তৃত স্পেকট্রামে ধরতে, বুঝতে। পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটা পাকাপোক্ত সমমনস্ক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে – যা আজকের সময়ে ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে।
চেষ্টা ছিল, মহিলা লেখক-সম্পাদকদের সাথে বিশেষ ভাবে যোগাযোগ গড়ে তোলার, আমাদের লিঙ্গায়িত সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ‘লেখা’ – এই রাজনৈতিক কাজটিকে শুধু প্রবন্ধের আকারে নয়, গল্প-কবিতার আকারেও বিশেষ ভাবে ধরার। আয়নানগরের সম্পাদক হিসেবে যে দুজনের নাম, তারা নিজেরা মেয়ে হওয়াতে হয়তো এই চাওয়াটা স্বাভাবিক ভাবেই কাজের ভিতর জায়গা করে নিয়েছিল।
চেষ্টা ছিল অন্যান্য ছোট পত্রিকা পড়ার, তাদের যাত্রাকে নিজেদের যাত্রার পাশাপাশি একটা ঘনিষ্ঠ জায়গায় রাখতে চাওয়ার, যে কারণে অনলাইন স্পেসে আয়নানগরের কয়েকটি সংখ্যা জুড়ে গড়ে উঠেছিল একটি ছোট্ট লিটল ম্যাগাজিন আর্কাইভ। কাজটা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। কিন্তু ভাবনাটা বন্ধ নেই। যাঁরা এ ধরনের কাজ ইতিমধ্যেই দক্ষতা ও ভালবাসার সাথে ব্যাপকতর ভাবে করেছেন, তাঁদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার ইচ্ছেটাও হারিয়ে যায়নি।
যে-যে চাওয়া বা চেষ্টা নিয়ে আয়নানগর শুরু হয়েছিল, গত সাড়ে পাঁচ বছরে তার ভিতর কিছু-কিছু হয়তো অল্পবিস্তর ছোঁয়া গেছে, অনেকটাই যায়নি। চাওয়াগুলো জটিল। কিছু-কিছু ছোট সমস্যা রয়েছে। যেমন, গত এক-দেড় বছরে অনলাইনে নিয়মিত ভাবে প্রকাশনার কাজ করা হয়ে উঠছে না। দ্বিভাষী অস্তিত্বও নিয়মিত বজায় রাখতে পারা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে যে পরিমাণ প্রবন্ধ ও কবিতা আয়নানগরে ছাপা হচ্ছে, সেই পরিমাণ গল্প সর্বদা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কিছু সমস্যা গভীর। যেমন, যে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে আয়নানগরের কাজ শুরু হয়েছিল, সেটা ইমেল-সোশ্যাল-মিডিয়ার মাধ্যমে কতটা করা যায়, সেটা ক্রমশ একটা বড়সড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু আয়নানগর তৈরি হওয়ার সময়, এবং এখনও, জীবিকার কারণে, ঘটনাচক্রে, এর সদস্যরা পাকাপাকি ভাবে এক শহরে থাকতে পারেনি, পারছে না, তাই প্রশ্নটা উঠছে শুধু পত্রিকার সাথে বাইরের জগতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়, পত্রিকার নিজের ভিতরের টানাপোড়েনের ক্ষেত্রেও। ঘটনাচক্রে এবছরের আয়নানগর বইমেলা সংখ্যাতেই সৌমিত্র ঘোষের ‘বিকল্প জ্ঞানের খোঁজে’ লেখাটিতেও এই প্রশ্নের একটা আভাস উঠে এসেছে, একটু ঘুরিয়ে, অন্যভাবে।
তবে শুধুই না-পারা নয়, ভিন্ন শহরে, ভিন্ন কর্মপরিসরে থেকেও বছর-বছর একজোট হয়ে নিয়মিত ভাবে একটি ছাপা সংখ্যা বার করতে পারা যাচ্ছে। এ বছর কলকাতা বইমেলাতেই প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যা। সরকারি-বেসরকারি সাহায্য বর্জন করেই লেখালেখি, ছাপাছাপি চালিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। সাফল্য ও প্রফেশনালিজমকে অবাধে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে। তাই টানাপোড়েনের একদিকে থাকছে আলস্য, মতভেদ, সমায়াভাব, লোকাভাব। অন্যদিকে থাকছে টিকে থাকা, আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, পুরনো মুখেদের ফিরে-ফিরে আসা, এক-দুটো নতুন মুখ খুঁজে পাওয়া, পত্রিকার পাশাপাশি প্রতি বছর অন্যান্য বই-এর প্রকাশনা চালিয়ে যাওয়া...।
এটাও স্বীকার করতেই হবে যে, আয়নানগরের সমস্যা শুধু আয়নানগরেরই নয়। এই মুহূর্তে যাঁরা ছোট পত্রিকা বার করেন, বা যাঁরা এইভাবে সমষ্টিগত কাজ অন্য পরিসরে করে থাকেন, তাঁদের সকলেরই। তবু কাজ হচ্ছে, এটাই পাথেয়।
আয়নানগর পত্রিকা শুরু হয়েছিল নন্দিনী, মধুশ্রী (সম্পাদক) এবং প্রমোদের (প্রকাশক) মিলিত উদ্যোগে। সম্পাদক, প্রকাশক – এই নামগুলো খানিকটা গাল ভারি করা। যাঁরা ছোট পত্রিকা করেন, তাঁরা জানেন, সব কাজ সবাই মিলে না করলে চলে না – সেটা আজকের পৃথিবীতে কর্মক্ষেত্রে ক্লাসিফিকেশনের রাজনীতির বিরুদ্ধে ছোট পত্রিকার একটা অবস্থানও বলা যেতে পারে। পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ এগিয়ে এসে আয়নানগরের কাজে হাত লাগিয়েছেন। আয়নানগরের ‘টীম’ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তা এই সমস্ত মানুষকে নিয়েই। কেউ-কেউ বেশ বড় একটা সময়ের জন্য টিকে গেছেন, যেমন সৌম্যজিৎ – আয়নানগরের সহ-সম্পাদক, সহ-খাটিয়ে। যাঁরা এগিয়ে এসেছেন, তাঁরা কেউ হয়তো এসেছেন লেখক হিসেবে, কেউ চিত্রকর হিসেবে, কেউ ছাপার কাজে সহায়তা করতে, কেউ শুধুই বন্ধু বলে। এই পদ্ধতিটা থেমে যাওয়াই হয়তো আয়নানগরের থেমে যাওয়া।