২০০০ সালে, নতুনশতক যাত্রা শুরু করেছিল এক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে, কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে। আমাদের নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল পথশিশুদের জন্য স্কুল, দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের জন্য অবৈতনিক আঁকার ক্লাস, নানা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা ও পাঠচক্রের আয়োজন করা ইত্যাদি। এই সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় নতুনশতক। সে ছিল ট্যাবলয়েড আকারে স্টেপলার আটকিয়ে পত্রিকা করার দিন। সেখান থেকে শুরু করে আজকের ডিজিটাল কভারের স্বাস্থ্যকর সংখ্যা প্রকাশ করার পথ নেহাত কম চমকপ্রদ নয়।
সাধারণত ছোট পত্রিকার ইতিহাস অনেক ভাঙনের সাক্ষী হয়ে থাকে। কিন্তু অল্প কিছু ব্যতিক্রমও আছে। আমরা সেই মুষ্টিমেয়র দলে। নতুনশতক পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয় ২০০১ সাল থেকে। আর মনকলমের জন্ম ২০১০-এ। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে এই দুই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী একসঙ্গে পথ চলার সিদ্ধান্ত নেয়। দুই কাগজের সংযুক্তিকরণ ঘটে। বর্তমানে দুই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী এক। বছরে একবার নতুনশতক আর একবার মনকলম প্রকাশিত হয়। এছাড়াও অতীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কাগজ ‘কাফেলা’ আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল। আমাদের কাগজ মনে করে যুগ্মভাবে করলে যে কোনো কাজেরই শক্তি ও গতি বাড়ে।
আরও পড়ুন, ‘স্বকণ্ঠে’: এক অপ্রথাগত পত্রিকা
উনিশ বছর ধরে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা প্রকাশ করেছি আমরা। উদয়ন ঘোষ, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কাজ হয়েছে। তবে অনুবাদ হল এই পত্রিকার অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। আঞ্চলিক ভাষাগুলি তো বটেই, নিয়মিতভাবে বিশ্বসাহিত্যের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিককে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা আর ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে চলেছি। তাদের মধ্যে সাদত হসন মন্টো, অরুন্ধতী রায়, হারুকি মুরাকামি, পাওলো কোয়েলহো, মিলান কুন্দেরা সংখ্যা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মন্টো সংখ্যা সরাসরি উর্দু থেকে অনুবাদ করা হয়েছিল। কোয়েলহো সংখ্যায় অনূদিত হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ভেরোনিকা ডিসাইডস টু ডাই’। পুরোনো প্রায় প্রতিটি সংখ্যাই পাঠক সমাদরে নিঃশেষিত। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে এ কাগজে। নবারুণ ভট্টাচার্য্য, মণীন্দ্র গুপ্ত, বারীন ঘোষাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয়া মিত্র থেকে শুরু করে ইয়েহুদা আমিহাই, মারিও বেইয়াতিন, আন্দ্রে ভাইদা...কে নেই সেই তালিকায়! মূলত সাহিত্যপত্রিকা হলেও সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ও জায়গা পেয়েছে নতুনশতক মনকলমের পাতায়। ‘বেশ্যা’ নিয়ে প্রথম সংখ্যা করার সাহস দেখিয়েছি আমরা, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় সংখ্যা হয়েছে সন্ত্রাস নিয়ে। পরিবেশ, মানুষের মন ইত্যাদি বিষয় নিয়েও চর্চা হয়েছে। মনকলমের সাম্প্রতিকতম সংখ্যাটি আধারিত হয়েছে উর্দু সাহিত্যিক ইসমত চুগতাই-এর ওপর। সাধারণত বছরে একটি বিশেষ সংখ্যা এবং একটি সাধারণ সংখ্যা প্রকাশ করে নতুনশতক মনকলম। সাধারণ সংখ্যায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সবই থাকে। বিশেষ সংখ্যার লেখাগুলি মূলত আমন্ত্রণমূলক। তরুণ লেখকদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক লেখাপত্র ছাপতে বেশি আগ্রহী আমরা।
আরও পড়ুন, প্রতিরোধের সিনেমা: চলার পথে ছ’টা বছর
শুধুমাত্র বছরে দুটি সংখ্যা প্রকাশ করে বাকি সময় বসে থাকা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। সারা বছর ধরে নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে এই কাগজ। ছোটগল্প আমাদের পত্রিকার অন্যতম আগ্রহের বিষয়। বিভিন্ন সময়ে রাজ্যের নানা জায়গায় গল্প নিয়ে ওয়র্কশপ আর আলোচনাসভার আয়োজন করে চলেছি আমরা। নবারুণ ভট্টাচার্য, সাধন চট্টোপাধ্যায়, সুরঞ্জন প্রামাণিক, অভ্র বসু, শুভময় মণ্ডল, মধুময় পাল প্রমুখ বক্তব্য রেখেছেন আমাদের পত্রিকার বার্ষিক অনুষ্ঠানে। বিগত পাঁচ বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিনের ঘনিষ্ঠ মানুষদের ‘নতুনশতক মনকলম সম্মাননা’ প্রদান করা হচ্ছে। প্রচ্ছদ শিল্পী থেকে সাহিত্যিক, কবি থেকে সম্পাদক অনেকেই রয়েছেন সম্মাননা প্রাপকের তালিকায়। বার্ষিক অনুষ্ঠান ছাড়াও রাজ্যের নানা জায়গায় প্রায় প্রতি মাসে সাহিত্যসভার আয়োজন করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি লেখক-পাঠক ইন্ট ্যাকশনে, তাই বইয়ের দোকানে বিক্রির চেয়ে মেলায় বসে সরাসরি পাঠকের সাথে আদানপ্রদানে আগ্রহী হই বেশি। বাংলা আকাদেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা, সমন্বয় মঞ্চ আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা(কলেজ স্ট্রীট) এবং কোলকাতা বইমেলায় প্রতিবছর প্রতিদিন আমাদের কাগজের টেবিলে আড্ডা জমান আমাদেরই প্রিয় পাঠক-গ্রাহক-লেখক বন্ধুরা । কিছু জেলার মেলাতেও টেবিল নেওয়া হয়। এছাড়া কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর, চন্দননগর, মানকুণ্ডু, বর্ধমান, শিলিগুড়ির বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্রে পাওয়া যায় আমাদের পত্রিকা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হয়েছে ফেসবুকে নিজস্ব প্রোফাইল। আর ভিন্ন ধারার সাহিত্য চর্চায় আগ্রহী বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ।
বিশুদ্ধ লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক আমরা। তাই আমাদের নতুনশতক মনকলম সরকারি বিজ্ঞাপন বিবর্জিত। সাহিত্য আকাদেমির বিজ্ঞাপনও আমরা ছাপতে অস্বীকার করেছি কালবুর্গী, দাভোলকার, পানেসর প্রমুখের হত্যাকাণ্ডের পর, প্রতিবাদস্বরূপ। সরকারি পুরস্কারের জন্য আবেদন নিবেদন করায় আমরা বিশ্বাস করিনা। মনে করি, গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলে পাঠক নিজেই পত্রিকা কিনে পড়বেন। পত্রিকার গ্রাহকও হওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে পাঠক-গ্রাহকদের জন্যই এ পত্রিকা উনিশ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশ পেয়ে আসছে, কখনো ছেদ পড়েনি। এছাড়া আমাদের নতুনশতক প্রকাশনী নামে সংযুক্ত একটি প্রকাশনাও আছে। যার মূল উদ্দেশ্য অসৎ প্রকাশকদের হাতে বন্ধু কবি-লেখকদের হেনস্থা হওয়া রোধ করা। অবাণিজ্যিক পন্থায় অথচ আইএসবিএন সহ বই প্রকাশ করতে এই প্রকাশনা তরুণ লেখকদের যাবতীয় সহায়তা করে।
সম্প্রতি আরো কিছু লিটল ম্যাগাজিনের সাথে একত্রিত ভাবে আমরা শুরু করেছি ভিন্ন ধারার গল্পচর্চার এক প্ল্যাটফর্ম ‘গল্পবিকল্প’, তার প্রথম সারাদিনব্যাপী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮, চন্দননগরে। নবীন-প্রবীণ বহু গল্পকার সেই অনুষ্ঠানে এসেছেন, গল্পপাঠ ছাড়াও হয়েছে গল্প নিয়ে চুলচেরা আলোচনা, গল্পবিষয়ক প্রবন্ধ পাঠ ইত্যাদি।
আরও পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিনের কথা: কালধ্বনি
দীর্ঘ উনিশ বছরের পথচলায় আমরা আমাদের লিটল ম্যাগাজিন চরিত্রকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা জারি রেখেছি, সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছি লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা যে কোনো সমাবেশে। লিটল ভেক ধরা বাণিজ্য পত্রিকা সম্পর্কে সতর্কও থাকতে হয়েছে। দুঃস্থ লিটল ম্যাগাজিন কর্মীর পাশে দাঁড়ানো থেকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি যথাসাধ্য। কলকাতার পথশিশুরা মনের আনন্দে তৈরি করেছে আমাদের কাগজের প্রচ্ছদ। সবসময় সঙ্কীর্ণ রক্ষণশীলতায় আটকে না থেকে নিত্যনতুন বদল আনতে চেয়েছি পত্রিকার চেহারায়, বিষয় ভাবনায়। এমনকি আমাদের সম্পাদকমণ্ডলীতেও বহুবার নানা সংযোজন বিয়োজন ঘটেছে। কাগজ করতে গিয়ে দেখেছি, অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন, সম্পাদকের একার পত্রিকা হিসেবে বেরোয়, ফলে কোনো কারণে সম্পাদকের অবর্তমানে পত্রিকার অস্তিত্ব রক্ষাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। নতুনশতক মনকলম কিন্তু সম্পূর্ণভাবে দলগত খাটনির যৌথ ফসল। তাই অসংখ্য মানুষ যখন একে ‘আমাদের কাগজ’ বলেন, আমরা তৃপ্ত হই।
কোনো মেলায় নিছক কৌতূহল বশে আমাদের পত্রিকার কোনো একটি সংখ্যা কিনে নিয়ে যাওয়া পাঠক যখন পরের বছর সাগ্রহে আবার খুঁজতে আসেন ‘এবার নতুন কী বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন?’ তখন তাঁর তৃপ্তিটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। যে কোনো লিটল ম্যাগাজিনের নিরন্তর ও চিরকালীন যাবতীয় লড়াইয়ের মধ্যে সৃষ্টিসুখে মেতে থাকার এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কী হতে পারে! গতিময়তা বজায় রেখে নতুনশতক মনকলম এক বিশুদ্ধ সাহিত্যপত্র - এই পরিচয়ে সক্রিয় থাকুক দীর্ঘদিন, এটাই আমাদের স্বপ্ন।