(বাংলা ভাষায়, মুদ্রিত মাধ্যমে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস খুব কম দিনের নয়। সে ইতিহাসের সঙ্গে লেগে থাকে অনেকরকমের অভিজ্ঞতাও। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা সে অভিজ্ঞতাসমূহের বিবরণ প্রকাশ করতে শুরু করেছে কয়েক সপ্তাহ ধরে।)
‘স্বকণ্ঠে’ প্রকাশের প্রয়োজন হয়ে পড়ল যখন দেখা গেল আমাদের কথা কেউ বলেনা। বলে-তো না-ই, উল্টে কখনও বলে ফেললে ধমকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। শুধুই কি তাই? চলে ভয়ঙ্কর সামাজিক ও দৈহিক নিপীড়ন যা কখনও আত্মহত্যা পর্যন্ত গড়ায়। রাষ্ট্রের চোখ রাঙানির ভয় চারিদিকে, কারণ আইনের চোখে তারা অপরাধী। এখন আর বোধহয় বুঝতে অসুবিধে নেই যে আমি আসলে কাদের কথা বলছি। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন পাঠক, আমি সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামী মানুষদের বা এল-জি-বি-টি-আই-কে-কিউ-এইচ-এ+ সম্প্রদায়ের কথাই বলছি।
৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৮-এ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা আংশিক রদ করে ভারতের মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট সমকামীদের মুক্তি দিয়েছেন অপরাধীর তকমা থেকে। তাই সেই নৈঃশব্দের তীব্রতা আজ অনুভব করা বেশ কঠিন। নীরবতার নিরেট দেওয়াল দিয়ে সেদিন ঘেরা ছিল সার্বিক যৌনতাবোধ নিয়ে চর্চা। যৌনতার মানে তখন কেবলমাত্র নারী-পুরুষের যৌথ বিসমকামী শরীরখেলা। সমকালীন সাহিত্য, শিল্পকলা, সিনেমা-থিয়েটার, সংগীত, কোথাও ছিলনা সমকামী জীবনচর্যার কোনও প্রতিফলন। এমতাবস্থায় জৈবিক নারীদেহধারি মানুষের সমকামিতা, উভকামিতা আর রূপান্তরকামিতা তো নৈব নৈব চ। হেনকালে আত্মপ্রকাশ করল ‘স্বকণ্ঠে’।
আরও পড়ুন, প্রতিরোধের সিনেমা: চলার পথে ছ’টা বছর
নিজেদের কথা নিজেদের কণ্ঠে বলার জন্যে, ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। মাত্র ৫০০ কপি ছেপে নিয়ে ‘স্যাফো’-র ভলান্টিয়াররা হাজির হল মেলার মাঠে। ১৯৯৯ সালের জুন মাসে তখন ‘স্যাফো’ তৈরি হয়েছে কলকাতায়, নারী সমকামী, উভকামী ও নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরকামী (‘এলবিটি’ অর্থাৎ ‘লেসবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল উওম্যান অ্যান্ড ট্রান্সম্যান’) মানুষদের অধিকার আন্দোলনের সংগঠন হিসাবে। আর এই ‘স্যাফো’-রই পত্রিকা ‘স্বকণ্ঠে’। ‘স্বকণ্ঠে’-র প্রকাশই তাই এক বিপ্লব। ‘এলবিটি’ গোষ্ঠীর মানবাধিকার নিয়ে সমাজ সচেতনতা গড়ে তোলাই ‘স্বকণ্ঠে’ প্রকাশের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। খোলাখুলি ভাবে যৌনতার রাজনীতি-ভাবনা নিয়েই আলোচনা হয়েছে এই পত্রিকায়। কখনও বৌদ্ধিক স্তরে, কখনও উপলব্ধির স্তরে, কখনওবা আবেগের উষ্ণতায়। যেনবা বর্ণনা করেছে এক বিপ্লবের জন্মকথা, সময়ের তালে তাল মিলিয়ে সেই বিপ্লবের বৃহদাকার ধারণ করে আজকের সাফল্যে পৌঁছনোর কথা, সমগ্র যৌন-প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানবাধিকার আদায়ের লড়াইয়ের কথা।
কাজটা সহজ ছিলনা মোটেই। সন্দিগ্ধ সমালোচনা, প্রকাশ্য প্রতিরোধ, বাঁকা হাসি, চোরা চাউনি, ফিশফিশে কথা সঙ্গী ছিল সেই শুরুর দিনগুলোতে। তবে বহু প্রতিকূলতার মাঝে সহমর্মিতা ও বন্ধুতার মরুদ্যানও ঋদ্ধ করেছে ‘স্বকণ্ঠে’-কে। আমাদের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এসে এই পত্রিকায় লিখেছেন বহু বিদগ্ধ শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও গবেষক, প্রোথিতযশা সাহিত্যিক, নামী কবি, প্রতিষ্ঠিত সমাজকর্মী, যারা তথাকথিত মূলস্রোতের মানুষ। সেই সঙ্গে অবশ্যই আছে যৌন-প্রান্তিক স্বরের প্রতিনিধিত্ব। এই সুযোগে জানিয়ে রাখি, ‘স্বকণ্ঠে’ পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের পুরোধা বিশিষ্ট নারীবাদী কর্মী প্রয়াত মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিনের কথা: কালধ্বনি
বছরে দুবার, জানুয়ারি ও জুনে, প্রকাশিত ‘স্বকণ্ঠে’ দ্বিভাষিক পত্রিকা, বাংলা ও ইংরাজিতে এর প্রকাশ, উদ্দেশ্য যত বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়। আজ এর পাঠক সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশী। ‘স্যাফো’-র ভলান্টিয়াররা বইমেলার মাঠে নেমে মুখোমুখি হয় সাধারণ মানুষের, কথা বলে সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে, তারপর হাতে দেয় ‘স্বকণ্ঠে’। এইটাই বোঝানো যে, আমরা কোনও মঙ্গল গ্রহের জীব নই, আপনাদের মতই একজন, মনের জোর বাড়ে ওদের, বাড়ে লড়াই করবার আত্মবিশ্বাস। ২০০৬ সাল থেকে আমরা বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ানে ‘স্বকণ্ঠে’-র নামে টেবিল পাচ্ছি।
‘স্বকণ্ঠে’ আজ আর কোনও অচেনা নাম নয় বইমেলার মাঠে। পাঠকেরা নিজে থেকে খুঁজে ‘স্বকণ্ঠে’-র টেবিলে এসে সংগ্রহ করেন এই পত্রিকা। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তো বটেই, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকী বিদেশেও ছড়িয়ে আছেন এর পাঠককূল। লিঙ্গ-যৌনতা বিষয়ক মৌলিক প্রবন্ধ থেকে শুরু করে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গল্প, কবিতা, সাক্ষাৎকার, নাটক, ছবিতে গল্প, রেখাচিত্র ও অ-বিসমকামী মানুষের জীবনগাথা। সব মিলিয়ে ‘স্বকণ্ঠে’ তাই জন্ম দেয় এক নতুন চিন্তাধারার, যার বিনিময়ে শুরু হয় দিন বদলের পালা। শুরু হয় সংলাপ, সাধারণ মানুষের সঙ্গে ‘এলবিটি’ সম্প্রদায়ের, স্বপ্ন দেখায় এমন এক সমাজের যেখানে সুরক্ষিত থাকে অপ্রথাগত যৌনতার মানুষের অধিকার।
প্রথম দিন থেকেই চেয়েছি ‘স্বকণ্ঠে’ হবে এমন এক মঞ্চ যেখানে নারী সমকামিতা, উভকামিতা ও রূপান্তরকামিতা ছাড়াও সার্বিক ভাবে সামাজিক লিঙ্গ-যৌনতা বিষয়ে চলবে কথোপোকথন। ‘লেসবিয়ানিজম’ শব্দটার মধ্যে যে ‘ইজম’ বা তত্ত্ব আছে তা তথ্য সহযোগে জনসমক্ষে তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়েছে এই পত্রিকা, এক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কামকেন্দ্রিক জীবনচর্চা নয়, বরং লিঙ্গ-যৌনতা বিষয়ক চর্চা প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং সেটাই সত্য, এই বিশ্বাসে।
আরও পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিনের কথা: আয়নানগর
সময় যত এগিয়েছে ‘স্যাফো’-র আন্দোলনের ধারাও তত বদলেছে। তাই ‘স্বকণ্ঠে’-তে একদিকে যেমন প্রতিফলিত হয়েছে ‘এলবিটি’ মানুষের উপর নিয়ত ঘটে চলা হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষার পরিবর্তন। অন্যদিকে তেমন এই গোষ্ঠীর মানুষের নিজের মনের মধ্যে বাস করা সংস্কারের প্রতিবিধানেও কার্যকরী হয়েছে এই পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি, কখনও ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে, কখনও গোষ্ঠীগত ভাবে। শুরুতে শুধু যৌনতাবোধ (সেক্সুয়ালিটি) নিয়ে চর্চা খুব বেশী করে হয়েছে কিন্তু যখন ট্রান্সম্যানেরা এসে তাঁদের জীবনশৈলীর কথা এবং তাঁদের বঞ্চনা ও হিংসার শিকার হওয়ার কথা বলেছেন, নতুন থেকে নতুনতর উপলব্ধি হয়েছে। মনে হয়েছে যৌনতার একমাত্রিক ধারনা নিয়ে কেবল কথা বললে কিছু মানুষ বাদ পড়ে যাবেন। তাই যৌনতার সঙ্গে সামাজিক লিঙ্গ (জেন্ডার) কেও একই সঙ্গে উচ্চারণ করতে হবে লিঙ্গ-যৌনতা (জেন্ডার-সেক্সুয়ালিটি) বলে। এও আসলে বোধ পরিবর্তনের এক সাক্ষী। দিন যত এগিয়েছে ‘স্বকণ্ঠে’-ও তত বিবর্তিত হয়েছে লিঙ্গ-যৌনতার বহুমাত্রিকতাকে সম্মান করে। এইখানে বহুমাত্রিকতার কথায় উঠে আসে আরও কিছু বিষয় যা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই যে তামাম এল-জি-বি-টি-আই-কে-কিউ-এইচ-এ+ গোষ্ঠী, উপগোষ্ঠী – তাঁদের জীবনযাপন আপন আপন বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। অতএব এদেরকে একই গোত্রের ধরে নেওয়া কাম্য নয়। একই মানুষের মনে বসবাস করে নানা সত্তা, যার প্রত্যেকটি যুক্ত তাঁদের জাত, ধর্ম, কর্ম, শ্রেণী, শিক্ষা, দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা, পরিবেশ ও স্থানের সঙ্গে। সেই কারণেই লিঙ্গ-যৌনতার ভিত্তিতে প্রান্তিক মানুষের আন্দোলনের সঙ্গে জাত, ধর্ম, কর্ম, শ্রেণী, শিক্ষা, দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা, পরিবেশ, স্থান ইত্যাদির নিরিখে প্রান্তিক গোষ্ঠীর আন্দোলনের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা চলছে যাতে নিজের অস্তিত্বকে চেনা যায় প্রান্তিকীকরণের বহুমাত্রিক বিভাজিকার (ইন্টারসেকশনালিটি) আতস কাঁচ দিয়ে। ‘স্বকণ্ঠে’ তাই সর্বাঙ্গীণ চেষ্টা চালায় নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনা করার। জোট বাঁধার কথা বলে ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী, জাতপাত বিরোধী আন্দোলনে, পথে নামার কথা বলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনে, সোচ্চার হয় সমস্ত হিংসার বিরুদ্ধে।
বহমানতাই জীবন – বারে বারে তা প্রমাণিত হয়েছে ‘স্বকণ্ঠে’-র পাতায়, বিষয়ের বৈচিত্র্যে। ‘স্বকণ্ঠে’ আজ লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। সমকালীন যৌনতার অধিকার আন্দোলনের ধারাবিবরণী ও রাজনৈতিক মতাদর্শের অবস্থান পরিবর্তনের এক চলমান দলিল। আজ সমকামিতা আর অপরাধ নয়, দেশের আইন আছে পাশে। কিন্তু সমাজ কি এত সহজে মেনে নেবে এত দিন ধরে যাদের প্রতি বিরূপ ছিল তাদের? দেবে কি সমান মর্যাদা? আইনের বলে বলীয়ান যৌন-প্রান্তিক গোষ্ঠী আজ ঘুরে দাঁড়ালে, অধিকার দাবী করলে, কোনও ঘৃণার অত্যাচারের শিকার হতে হবে না তো? সেই সঙ্কটের কল্পনা কি নিতান্তই অমূলক? তবে এমন আশঙ্কা যদি থেকেও থাকে ‘স্বকণ্ঠে’ কিন্তু নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে যাবে, ঠিক যেমন শুরুর দিনেও কেবলমাত্র সমকামিতাকে বিষয় করে ‘স্বকণ্ঠে’-র সাহসিক পদক্ষেপ আটকে থাকেনি। আচরণের, মতাদর্শের, চিন্তনের পরিবর্তন আত্মস্থ করে নেবার অভ্যাসই যে মানুষকে মানবিক করে সেই মন্ত্রই প্রচার কোরে এই পনেরো বছরে কখনও নিঃশব্দ হয়নি ‘স্বকণ্ঠে’-র স্বর। “ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত” বেজেই চলবে নিরবচ্ছিন্ন।