(আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় শুরু হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের কথা। যেখানে অন্তত তিন বছর ধরে চলা মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক-সংগঠকরা নিজেদের অভিজ্ঞতা-ভাবনার কথা লিপিবদ্ধ রাখছেন। দ্বিতীয় পর্বে কালধ্বনি পত্রিকা।)
মাত্র বছর দুয়েক আগেকার কথা। পত্রিকার অনিয়মিত এক আড্ডায়, উপস্থিত সব শুভানুধ্যায়ীদের মাঝখানে কোনও এক পরিচালক-সদস্য প্রস্তাব দেন, কালধ্বনি যখন চেনা মানুষের কাছে 'পুশ সেল' করা হয়, তখন সেই ক্রেতা মানুষটিকে কোনও এক 'সাম্মানিক' যেন প্রদান করা হয়। সাম্মানিক শব্দটি ব্যাখ্যাত হওয়ার আগেই তিনি জানান, বাজারে একাধিক বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকা ছাড়াও, কখনও ছোট পত্রিকা বা সাময়িক পত্রিকা এমনকি অণু পত্রিকা সংজ্ঞায় বিধৃত লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে তিনি ালধ্বনি কিনবেন কেন! স্টলে যখন পত্রিকা থাকে তখন কোন পত্রিকা তিনি কিনবেন, সে পছন্দ তাঁর। আমাদের আলাদা করে কোনও দায় নেই। কিন্তু হাতে হাতে ম্যাগাজিন বিক্রি করার সঙ্গে সঙ্গে আমি তো তাকে আমার কথা শোনার জন্য় ইনসিস্ট করছি। কথাটা কালধ্বনি পত্রিকার জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য এই কারণে যে ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে কালধ্বনির প্রথম সংখ্যা যখন প্রকাশিত হয় তখন তার মূল সূচিতে ছিল সমাজ সংস্কৃতি মূল্যবোধ নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ। সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে টেরি ইগলটনের ও ব্যক্তিত্বের বিভাজন নিয়ে গোর্কির প্রবন্ধ। বইয়ের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। সত্তর দশকের কবিতার সংক্ষিপ্ত পরিচয়পঞ্জী এবং সংবাদ-সংস্কৃতি বিভাগ। আর জানুয়ারি, ২০১৯ সালে প্রকাশিত সংখ্যায় গল্প, কবিতা এবং ১৯১৬-র নাগরিক সংশোধনী বিল বা এনআরসি সম্পর্কিত ৪০ লক্ষ বাঙালির উদ্বৃত্ত ঘোষিত হওয়া সংক্রান্ত একাধিক রচনা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় বিষয়বস্তুও ছিল তাই।
আরও পড়ুন, মেলা আছে, আছে লিটল ম্যাগাজিনও, কিন্তু…
লেটার প্রেস থেকে অফসেট। তিন টাকা থেকে মূল্য বেড়ে পঞ্চাশ টাকা। চব্বিশ পৃষ্ঠা থেকে অষ্টআশি পৃষ্ঠা।
অস্থির সে সময়। অস্থির আজও। কালধ্বনির পাতায় অনেকটাই ভিন্ন আজ সেই অস্থিরতার প্রকৃতি ও বিন্যাস, ভিন্ন পরিমাণ ও গুণগত মান। পত্রিকার পাতায় একাধিক সংখ্যা জুড়ে কখনও আলোচিত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কখনও বা নদী প্রবহমানতা ধ্বংসকারী বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ বা পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের সার্বিক বিরোধিতা।
সময় ও অবস্থান সাপেক্ষেই চেতনা। সত্যদ্রষ্টা নিরপেক্ষ নয়। দ্রষ্টার চেতনায় সত্য নিরূপিত নয়।
বিংশ শতাব্দীতে উচ্চারিত হয়, বস্তুর দ্বৈত অবস্থান। এমনকি 'নিশ্চিত জানা'র সম্ভাবনায়ও ছেদ পড়ে। 'আমি জানি না কেননা আমার জ্ঞান জগৎ সীমাবদ্ধ', এই বাক্যবন্ধের সঙ্গে আজ উচ্চারিত, 'জানা সম্ভব নয়'- এই সত্য বাক্যটিও।
পরিবর্তন এসেছে চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার সম্পর্কেও। চাহিদা এখন আর শুধু প্রয়োজনভিত্তিক নয়। উৎপাদিকা শক্তির ক্রিয়াশীলতায় এবং পুঁজির নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় বাজার সজ্জিত নব নব উদ্ভাবিত পণ্যে। প্রয়োজন নির্মিত হচ্ছে। এবং অবশ্যই চাহিদাও। চাহিদার নির্মাণ অধিকাংশ সময়েই প্রয়োজন এবং সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতিবিহীন। সদালভ্য উদ্ভাবিত পণ্যের বিপুল সম্ভার সজ্জায় আকর্ষিত মানবমন বা বিহেভিয়ারাল প্যাটার্ন প্রয়োজন-সামর্থ্যের বা মেটিরিয়াল সায়েন্সের গাণিতিক ও লজিক্যাল সম্ভাবনাসূত্রের আধারে বিধৃত নয়। লিপ্সা লুব্ধতা প্রলোভন। মায়ামুকুরে বিম্বিত আমি ও আমার অপর।
ব্যাপক অনিশ্চয়তা। যদিও একদা নিউটনের গতিশক্তি সম্পর্কীয় সূ্ত্রের প্রভাব লক্ষিত হয়েছিল, সমাজতন্ত্রের এবং সাম্যবাদের নিশ্চয়তা ঘোষণায়, সমাজতন্তর আর সাম্যবাদে উত্তরণ ঘোষিত হয়েছিল, ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা-অবস্থান নিরপেক্ষে, সেই স্বপ্ন-উচ্চারণ-কথা আজ অপসৃয়মাণ।
আজ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-র সম্ভাবনায়-আশংকায় দোদুল্যমান জীবন-যাপন। সংবেদী, সুবেদী, অনুভূতিপ্রবণ মনন অবিরাম ক্ষরণাক্রান্ত।
এক বিপন্নতা।
বাস্তবের অস্তিত্ব চেতনা নির্ভর। অন্যদিকে আবার আমার চেতনাই আমার অস্তিত্বের বোধ নির্মাণ করে। অস্তিত্ব যখন পরিবর্তনশীল সামগ্রিকতায় সম্পর্কিত, অস্তিত্বের অনুভবও সচল। সচল আমার অবস্থান। চেতনা, অবস্থান নির্ভর। জ্ঞান নির্ভর। জ্ঞান, দ্রষ্টার সঞ্চিত/অবহিত/অর্জিত/আরোহিত জ্ঞাপন নির্ভর। জ্ঞাপন সংশ্লেষণের ক্ষমতা নির্ভর। সংশ্লেষণ-সক্ষমতা ব্যক্তির মানসিক সচলতা নির্ভর। জ্ঞাপন-জ্ঞান-প্রজ্ঞার সতত ক্রিয়াশীলতায়, মনন উদ্ঘাটিত করে চলে সত্যর সাময়িক স্থিতি থেকে অখণ্ড অনন্ত স্থিতি সম্ভাবনা। অনন্ত অখণ্ডের অর্জন অসম্ভব। অনন্তে, ইনফাইনিটিতে ধাবন সম্ভব, পৌঁছানো সম্ভব নয়। টেন্ডস টু ইনফাইনিটি, বাট নেভার ইকোয়াল টু ইনফাইনিটি।
আরও পড়ুন, পাড়া-ক্রিকেট ও স্মৃতির যৌথভাণ্ডার
সত্য শেষাবধি অধরা। অব্যক্ত। সত্যর সাময়িক স্থিতি, রিফ্লেক্টিভ ট্রুথ, প্রাতিভাষিক সত্য।
শেষ কথা আমি বলি না। শেষ কথা আমি জানি না। সত্যর সাময়িক স্থিতি বা রিফ্লেকটিভ ট্রুথয়ের আধারেই আমার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া।
প্রান্তিক, অচেনা মানুষজনের অস্তিত্ব তো ছিল বরাবরই কল্পনাবৃত, তাদের সুখ-দুঃখ-অভাববোধ আমার অনুভূতিসঞ্জাত। তাদের চাওয়ার পাঠ, নির্মিত হত আমার পূর্বধারণায়। আমার গভীর বিরক্তি, এদের অমার্জিত অসংস্কৃত যাপনে।
আমার যাবতীয় অবহেলা, অশ্রদ্ধা এদের বাঁচার সহায়ক নয়। তারাও প্রত্যাখ্যাত করেছেন আমায়, উপেক্ষা করছেন আমার সংস্কৃত চাহিদা। ওদের, আমাদের, সবার চলনই সাধারণভাবে বহির্মুখী। আমার বাসনা, আমার তৃষ্ণার সঙ্গে মিল নেই কোনও, ওদের, ওই যুবক-যুবতীদের। সংকট আমার, মেনে নিতে পারি না, চোখের সামনে ওদের ওই অস্তিত্ব। অন্যদিকে, ওরা, ওরা নিজেদের সমাজ-সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের সংকট, বাসনার অতৃপ্তির জন্য দায়ী করে আমায়, যে আমি রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে কোনও না কোনও সম্পর্কসূত্রে জড়িত, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক। আমার চাওয়ায় সমাজ-স্থিতাবস্থা। ওরা সে দায়ে মান্যতা দেয় না।
কোনও এক ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া বর্ণন সবসময়েই বর্ণনাকারীর অবস্থান-নির্ভর। উপাত্ত থেকে বর্ণনাকারী তাঁর বোধ ও যোজকের ভিত্তিতে একটি জ্ঞাপন নির্মাণ করেন। দ্রষ্টা এখন নির্মাতা। নির্মাণ উপযোগিতা নির্ভর। কাদের জন্য নির্মাণ, কাদের হয়ে নির্মাণ, নির্মাণ সময়কালীন স্থানিক সুবিধা-অসুবিধা বা বিধিনিষেধ, বর্ণন-মাধ্যম ইত্যাদি তাঁর জ্ঞান-চেতনা-বোধকে সীমায়িত করে। সীমায়িত সেই জ্ঞান-চেতনা-বোধ সাপেক্ষে নির্মিত, সেই বর্ণন থেকে পাঠক-শ্রোতা-দর্শক যে উপলব্ধিতে পৌঁছলেন, সেই সত্য-দ্রষ্টা সাপেক্ষে, বর্ণন-নির্ভর খণ্ডিত এক সত্য। উপস্থাপিত/বর্ণিত সেই বাস্তব- বর্ণনকারীর বর্ণন নির্মাণ দক্ষতায় সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়।
বর্ণন-নির্মাণ-দক্ষতা যেহেতু বর্ণনকারীর স্থানিক অবস্থান আড়াল করে, অন্য-বাস্তবতা/অভিপ্রেত বাস্তবতা/ নির্মাণে সক্ষম - সুতরাং এই নির্মাণ দক্ষতা বিপণনযোগ্য। বিপণনযোগ্য, কেননা নির্মিত বাস্তবতা ব্যক্তি ও সামাজ-চেতনায় অভিঘাত/অনুরণন/আলোড়ন আনতে সক্ষম।
সরকার সমর্থ হয়েছে নির্মিত বাস্তবতায় এক সত্য নির্মাণে।
১৯৮৫ সালে প্রয়োজন বোধ করেছিলাম আমাদের জানাটা সোচ্চারে প্রকাশ করায়, বিশ্বাস ছিল জানার নিশ্চয়তায়, বোধহয় অন্যদের শিক্ষিত করায়, একা আমি, আমরাই একটা মিছিল। অনুসৃত যাত্রাপথ সহগমনকারী আমরা উৎক্রমণ করেছিলাম গলি অলিগলি গলিপথ গলিঘুঁজি নয়, চৌমাথা তেমাথা চক ক্রসিং নয়, ব্রিজ পুল সেতু কালভার্ট নয়, সড়ক সরণি অ্যাভিনিউ হাইওয়ে ছিল অনাবৃত সেই যাত্রাপথ। বীজতলা কৃষাণি খেতি, লাঙল ঢেঁকি, জারুল শিরিষ হরতুকি ঘোড়ানিমের বসত ছিল অপ্রাণ জীবন উপাদান, বিকাশোন্মুখ অভিদ্যোতক সমাজ মানসের অচলায়তন। মার্কসবাদী সমাজবীক্ষা ছিল সেদিনের নির্দিষ্ট অভিযাত্রা। পুরোগামী যাত্রা। অনুবর্তন যাত্রা।
আর আজ বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করতে করতে মনে হচ্ছে এই দেশ, এই মাটি, এই মানুষ, ও তার যাপন বৈচিত্র্য অনেকটাই চেনা বাকি। সে কথাটাই আজ কালধ্বনির কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাকে অস্বীকার করা। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ অস্বীকার করা। সমাজ-সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্যকে মননে ধারণ করা। গগনচুম্বী উন্নয়নের স্পর্ধিত প্রকাশের অবৈজ্ঞানিক ধারণা উন্মোচন করে চলা। এবং সর্বোপরি নিজের জানা ক্রমাগতই পরিশীলিত করে তোলা।
একমাত্র এভাবেই কালধ্বনি পত্রিকা সময়ের সঙ্গে বেঁচে থাকার কথা ভাবতে পারে। নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে।