(লিটল ম্যাগাজিনে অনেক সময়েই এমন অনেক লেখা প্রকাশিত হয়, যা মনোযোগের দাবিদার। তা সে সাহিত্য হোক, কি রাজনীতি অথবা সমাজনীতি। এমন সব পত্রিকা থেকে বাছাই করা লেখা হুবহু আমরা তুলে আনতে শুরু করছি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার পোর্টালে।
'আরেক রকম' পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র। তাঁর মৃত্যুর পরেও সে পত্রিকা বহমান। আপাতত সম্পাদনার দায়িত্বে রয়েছেন শুভনীল চৌধুরী। রয়েছে একটি সম্পাদক মণ্ডলীও।)
আন্তর্জাতিকতাবাদী থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী ভারত
দেবর্ষি চক্রবর্তী ও দেবজিৎ ঠাকুর
বুদাপেস্ট শহরে দানিয়ুব নদীর তীরে একটি পার্ক রয়েছে। নাম নেহরু পার্ক। ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর নামাঙ্কিত এই পার্ক আজও কেউ বুদাপেস্ট শহরে গেলে দেখতে পাবেন। ১৯৫৬ সালে যখন হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় তখন ভারতবর্ষ ছিল প্রথম গুটিকয়েক দেশের মধ্যে একটি যারা হাঙ্গেরিতে সোভিয়েতের সেনা পাঠানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং তারপরে সোভিয়েত এবং বিদ্রোহী হাঙ্গেরীয়দের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করে। হাঙ্গেরির ঘটনা যখন ঘটছে তখন অন্যদিকে গোটা দুনিয়া উত্তাল সুয়েজ সংকটকে ঘিরে। ভারতবর্ষ সুয়েজ সংকট শুরু হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিশরের উপর পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির আক্রমণের কড়া নিন্দা করে কিন্তু হাঙ্গেরির বিষয়ে নেহরু সরকারের পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত সতর্ক।
নেহরু সরকার যখন সন্তর্পণে এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হয় যে এটি কোন ফ্যাসিস্ট উত্থান নয়, বরং এই বিদ্রোহের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত ‘জাতীয় চরিত্র’ আছে, তখন তারা সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং সেখানেই থেমে না থেকে তারা জাতিসংঘের হস্তক্ষেপও দাবি করে। যদিও সেই হাঙ্গেরি বিদ্রোহের প্রাক্কালে নেহরুর তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন মহাম্মদ আতাউর রহমান, যিনি তৎকালীন ভারতীয় রাজদূত ছিলেন বুদাপেস্টে। তিনি এবং মস্কোতে অবস্থিত ভারতীয় রাজদূত কেপিএস মেনন সোভিয়েত এবং হাঙ্গেরির বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে থাকেন, সঙ্গে সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করেন যাতে বিদ্রোহীরা কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন। পরবর্তীকালে সোভিয়েত-উত্তর হাঙ্গেরির প্রথম প্রেসিডেন্ট হন যে আর্পাদ গনজ, যিনি ৫৬’র বিদ্রোহের অন্যতম সৈনিক ছিলেন, ভারতবর্ষে এসে বলেন, "১৯৫৬ সালে ভারতীয় দূতাবাস বিপ্লবের দূতাবাস হয়ে উঠেছিল।"
স্বাধীন ভারতের এই বৈদেশিক নীতি জহরলাল নেহরুর একার কোনো কৃতিত্ব নয়। আমরা যদি স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, কিভাবে সেই ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে আন্তর্জাতিক সংহতির উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে। যে দু’জনের কথা প্রথমেই বলা যেতে পারে - গোপাল হুদ্দুর এবং ডঃ দ্বারকানাথ কোটনিস। গোপাল হুদ্দুর তাঁর প্রথম জীবনে মহারাষ্ট্রে থাকাকালীন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য ছিলেন। তারপরে তিনি ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে চলে যান এবং সেখানে কমিউনিস্টদের সংস্পর্শে আসেন। স্পেনে যখন রিপাবলিকান এবং ফ্যাসিস্টদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি রিপাবলিকানদের হয়ে লড়াই করতে যান। ১৯৩৬ সালে ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তাঁকে কারাবাস করতে হয়।
স্পেন থেকে তিনি যখন ভারতবর্ষে ফেরেন ১৯৩৮ সালে, তখন তাঁর ভারতে পদার্পণের মুহূর্তে বোম্বে শহরের ট্রেড ইউনিয়নসমূহ একটি সংবর্ধনার আয়োজন করে। সেই সংবর্ধনা সভায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন, "ভারতবর্ষ এবং স্পেনের সংগ্রামের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। স্পেনকে ধ্বংস করছে মুসোলিনি এবং ফ্রাঙ্কোকে সেই ব্রিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদই সাহায্য করছে যারা ভারতবর্ষকে শোষণ করছে। স্পেনের মতই এখানে শ্রমিক, কৃষক এবং মধ্যবিত্ত জনতার মধ্যে ব্যাপক ঐক্য গড়ে তুলে এই সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।" হুদ্দার পরবর্তী সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন এবং তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে যান।
অন্যদিকে, দ্বারকানাথ কোটনিস সম্ভবত আন্তর্জাতিক সংহতির বিষয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম ভারতবর্ষের ইতিহাসে। চীনে জাপানি আক্রমণের সময়ে যে মেডিক্যাল টিম চীনা প্রতিরোধ বাহিনীকে সহায়তা করতে যায়, ডঃ কোটনিস সেই দলের সদস্য ছিলেন। পাঁচজনের এই দলের বাকিরা ফিরে এলেও কোটনিস এবং তাঁর এক সহকর্মী থেকে যান, এবং জাপানি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় কয়েক হাজার সৈনিকের প্রাণরক্ষা করেন। কোটনিস ও তাঁর চৈনিক স্ত্রী তাঁদের সন্তানের নাম রাখেন ইনহুয়া (ইন-ভারত, হুয়া-চীন)। কোটনিস জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর এই মহৎ আত্মবলিদানের কাজ জারি রাখেন, এবং তিনি মারা যাওয়ার পর, মাও-সে-তুং তাঁর শোকবার্তায় লেখেন, “...আমাদের জাতি তার এক পরম বন্ধুকে হারালো আজ।“
নেহরু 'হিন্দি-চীনি ভাই ভাই' এই স্লোগান দেওয়ার বহু আগেই কেদিহুয়া (ডঃ কোটনিসকে চীনারা ভালবেসে যে নামে ডাকতেন) তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মেহনতি মানুষের হৃদয়ের ঐক্য স্থাপন করে গেছিলেন। যখন একদিকে কোটনিস জীবন বাজী রেখে চীনের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তখন সাভারকর বোম্বে শহরে লিফলেট বিলোচ্ছিলেন চীনে জাপানের নৃশংস নানকিং গণহত্যার স্বপক্ষে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, সাভারকরদের এই ফ্যাসিস্ট প্রচার ভারতের সংগ্রামী জনমানসে বিন্দুমাত্র দাগ কাটতে পারেনি। কোটনিস, হুদ্দার, মানবেন্দ্র রায়রা ভারতের জনগণের মধ্যে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গীর যে ধারার ভিত্তিপ্রস্তর স্তাপন করেন, তা স্বাধীনতার পরেও বহমান থেকে যায়।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই আন্তর্জাতিক সংহতির ধারা ভারত খাতায় কলমে স্বাধীনতা পাওয়ার আগে থেকেই তার বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। যখন ব্রিটিশ সরকারের হুকুমে ভারতের সেনাবাহিনী ১৯৪৬ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ডাচদের উপনিবেশ পুনরুদ্ধার করতে ব্যস্ত, তখন ভারতের অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নেহরু তাঁর সমর্থন জানান ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিসংগ্রামের প্রতি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার ঠিক পরপরই ভারতবর্ষ দিল্লীতে এশিয়ান রিলেশনস কনফারেন্সের আয়োজন করে, যাকে ১৯৫৫ বান্দুং কনফারেন্স বা তৎপরবর্তীতে নির্জোট আন্দোলনের পূর্বসূরী বলা যেতে পারে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, যখন পশ্চিমী দেশগুলিতে জল্পনা চলছে যে আদৌ ভারত যুক্তরাষ্ট্র টিকবে কিনা কিংবা ভারতবর্ষের কোনো গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত আছে কিনা, তখন ভারত শুধু একটি জোরালো গণতান্ত্রিক কাঠামোই গড়ে তুলছিল তাই নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে একটি নির্ভীক এবং স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্র সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীও গ্রহণ করেছিল। কোটি কোটি অনাহারক্লিষ্ট, অশিক্ষিত জনগণের দেশ হয়েও কিভাবে ভারতবর্ষ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন সংগ্রামে প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করল, প্রয়োজনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করল, তা আজও অনেকের কাছেই বিস্ময়ের।
১৯৪৯ সালে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ব্লকের বাইরে প্রথম দেশ হিসেবে চীনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারতবর্ষ। সেখানেই ভারত থেমে থাকেনি, এরপর যখন জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাইওয়ানকে সরিয়ে জনগণতান্ত্রিক চীনকে স্থান দেওয়ার প্রশ্ন আসে তখন পশ্চিমী দেশগুলির অন্যায় টালবাহানার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার হয় সেই ভারতবর্ষই। কোরীয় যুদ্ধের সময়ে ভারতের উত্থাপন করা প্রস্তাবনা জাতিসঙ্ঘে বিনা বাধায় গৃহীত হয়। তারপর ভারতের নেতৃত্বেই জাতিসঙ্ঘের ‘নিউট্রাল নেশনস রিপ্যাটরিয়েশন কমিশন’ কোরীয় যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করে এবং দুইপক্ষের প্রায় কুড়ি হাজার যুদ্ধবন্দীর শান্তিপূর্ণ প্রত্যার্পণের বিষয়টি দেখভাল করে।
এরপরে ১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ সংকট এবং হাঙ্গেরির বিদ্রোহ প্রায় একই সময়ে ঘটে, তখনই ভারতবর্ষের জোটনিরপেক্ষ নীতির সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ আসে, যা ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির আদর্শগত অবস্থান থেকে একবিন্দুও না সরে সামাল দেয় - দুইক্ষেত্রেই যারা আক্রমণকারী তাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান গ্রহণ করে।
ভারতবর্ষের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ৭১-এর মার্চে মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। যে অভূতপুর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, যার ফলে প্রায় এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতবর্ষে চলে আসতে বাধ্য হন, ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। ভারত সরকার একদিকে যেমন তার সীমানা উন্মুক্ত করে উদ্বাস্তুদের এপারে ঠাঁই দেয়, তেমনি তারা বিভিন্ন দেশের সামনে, জাতিসঙ্ঘের সামনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে।
হাজার প্ররোচনা সত্ত্বেও, প্রাথমিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী না পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তান সংকটকে একটি আন্তর্জাতিক সংকটের রূপ ধারণ করতে দেয়, এটিকে ভারত পাকিস্তানের কোন দ্বিপাক্ষিক বিষয় (কাশ্মীরের ক্ষেত্রে যেটি ১৯৪৮ সালে হয়ে পড়ে) হতে দেয়নি। কোনো তৃতীয় শক্তি আক্রমণ করতে পারবে না এটা সুনিশ্চিত করে এবং পাকিস্তানকে ভারতের উপর প্রথম আঘাত হানতে দিয়ে ভারত সরকার গোটা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সামনে পাকিস্তানকে আক্রমণকারী হিসেবে প্রতিপন্ন করে। তারপরেই পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠায়। শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৫ দিনের লড়াইয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী ঢাকা দখলে সফল হয়। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
এই প্রত্যেকটি ঘটনাই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা উত্তর বৈদেশিক নীতির অত্যন্ত সম্মানজনক এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই বৈদেশিক নীতি কোনো ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। এই নীতি একইসঙ্গে সামরিক শক্তি নির্ভরও নয়, কারণ ভারত রাষ্ট্র সেই সময়ে কোনো বড়ো সামরিক শক্তিই হয়ে ওঠে নি - তার কাছে না ছিল সুবিশাল সেনাদল, না ছিল পারমাণবিক অস্ত্র, না ছিল উন্নত সামরিক প্রযুক্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ঐতিহ্য, অহিংসার প্রতি যে অঙ্গীকার, সেখান থেকে যে জাতীয় আদর্শ প্রস্তুত হয়েছিল তা কোটি কোটি ‘অশিক্ষিত’ জনগণের মধ্যেও সুবিশাল আদর্শনৈতিক ছাপ ফেলে।
এই আদর্শ শুধুমাত্র ভারতে নয়, ভারতের বাইরেও যেখানে যেখানে অনাচার, অবিচার, অত্যাচার দেখা গেছে, তার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণকে উদ্বেলিত করেছে, বাধ্য করেছে প্রতিবাদ করতে। ১৯৬০-এর উত্তাল দশকে ভারতবর্ষের রাজপথ বারবার সাক্ষী থেকেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরূদ্ধে ছাত্র-যুবদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের। কিংবা প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে যে জনমত গড়ে উঠেছিল ভারতে সেই সময়ে, সেটিও লক্ষ্যণীয়। এই রাজপথের সংগ্রামগুলি ভারত সরকারের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। ভারত সরকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয় এবং বরাবর ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে দুই-রাষ্ট্র নীতিকে মান্যতা দিয়ে এসেছে।
কিন্তু আজকে এই বিষয়গুলিকে নিয়ে কথা বলা কেন প্রয়োজন? প্রয়োজন কারণ, ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মোদী সরকার যা করছে, সেটিকে বাদ দিলেও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে যা করেছে, সেটি তুলনাহীনভাবে আমাদের দেশকে পিছনদিকে ঠেলে দিয়েছে। অভূতপূর্বভাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেভাবে নাক গলিয়েছে, দাদাগিরি ফলিয়েছে, তাতে ভারতবর্ষের দুই স্বাভাবিক মিত্র দেশই আজ চীনের দিকে সরে গেছে। অন্যদিকে ইজরায়েলের সঙ্গে মুখ্যত সামরিক আদানপ্রদান বাড়িয়ে যে সখ্য তৈরি করেছে ভারত, তাতে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে নিয়ে চলা দুই-রাষ্ট্র নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধুমাত্র তাই নয়, মোদী ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান যিনি ইজরায়েল পরিদর্শনে গিয়ে প্যালেস্টাইন না গিয়ে ফিরে এসেছেন - বার্তা স্পষ্ট যে ভারত আর প্যালেস্টাইনের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করে না।
একইসঙ্গে বিপজ্জনকভাবে ভারত আমেরিকার দিকে ঢলে পড়েছে পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক চুক্তি সাক্ষর করে, নির্লজ্জভাবে এই সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতিকে লঙ্ঘন করেছে। শুধু তাই নয়, এই মুহূর্তে আমেরিকা-চীনের বিবাদে ভারত দক্ষিণ এশিয়াতে আমেরিকার বোড়েতে পরিণত হয়েছে, ফলে একদিকে উত্তপ্ত হচ্ছে চীনের সঙ্গে চলতে থাকা সীমান্ত বিবাদ, অন্যদিকে চীন আরও বেশি বেশি করে পাকিস্তানের দিকে সরে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মত অঞ্চলে, যেখানে পাশাপাশি তিনটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ রয়েছে, সেখানে এই বিপজ্জনক বৈদেশিক নীতি হারাকিরির সামিল।
পুলওয়ামার ঘটনার পরে যেখানে সমগ্র পৃথিবী ভারতবর্ষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে ভারত সরকার সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের উপর সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি না করে পাকিস্তানে গিয়ে বোমাবর্ষণ করে এল। এই বোমাবর্ষণে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলির খবর অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদী আখড়াগুলোর কোন ক্ষতি না হলেও, গোটা দুনিয়ার সামনে ভারত আজ আগ্রাসনকারী হিসেবে পরিচিত হল। শুধু তাই নয়, এই বোমাবর্ষণের পরের ঘটনাবলী আরও লজ্জাজনক, যখন ভারতের বিমানবাহিনীর এক পাইলট পাকিস্তানে ধরা পড়লেন, তারপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বারবার করে শান্তির বার্তা দিলেন, এমনকি সেই পাইলটকে ছেড়েও দিলেন, তাতে দেশের মাথা আরও নত হল, কারণ যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শান্তি প্রস্তাব দিচ্ছেন তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, শাসক দলের নেতারা দেশজুড়ে যুদ্ধজিগির তুলছেন আর তাতে যোগ্য সঙ্গত করছে দেশের বিক্রি হয়ে যাওয়া মিডিয়া।
এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রশ্ন করলেই দেশদ্রোহী হিসেবে দেগে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তবু প্রশ্ন উঠছে। সত্যিই কি এই বিমান হানার ফলে জঙ্গি হামলা তথা পাকিস্তানের জঙ্গি মদতের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব? বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন যে বিমান হানার মাধ্যমে জঙ্গি আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব নয়। আবার ভারতের বিমানহানার পরের দিন পাকিস্তান ভারতের সীমানা উল্লঙ্ঘন করে বোমা বর্ষণ করে প্রমাণ করেছে যে তারাও প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুত। পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ এক ভয়াবহ পরিনাম বয়ে আনবে দুই দেশ তথা গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য। তাই বিমান হানা বা যুদ্ধ করে কোনো সমাধান সম্ভব না। দুই দেশকেই আলোচনার টেবিলে বসতেই হবে। সন্ত্রাসবাদ, পাকিস্তানের ভূমিকা, কাশ্মীর, সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেই হবে। আন্তর্জাতিক মহলে চাপ তৈরি করতে হবে পাকিস্তানের উপর যাতে তারা সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেওয়া বন্ধ করে।
অন্যদিকে, কাশ্মীরে ২০১৬ সাল থেকে বিজেপি সরকার যে প্রকট অত্যাচারের নীতি নিয়ে চলছে তাকে নিন্দা করতে বাধ্য হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, এমনকি জাতিসঙ্ঘও। আজকে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে কাশ্মীরে ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের পাশবিক ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। কাশ্মীরের সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান হতে পারে না। এখানেও আবারও রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু বিজেপি’র উগ্র-হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলমান বিদ্বেষ এই পথে হাঁটতে রাজি নয়। তারা মনে করছে সেনাবাহিনির মদতে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান সম্ভব। সেনাবাহিনির উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা বারবার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন। কিন্তু কাকস্যপরিবেদনা!
পরিতাপের বিষয়, এই একদেশদর্শী, আগ্রাসী এবং সামরিকশক্তি নির্ভর জাতীয়তাবাদ ভারতবর্ষের পররাষ্ট্র বিষয়ক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল, যা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। স্বাধীনতা উত্তর বৈদেশিক নীতিও আগ্রাসী ছিল, সাহসী ছিল, কিন্তু সেই আগ্রাসন ছিল বিউপনিবেশিকরণ, ন্যায় এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
('আরেক রকম' পত্রিকার ১৬-৩১ মার্চ, ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত)