…মাত্র এ অতীত লিখে
বাকি যত প্রাণ ও ধারণ
সম্ভব কি হতো, যদি
আমার মৃত্যুর পার থেকে
ও রকম না তাকাতে-
পুজো পুজো রোদ, হাসিখুশি?’
কী লিখব? যত দিন যাচ্ছে, শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে মাথা। কে যেন একটু আগে বলল, ফোনে, তোর মনে আছে মিতুল, সেই সেবার শান্তিনিকেতনে, দিব্যেন্দুদা বলছেন, কই আমি তো পড়িনি, কী বই আছে মিতুলের? পিনাকীদা বলল, কেন, আছে তো, বিদূষক ও সৌদামিনী, পড়ে নিলেই পারেন। কী কাকতালীয় দেখ, দুজনই আজ…
আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। কয়েকটা ছবি, খুব আবছা। ঘরে অসুস্থ এক কবি। আমি বারান্দায়। সামান্যই আলো। একটু দূরে, বাইরের লনে একা বসে সুনীলদা। বাকিরা কবিতা পড়তে চলে গেছে। সুনীলদা চুপ করে অন্ধকার মাঠের দিকে তাকিয়ে। আমিও চুপ, কথা বলার থেকে না-বলা কখনও কখনও জরুরি, এটুকু জেনে গেছি ততদিনে। জেনে গেছি নৈঃশব্দ্যের ভাষা। হয়তো তাই, অন্য কোনো ছবি আমার মাথায় সেভাবে গেঁথে নেই আর।
আজ সকালে মন্দাক্রান্তা, মানে মিঠি, যখন ফোন করে, স্ক্রিনে ওর নামটা দেখেই শিরশির করে উঠল গা। পিনাকীদা যে থাকবে না, আমরা দুজনেই তা জেনে গেছি আরও আগে। তখন আমি ফেসবুক থেকে বেশ খানিকটা বাইরে, মিঠির ফোনেই প্রথম জানতে পারি, পিনাকীদা ভালো নেই। ব্রেন ম্যালেরিয়া। পিজি-তে নিয়ে যাচ্ছিল সুদীপরা, রাস্তায় অবস্থা এত খারাপ হয় যে তৎক্ষণাৎ ব্যারাকপুরে টেকনো গ্লোবাল হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সেই থেকে, যমে-মানুষে। সুদীপ, দিব্যেন্দু, শিবাশিসদা, তন্ময়, ওদেরও যুদ্ধ চলছিল। অবস্থার একটু উন্নতি হওয়াতে পিজি-তে নিয়ে যাওয়াও গেছিল শেষ অব্দি। কিন্তু ওখানে গিয়ে নিউমোনিয়া হয়ে গেল আবার। পরশু, সবে বাসে উঠেছি, একটু আগে ভালোমতো চোট পেয়েছি হাঁটুতে, কোথাও একটা বসতে চাইছি, ঠিক তখন মিঠির ফোন, আর টেন পার্সেন্ট চান্স মিতুল। ওর কান্না আমার কোনোদিনই সহ্য হয় না, এত অসহ্য সংক্রামক কান্না ওর, আমি ফোন কেটে দিয়ে কলাকার স্ট্রিটের ফুটপাথের দিকে মুখ ঘুরিয়ে। অসহায় লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম, পিনাকীদাকে আর দেখতে পাব না। বাড়ি ফিরে সুদীপকে ফোন করি। সুদীপ বলে, প্রার্থনা করছি আমরা মিতুলদি। একটা সামান্য জ্বর থেকে কী হয়ে গেল!
‘বিরহবেদনা সইতে কলঙ্কবটিকা তবে ভাল?
বনের পাখিটি এসে যে সোনার খাঁচায় তাকালো
সে খাঁচা ধাতুর নয়, ম্যাজিকলণ্ঠনে তৈরি, সে খাঁচা সন্ধ্যায়
বন্ধনে জড়ায় রোজ, ডাকে, ‘বন্ধু আয়’…’
আমিও তো একদিন, ম্যাজিকলণ্ঠনে তৈরি শহরের সোনার খাঁচা থেকে ‘বন্ধু আয়’ শুনেই ছুটে গিয়েছিলাম। একই মফস্বলের আলোহাওয়া আর বাজারহাটের গন্ধের মধ্যে বড় হওয়া, আমাদের দুজনের। অথচ কলকাতায় দেখাশোনা, পড়াও। অনেকদিন অব্দি জানতামও না, কোথায় থাকে পিনাকীদা। একদিন জিজ্ঞেস করাতে বলল, বাঁশবেড়িয়া। আমি বললাম, আরে! এত কাছে থাকো নাকি! কিছু বলেনি, একটু হেসেছিল। সেদিন থেকে মনে হত, কোথাও একটা আমরা একইরকম। কথা না বলায়। কথা বলতে না পারায়। জেনেছিলাম, বাবা নেই। খুন হয়ে গেছেন। মা আছেন। সংসারের হাল ধরতে লড়াই করতে দেখেছি। তার মধ্যেও ‘কাহ্ন’র জন্য লেখা চেয়েছে, শিবাশিসদার সঙ্গে নিয়মিত বের করেছে কাগজটা। সেইসঙ্গে কৃত্তিবাসের কাজ। সকাল সকাল বেরিয়ে, রাতের ট্রেনে বাড়ি ফেরা। তার মধ্যেও লিখে গেছে, সেইসব অমোঘ লাইন, যার প্রতিটি অলিগলি, আলো-অন্ধকার, আমার চেনা –
‘তারিখ পালটিয়ে গেছে। শেষ বাস। ভাত নয়, বরফ।
গলির লালুয়া ভুলু টমি লাকি মিতা টের পায়
কার পা চলেছে, ওই মোড় ঘুরল, চিঠির বাক্সয় হিজিবিজি
তাগাদা, বিয়ের পত্র, বিল, বুকপোস্ট – কোনো খামে
সে হাতের লেখা নেই…
পা চলেছে সিঁড়ি টপকে, আর যেন কেউ
কাঁচা ঘুম ভেঙে গিয়ে না দেয় বিরক্তি, অভিশাপ।…’
আমি যখন লিখতে আসি, নব্বই দশকের একেবারে শেষদিকে, নব্বইয়ের কবিরা তখন কলকাতা কাঁপাচ্ছে। বাংলাবাজার শব্দটা তখনও আমাদের পাতে পড়েনি। তখন একসঙ্গে কবিতা পড়া, আড্ডা, আর ওই আড্ডাটুকুর লোভে বন্ধুর বাড়ি হামলে পড়া, এসব ছিল। ছিল বন্ধুদের কবিতা মুখস্থ বলতে পারারও দিনকাল। মনে পড়ে, এরকম কত জায়গায় পিনাকীদার মুখে ‘পুত্রার্থে’ বা ‘প্রার্থনা’ শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্থই হয়ে গিয়েছিল। আমারও ঠোঁট নড়ে উঠত, যখন শুনতাম, ‘তাসের ম্যাজিক, হস্তরেখার ফুটপাথবই প’ড়ে কোন্ পাপী / মেয়েদের হাতে রাহু, কোমলতা, কেতু টিপে দ্যাখে বিয়ে-বৌভাতে, / উল্লুক সেজে মহিলা মহলে কে হাসি ফোটালো: ‘এ মা অসভ্য’… / সদা লেকচার লম্বা-চওড়া, পাড়ার নাটকে পার্ট ভোলে কে রে?’ তারপর একসময়, আমাদের দেখাশোনা কমে আসতে লাগল। ছড়িয়ে গেলাম সবাই, যে যার মতো। অর্কুট, ফেসবুক, ঢুকে পড়ল আমাদের জীবনে। বাংলাবাজার ঢুকে পড়ল। দলাদলি। কবিতার রাজনীতি। পিনাকীদাকে অথচ কখনও দেখিনি এই ভার্চুয়াল জগৎটায়। দূরে থেকেছে, কৃত্তিবাসে থেকেছে, ভালোই করেছে। শেষ দেখাও কৃত্তিবাসেরই এক সভায়, পৌলমীও চলে গেল তো, ওরই স্মরণসভা ছিল। অংশুমান বলেছিল আমায় গান গাইতে। কী গাইব কিছুই ঠিক করিনি, পিনাকীদার হাতে দেখি পৌলমীর বই, তার থেকেই একটা কবিতা স্টেজে উঠে সুর করে গেয়ে দিই। বইটা ফেরত দিয়ে বললাম, ঠিক ছিল গানটা? আবারও সেই হাসি। সেই শেষ। রোগা লাগছিল একটু। আর কিছু মনে হয়নি তো!
আজ এই হাত-পা ঠাণ্ডা করে দেওয়া শীত, মিঠির ফোন, বাংলা একাডেমি, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণীর ঘাট, দাহপর্ব – সবকিছুর শেষে, দুটো লাইন মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চাই শুধু –
”তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু’: আকুল শীতের
হাওয়া: ‘অন্তত একটাও কথা রাখো’-
কী হবে সে বাড়ি ফিরে, যদি তুমি কখনও না থাকো?’