(বাংলা ভাষায়, মুদ্রিত মাধ্যমে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস খুব কম দিনের নয়। সে ইতিহাসের সঙ্গে লেগে থাকে অনেকরকমের অভিজ্ঞতাও। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা সে অভিজ্ঞতাসমূহের বিবরণ প্রকাশ করতে শুরু করেছে কয়েক সপ্তাহ ধরে।)
খুব হিসেব কষে আমরা ‘প্রতিরোধের সিনেমা’ পত্রিকা বার করতে শুরু করিনি। এক অর্থে, আমাদের সংগঠন ‘পিপল্স ফিল্ম কালেকটিভ’-এর কাজের প্রয়োজনেই এই পত্রিকার জন্ম। যারা আমাদের কালেকটিভের কাজের সাথে পরিচিত তারা জানেন যে আমরা প্রত্যেক বছর জানুয়ারি মাসে একটি বার্ষিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে থাকি - কলকাতা পিপল্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের গোড়ায়। সেই উৎসবে আমরা কিছু কাহিনিচিত্র (ফিকশন)-এর সঙ্গে দেখিয়েছিলাম সাম্প্রতিক কালে আমাদের দেশে তৈরি তথ্যচিত্রের একটি বড় সম্ভার। তথ্যচিত্র দেখানো সম্বন্ধে আমরা প্রথম থেকেই খুব স্পষ্ট ছিলাম। নান্দনিক পরীক্ষানিরীক্ষা ও বিষয়বস্তু, এই দুই দিক থেকেই ভারতীয় তথ্যচিত্রের জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ দর্শকরা তা দেখতে পান না। আমরা সেই জায়গাটি পূরণ করতে চেয়েছিলাম আমাদের উৎসবের মাধ্যমে। আর, তার সাথেই চেয়েছিলাম সম্পূর্ণত জনগণের সহযোগিতায় আয়োজিত জনগণের চলচ্চিত্র উৎসবের পরিসরকে আমাদের চারপাশের সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ে খোলামেলা আলোচনার স্পেস হিসেবে গড়ে তুলতে। বা বলা যেতে পারে সিনেমাকরিয়ে-সিনেমাদেখিয়ে-সিনেমাকর্মীদের এক জায়গায় আসার মঞ্চ হিসেবে গড়ে তুলতে। সেই ছবি দেখানোরই অংশ হিসেবে আমরা ‘প্রতিরোধের সিনেমা’ পত্রিকাটি প্রথম বার করি। যেখানে উৎসবে দেখানো ছবির বিবরণ দেওয়ার কথা ছিল। যার সঙ্গে থাকবে সিনেমা নিয়ে কিছু লেখা। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল পত্রিকাটি নিছক ‘ফেস্টিভ্যাল বুক’ হওয়ার বদলে হয়ে উঠল সিনেমা বিষয়ক একটি পুরোদস্তুর পত্রিকা।
আরও পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিনের কথা: কালধ্বনি
প্রথম বছরের পত্রিকাটি সম্পাদনা ছিল কস্তুরীর। সেবারের পত্রিকাটিতে খুব কম সময়ের নোটিসে তথ্যচিত্রনির্মাতা সঞ্জয় কাক লিখেছিলেন ভারতের স্বাধীন তথ্যচিত্র নিয়ে। লেখাটি এতটাই ভালো হয়েছিল যে পরবর্তীকালে যখন আমাদের মধ্যে দু’জন (কস্তুরী ও দ্বৈপায়ন) ভারতের তথ্যচিত্রের ইতিহাস নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই-এর সম্পাদনা করি তখন আমরা সঞ্জয়কে বলি ওঁর আগের প্রবন্ধটির বর্ধিত রূপ লিখতে। কিন্তু সঞ্জয় কাক, আরেক বন্ধু পরিচালক নকুল সিং সওহনী, ও কালেকটিভের কর্মীরা ছাড়া আর কোনও লেখকই সেই সংখ্যায় তথ্যচিত্র নিয়ে লেখেন নি। তখনও পত্রিকার নিজস্ব চরিত্র তৈরি হয়নি।
আমরা চারশ’ কপি পত্রিকা ছাপিয়েছিলাম। এক মাসের মধ্যেই প্রায় সব কপি শেষ। উৎসব চত্বরেই এর সিংহভাগ বিক্রি হয়েছিল। সেটা আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছিল। ফলে পরের বছর বেশ অনেকটা আগে থেকেই আমরা পত্রিকার পরিকল্পনা শুরু করি। সম্পাদকমণ্ডলীতে যোগ দেয় দ্বৈপায়ন। ঠিক করি আমাদের পত্রিকার চরিত্র হবে কালেকটিভের কাজের চরিত্রের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ এবং আমরা পত্রিকায় মূলত জোর দেব রাজনৈতিক চোখে তথ্যচিত্র বিষয়ক লেখালিখির ওপর। যদিও এর সাথে ফিকশন সিনেমা, বিকল্প সাংস্কৃতিক কর্মসূচী, কাউন্টারকালচারের ওপর লেখাও থাকবে। চতুর্থ সংখ্যা থেকে পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে যোগ দেয় তৃণা।
এই প্রসঙ্গে ভারতে তৈরি তথ্যচিত্র নিয়ে লেখালিখির অবস্থা নিয়ে কথা না বললেই নয়। ২০১৩ সালে যখন আমরা পিপল্স ফিল্ম কালেকটিভ শুরু করি তখন ভারতের তথ্যচিত্রের এক লাইব্রেরি বানানো ও অতীত-বর্তমানের প্রচুর তথ্যচিত্র দেখার পাশাপাশি আমরা খোঁজ শুরু করি ভারতীয় তথ্যচিত্র বিষয়ক লেখাপত্রের। দ্রুতই আবিষ্কার করি যে চলচ্চিত্র গবেষক বি ডি গর্গের একটি বই ছাড়া সেই সময়ে এই বিষয়ক আর একটি বইও বাজারে নেই। তাও সে বইটিতেও সাম্প্রতিক স্বাধীন তথ্যচিত্র নিয়ে আলোচনা নেই। এর পর ২০১৬ সাল নাগাদ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এই বিষয়ে কয়েকটি অ্যাকাডেমিক বা আধা-অ্যাকাডেমিক বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া, ইংরেজি খবরের কাগজ ও ওয়েব-পোর্টালে ধীরে ধীরে তথ্যচিত্রের রিভিউ প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলা খবরের কাগজে সেটাও হয় না।
বাংলায় ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন আর ফিল্ম বিষয়ক ‘সিরিয়াস’ লেখালিখি একই সময়ে শুরু হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। এ কথা সত্যি যে এমন কি নির্বাক যুগেও বাংলার সেই সময়ের পরিচিত লেখকরা সিনেমা বিষয়ে লেখালিখি করেছিলেন। কিন্তু তা ছিল নেহাতই খাপছাড়া আর ‘নন-সিরিয়াস’। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির চিদানন্দবাবুদের কাছে সিনেমা বিষয়ক লেখালিখির মূল অভিমুখ ছিল সিনেমাকে একটা ‘শিল্প মাধ্যম’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা। যদিও ষাটের দশকে, জেলা-ভিত্তিক সিনে সোসাইটি পত্রিকার পরিসরে এবং বিশেষ করে সিনে ক্লাব অফ ক্যালকাটা পত্রিকার সিনেচর্চায় রাজনীতিকে কলা-কৈবল্যের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটা সমান্তরাল রীতি চালু হয়। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সিনে সোসাইটির পত্রিকায় তথ্যচিত্র বিষয়ক লেখালিখি বিশেষ স্থান পেত না। সেটা তাঁরা যে ধরনের ছবি দেখাতেন বা দেখাতে পারতেন তার সাথে জড়িত ছিল। সেই দিক দিয়ে দেখলে ভারতে কেবলমাত্র তথ্যচিত্র বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশিত হত পল জিল্স বলে এক একদা-নাজি তথ্যচিত্র-পরিচালক ও পরবর্তীকালে ভারতে ‘সরকারি তথ্যচিত্র পথিকৃতের উদ্যোগে। পত্রিকার নাম ছিল ‘ইন্ডিয়ান ডকুমেন্টারি’। বিষয়গত ভাবে দেখলে, ‘ইন্ডিয়ান ডকুমেন্টারি’-র পরে ‘প্রতিরোধের সিনেমা’ সম্ভবত সারা দেশে মূলত তথ্যচিত্র-কেন্দ্রিক একমাত্র নিয়মিত পত্রিকা।
আরও পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিনের কথা: আয়নানগর
আবারও বলি, ভারতীয় তথ্যচিত্র ও তথ্যচিত্র দেখানোর পরিসর নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি আমরা ফিকশন সিনেমা নিয়েও যে লেখা প্রকাশ করিনি তা নয়। আর সিনেমা ব্যতিরেকে অন্যান্য যে যে শিল্পমাধ্যমে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তব নিয়ে কাউন্টার-ন্যারেটিভের নির্মাণ হচ্ছে আমরা সেইসব নিয়েও লেখা সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি। ভারতীয় বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসে সংস্কৃতির ব্যবহারও আমাদের দীর্ঘকালীন এক আগ্রহের জায়গা। ফলে সেই বিষয়ক লেখা ও সাক্ষাৎকারও নিয়মিত ভাবে আমাদের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
একটা সমস্যা প্রথম থেকেই ছিল। তা হল নতুন লেখকের সন্ধান পাওয়া। যেহেতু আমরা এমন একটা বিষয় নিয়ে লেখালিখির পরিসর নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম যা নিয়ে সাধারণত লেখা হয় না বললেই চলে, তাই সেটাও একটা সমস্যার বিষয় ছিল বটে। তাই আমাদের পত্রিকায় অতীতের সিনে-সোসাইটির পত্রিকায় যারা লিখতেন বা চলচ্চিত্রবিদ্যার যারা শিক্ষক-গবেষক, তারা ছাড়াও আমাদের নিজেদের সদস্যরা, তথ্যচিত্র-নির্মাতা এবং সাংস্কৃতিক-কর্মী বন্ধুরা নিয়মিত কলম ধরেছেন। এই ভাবে যারা লিখেছেন তাদের অনেকেই আবার ভিন্ন বিষয়ের গবেষক বা ভিন্ন শিল্পমাধ্যমের কর্মী, ফলে লেখার বিষয়ে সিনেমা বা শিল্পকে দেখার এক অন্যরকমের চিত্র যে ফুটে ওঠেনি তা নয়।
সিনেমা দেখার পাশাপাশি আমাদের কাছে প্রথম থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব্যাপক জনগণের মধ্যে অন্যধারার সিনেমা দেখানো, আর যুগপৎ সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতার কথা জানা-জানানো। সেই জন্য প্রথম থেকেই ভারতের তথ্যচিত্রের নির্মাতা বা কুশলীদের সাক্ষাৎকারই শুধু আমরা প্রকাশ করিনি। চেষ্টা করেছি তথ্যচিত্র দেখানোকে ঘিরে যে ব্যক্তি বা সংগঠনেরা কাজ করেছেন তাদের অভিজ্ঞতাকে জানতে, বুঝতে।
পরিশেষে বলার যে, পত্রিকায় লেখা বা সম্পাদনা করা এক জিনিষ আর সেটাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে শুরু করে এখনও অবধি আমরা কখনও ৫০০ কপি ছেপেছি, আবার কখনও ৮০০ কপি ছেপেছি। বইমেলা ছাড়াও কলকাতা ও অন্যান্য জেলা সদর ও মফস্বলের যে দোকানগুলোতে ছোট পত্রিকা রাখে সেখানে আমরা আমাদের পত্রিকা বিক্রি করছি। বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিচিত বইয়ের দোকান থেকেও পাঠক আমাদের পত্রিকা নিচ্ছেন। এর বাইরে একটা সুবিধে আমাদের আছে, যা হয়তো অনেক ছোট পত্রিকার থাকে না। পত্রিকার মূল বিক্রি হয়েছে আমাদের সংগঠনের গড়ে তোলা পরিসরে, অর্থাৎ পিপল্স ফিল্ম কালেকটিভের মাসিক তথ্যচিত্র প্রদর্শনী ও বার্ষিক পিপল্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের লাগোয়া স্টলে। কালেকটিভের প্রকাশনা হওয়ার কারণে সদস্যরা বিতরণের ক্ষেত্রে যৌথ দায়িত্ব নিয়েছেন। বিশেষ করে কালেকটিভের পক্ষ থেকে যাবতীয় বই ও ডিভিডি বিতরণ-ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র আমাদের সহযোদ্ধা নির্মাল্যর স্থৈর্য্য, পরিশ্রম, হিসেব রাখার ঈর্ষণীয় ক্ষমতা ও হাতযশ এই বিষয়ে এক বড় ভূমিকা রেখেছে। নিয়মিত পাঠকের সংখ্যা উৎসাহব্যঞ্জক হলেও একেবারে যে সব সংখ্যার সবক’টি কপি বিক্রি হয়েছে এমন নয়। সমস্যা আরও আছে। অনেক পাঠকই থিম পুজোর ধাঁচে ‘থিম লিটল ম্যাগাজিন’ কিনতে চান। যেটা অনেক সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার কাজে লাগবে। আমাদের পত্রিকায় ‘বিশেষ সংখ্যা’র ধারণাটাই নেই যেটা ‘থিম সংখ্যা’র ধাঁচে। এই ধরনের ক্রয়-অভ্যাস বা পাঠ্যাভ্যাস অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি করে। কিন্তু, এহ বাহ্য, মূল সমস্যা হল বাংলা সমান্তরাল পত্রিকার জগতের একটা ছোট বৃত্তে আটকে যাওয়া। সেই বৃত্তকে ভাঙার কাজটা জরুরি এবং পরিশ্রমসাধ্য। আমাদের মনে হয়েছে যে বিতরণের ভিন্ন ও সৃজনশীল পদ্ধতি খোঁজার আর সমান্তরাল পাঠক তৈরি করার সেই জরুরি ও পরিশ্রমসাধ্য কাজে সবাই মিলে হাত দেওয়া দরকার। একলা একটা পত্রিকার দ্বারা এই বৃহৎ কাজ হওয়ার নয়।