দৃশ্য ১
"মা ওকে টিফিনটা খাইয়ে দিও কিন্তু। জোর করে হলেও।" ব্যাগটা গোছাতে গোছাতে বললো নন্দিনী তপাদার। নন্দিনীর বাড়ি বজবজে। একাই থাকে তিন বছরের কন্যা রুক্মিণী আর বিধবা মাকে নিয়ে। পতি-অবহেলিত ঠিক বলা চলে না। কারণ স্বামী নিরুদ্দেশ। তাও, হুমম, হয়ে গেল নয় নয় করেও বছর তিন সাড়ে তিন তো বটেই। তখন মামন, মানে রুক্মিণী, পেটে। ছ'সাত মাসের ভরা পোয়াতি নন্দিনী। থানা পুলিশ, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন, স্টেশনে স্টেশনে পোস্টার মারা, সবই করেছিল। কিন্তু শুধু আসল মানুষটাই আর ফিরে আসে নি।
দৃশ্য ২
একেবারে হাভাতে না হলেও, বেশ নিম্নবিত্ত পরিবারেরই মেয়ে ছিল নন্দিনী। বাপের আদরের একমাত্র কন্যা। দ্বিতীয়টি আনার চেষ্টাও করেনি তার বাপ। কারখানার চাকরিটা অবশ্য ছিল। তবু মাইনেটা এতটাই আকাশছোঁয়া ছিল যে নুন আর পান্তা একসাথে সহাবস্থান করত মাসের প্রথম চার থেকে পাঁচদিন। তবু কোনও এক আশ্চর্য উপায়ে মেয়ের জন্য রোজ এক পিস্ মাছের বরাদ্দের ব্যাবস্থা করে ফেলত নন্দিনীর বাবা। আর সেই আশ্চর্য উপায়টা যখন নন্দিনীরা জানতে পারল, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। কারখানার হাড়ভাঙা খাটনির পরে লাগোয়া স্টেশন চত্বরে মুটের বোঝা টানতে টানতে, ছাতু জল খেয়ে পেট ভরানো পিলে রুগী অলোক তপাদার, মানে নন্দিনীর বাবার রাজরোগ তখন শেষ পর্যায়ে। নন্দিনীর পড়াশুনা আর বাপের সৎকার একই দিনে শেষ হয়েছিল, তখন তার বয়স ন'বছর। ক্লাস টুয়ের ছাত্রী।
বিধাতা বড়ই কৌতুকপ্রিয়। ধনী ঘরেও অনেক সময় এতটা রূপের ঘটা দেন না, যতটা মাঝেমধ্যে হাভাতে ঘরে দিয়ে দেন। নন্দিনীর ঐ রূপটুকুই ছিল সম্বল। সংসারের হাল ধরতে নন্দিনীর মা, রূপালী দেবী ধরেছিলেন পাঁচ বাড়ির ঠিকে ঝিয়ের কাজ। তেমনিই একটি বাড়ির মালকিন ছিলেন যোগমায়া দেবী। কত্থকশিল্পী যোগমায়া আচার্য। নন্দিনীকে পছন্দ করতেন খুব। বিনি পয়সায় নাচ শেখাতেন। বলতেন, "রূপালী, দেখো এ মেয়ে বড় হয়ে শুধু নেচেই লক্ষ লক্ষ লোকের মন জয় করবে। স্বয়ং মা সরস্বতী ওর ওপর ভর করেন নাচের সময়ে।"
দৃশ্য ৩
ইভনিং ব্যান্ডে কস্মিনকালেও তেমন রোজগারপাতি হয় না কলকাতায়। কিছু তথাকথিত ভদ্রজন আসেন, গান শোনেন, নাচ দেখেন পেগ দুয়েক খেতে খেতে। তাতে টিপসের বহরও ঐ তাঁদের দু'পেগ মদের মতোই নামমাত্র। একটু পুরোনো গেস্ট হলে চোখে চোখে একটু প্রেমালাপ সারতে সারতে ঐ মেরে কেটে পাঁচশো। না হলে একশো থেকে দেড়শো টাকার মতো প্যালা পড়ে প্রতিটা মেয়ের ওপরে। সিঙ্গাররা একটু ফাটিয়ে গান গাইলে তো আরও কম। চার ফুট বাই পাঁচ ফুট পরিসরে, বক্ষবিভাজিকায় ঝড় তুলেও ঐ হয়তো কারো ক্ষমা ঘেন্না করে ভিক্ষের দান পঞ্চাশটা টাকা। যার মধ্যে ব্যান্ড লিডারকে আদ্ধেক দিয়ে হাতে পড়ে থাকে পঁচিশ টাকা।
নাইটের কাজের সবচেয়ে বড় সুবিধে হলো পয়সা। বেশ মোটা টাকা আসে। মোটামুটি নব্বই শতাংশ লোকই বেশ কিছুটা মদ বাইরের সাধারণ জায়গা থেকে খেয়ে আসে। ডান্সিং বারে এসে খুব বেশী হলে দু'পেগ কী তিন পেগ নিয়ে বসে। ডিসকো আলো আর নেশার ঘোরে চার ফুট বাই পাঁচ ফুটে যৌন আবেদনময়ী পোষাকে নন্দিনীর মতো আরও অসংখ্য মেয়েকে জন্নতের হুর মনে হয় মাতালগুলোর। মালিক হওয়ার লোভে নোটের বান্ডিল ওড়ায়। চলে অন্য কাস্টমারের সাথে রেষারেষিও। নন্দিনীরা নিজেদের মধ্যে হাসে। স্টীলের রেলিঙে ভর দিয়ে আরও একটু ঝুঁকে, চোখের ইশারায় কাস্টমারকে আরও প্রলুব্ধ করতে থাকে। পঞ্চাশের নোটের বান্ডিল নিয়ে কাস্টমারদের মধ্যে ছোটাছুটি করতে থাকে ব্যান্ডের নোটবয়রা।
ব্যান্ড লিডারকে অন্যভাবে খুশী করতে পারলে, ব্যান্ড লিডারই শাঁসালো গেস্ট ধরিয়ে দেয়। বা চোখের ইশারায় দেখিয়ে দেয় মালদার পার্টি। তারপরের কাজ ডান্সারের। যত প্রলুব্ধ করবে, তত টিপস্। আর বাইরে যাওয়া মেয়েদের তো সোনায় সোহাগা। বাইরে যাওয়া মানে, গেস্টের সাথে হোটেলে সময় কাটানো। অবশ্য সেটা সারাদিনের জন্যও হতে পারে বা সারারাত। গেস্ট একটু বয়স্ক হলে দিনের বেলাই তছনছ করে মেয়েগুলোর শরীর। আর রাতের দিকে হলে, অল্প বয়সী ছোকরা গেস্ট। নন্দিনীর পক্ষে রাতের দিকে যাওয়া সম্ভব নয়। বাচ্চাটার জন্য। দিনের বেলা গেছে বেশ কয়েকবার। মন্দ হয় না রোজগার। মোটামুটি স্টার মার্কা হোটেল বা রিসর্টেই নিয়ে যায় গেস্টরা। হাজার পনেরো পাওয়া যায়। পিক আপ, ড্রপ আর খানাপিনা তো থাকেই।
প্রথমবার আলোর মধ্যে পরপুরুষের সামনে উলঙ্গ হতে লজ্জা পেয়েছিল নন্দিনী। কিন্তু প্রায় বাপের বয়সী অনীশ চ্যাটার্জী এতটাই ভালগার আর কামুক স্বভাবের ছিলেন যে সে বেশীক্ষণ লজ্জা পাওয়ার অবকাশ পায় নি। তবে এটাও মনে আছে, প্রথমবারের অভিসারের পরে বাড়ি ফিরে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে সাবান দিয়ে বারবার ঘষে ঘষে চ্যাটার্জীর জিভের দাগ তোলার চেষ্টা করেছিল সে...পাগলের মতো। তবু পরপর দু'রাত মদ খেয়েও ঘুম আসে নি নন্দিনীর। খালি মনে হতো, চ্যাটার্জী ক্রমাগত তার শরীরের ত্বক আর গর্তগুলো জিভ দিয়ে চেটে খাচ্ছে নির্লজ্জের মতো।
দৃশ্য ৪
যোগমায়া আচার্যের বাড়িতে ঠিকে ঝি হয়েই ঢুকেছিল নন্দিনীর মা। নন্দিনীর তখন সবে দশ। মাঝেমাঝে যেত মায়ের সাথে। আসলে স্বামীর মৃত্যুর পরে সর্বস্ব খোয়ানো রূপালী তপাদার, ভাড়া বাড়ি ছেড়ে জমানো হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে খালধারের বস্তিতে একটা এক-কামরার ঘরে উঠে আসার মতো ক্ষমতা রাখতে পেরেছিলেন। দিনের বেলা তাও হয়তো একটু নিশ্চিন্ত মনে এ বাড়ি সে বাড়ি বাসন মাজার কাজ করতে পারলেও, রাতগুলো বড়ই ভয় কাটত। প্রায় রোজই আশেপাশের ঘরের পুরুষগুলো এক গলা মদ গিলে এসে "আবে শালী দরজা খোল" বলে স্ত্রীকে হাঁক মারতেন। অভিভাবকহীন রূপালী তপাদার, বাপ মরা মেয়েটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে শুয়ে থাকতেন দরমার দরজাটা একটা আদ্ধেক খালি টিনের ট্রাঙ্ক দিয়ে চেপে। নন্দিনী সেই সময় রোজ শুনতে পেত, মায়ের বুকে ট্রেনের আওয়াজ।
মাসখানেক পরে মেয়ের স্তন ওঠার পর থেকে, মেয়েকে আর একা রেখে কাজ করতে যাওয়ার সাহস পেতেন না, সাথে করে নিয়ে যেতেন কাজের বাড়িগুলোতে। তেমন ভাবেই যোগমায়া দেবীর বাড়িতে যাতায়াত শুরু নন্দিনীর। প্রথম দিকে জানলার অন্যদিক থেকে উঁকি মেরে দেখত যোগমায়া দেবীর নৃত্য প্রশিক্ষণ। প্রায় মাস দুয়েক একলব্য-যথা শিক্ষার পরে, একদিন বাড়ি ফিরে গোধূলীর পড়ন্ত আলোয় মাকে কত্থকের গণেশ বন্দনা আর আমদ দেখায় হুবহু যোগমায়া দেবীর স্টাইলে। আহ্লাদিত রূপালী পরের দিনই মালকিনকে দাঁত বের করে বলে ফেলেন সে কথা।
বেনারসের একদা রঈস্ বাঈজী কামিনী বাঈয়ের জারজ কন্যা যোগমায়ার হীরে চিনতে দেরি হয় নি। রূপালীর পদোন্নতি ঘটে যোগমায়া দেবীর কলাকুঞ্জ বাড়িতে। ঠিকে ঝি থেকে রাত দিনের লোক। সাথে সকন্যা খাওয়া পরা আর হাজার টাকা মাইনেও। বছর ঊনিশের নন্দিনী শিক্ষান্তে, প্রথম স্টেজ শোয়ের পরে পেয়েছিল কলকাতা-জোড়া নাম আর অপ্রত্যাশিত অঙ্কের টাকাও। নাচের একটা শোয়ের জন্যই এলাহাবাদে গিয়েছিল নন্দিনী। সেখানেই আলাপ হয়েছিলো তরুন তবলচি বিবেক শর্মার সাথে, যাকে পুরো উত্তর ভারত এক নামে চেনে। তখনই লোকে বলাবলি শুরু করেছিল, জাকির হোসেনের পরে নতুন তবলিয়াদের মধ্যে বিবেকই সেরা।
দৃশ্য ৫
দুপুর তিনটে পঞ্চান্নর ট্রেনে আরও বেশ কিছু সিঙ্গার-ডান্সাররাও কলকাতা আসে নন্দিনীর সাথে। ট্রেনটা টালিগঞ্জ স্টেশনে এলেই ওরা নেমে লাগোয়া রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন থেকে মেট্রো নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে মূলত মধ্য কলকাতার বিভিন্ন বারে। কেউ রেস্টরুমে গিয়ে সাজগোজ ঠিক করে মাইকে প্রণাম করে গলায় আনে সুরঝঙ্কার। আবার কেউ পোষাক পরিবর্তন করে হয়ে ওঠে বার ডান্সার, ঈষৎ খাঁজখোঁজ প্রদর্শিত জন্নতের হুর।
ইভনিং ব্যান্ড পাঁচটা থেকে শুরু হলেও ছটার আগে তেমন করে কোনও বারেই লোকজন আসে না। ফলে ছটা নাগাদ ব্যান্ড লিডার 'শিরদিওয়ালে সাইবাবা' গানের সুর তোলা শুরু করলে, নন্দিনী কড়া করে একটা ভদকা মেরে ব্রায়ের হুকটা আরেকটু টেনে, নিজের বক্ষবিভাজিকাকে আরেকটু দীর্ঘ করার চেষ্টা করতে থাকে রোজ। দিল্লীওয়ালি মেয়েরা নিজেদের মধ্যে গা টেপাটেপি করে হাসলেও, নন্দিনী জানে বাঙালি মেয়েদের শরীরের একটা নমনীয় ব্যাপার আছে। আঁচল গুটিয়ে দড়ি করে শরীরে পেঁচিয়ে রাখলে নাভি পেট বুকের অনাবৃত অংশে যে যৌনতার হিল্লোল ওঠে, সেটা দিল্লীওয়ালি বা জাঠরা মাইক্রো মিনি স্কার্টে চেষ্টা করেও আনতে পারে না।
মোটামুটি সাতটা নাগাদ স্টেজ পায় নন্দিনীরা কোমর দোলানোর জন্য। তার আগের সময়টা ইভনিং গেস্টগুলোকে ফোন করে ডাকতে থাকে নিয়ম করে নন্দিনী। ভাগ্যে যে রোজই চেনা গেস্ট লেখা থাকে তেমনটা নয়। তবে সপ্তাহে এক-দুদিনের জন্য শরীরের হাল্কা পাসপোর্ট পাওয়া ব্যান্ড লিডার শাকিব ভাই রোজই নন্দিনীর শ'পাঁচেক টিপসের ব্যবস্থা করে দেয় নিজের ক্ষমতাবলে। নন্দিনী হাসে মনে মনে। বেশ্যা না হয়েও বেশ্যার মতোই ওকে চটুল দৃষ্টিতে প্রায়ই মন ভরাতে হয় অচেনা নতুন গেস্টদের।
দৃশ্য ৬
বিবেকের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম হয়েছিল নন্দিনীর। হয়তো বিবেকেরও। যদিও বয়সের ফারাক ছিল। তবে কোনোদিনই কোনো বাধাই বাধা হয়ে আসে না প্রকৃত প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে। বিবেকরা ব্রাহ্মণ, নন্দিনীরা একে অন্য জাত, তায় নীচু ঘর। তবু ততদিনে নন্দিনীর প্রেমে পাগল বিবেকের সিদ্ধান্ত বদল করতে পারেনি তার পরিবার। ফলে চার হাত এক হতে সময় লাগেনি দুজনের। বিবেক ততদিনে শুধু নামকরা তবলিয়াই, পয়সাওয়ালা নয়। কিন্তু নন্দিনী ততদিনে প্রায় লাখ দশেকের মালকিন। স্টেজ আর টিভি তো আছেই। কয়েকটা ফিল্মেও ডান্স ডিরেক্টরের কাজ করেছে। ফলে বাড়ি থেকে ত্যাজ্যপুত্র করলেও বিবেকের অসুবিধে হয়নি। কলকাতায় একটা ছোট ফ্ল্যাটের ব্যবস্থাও হয়ে গেলো রাতারাতিই।
প্রথম কয়েকটা মাস বেশ ভালোই চলেছিল। শুধু খুশী হননি যোগমায়া দেবী। নন্দিনীকে দু'তিনবার বলেছিলেন, কাজটা ঠিক করেনি সে। কিন্তু নন্দিনী বহু মাথা খাটিয়েও বুঝতে পারেনি তার ভুলটা কী হয়েছে। প্রায় অশিক্ষিত নন্দিনীকে সত্যিই তো ভালোবাসত বিবেক। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেও নন্দিনীর হাত ধরেছিল। বিবেক ততদিনে আস্তে আস্তে সংসারী হয়ে উঠছিল। নিজের উদ্যোগে নন্দিনীর চেনাজানা জায়গাগুলোতে যোগাযোগ করে কাজও পাচ্ছিল। কিন্তু টাকা খরচ হতো নন্দিনীর ব্যাগ থেকেই। প্রতিদিনই বিবেক বলত, টাকা জমাচ্ছে বাচ্চার জন্য। কারণ বিয়ের মাস দুয়েকের মধ্যেই বিবেক নন্দিনীর গর্ভে আগামীর বীজ পুঁতে দিয়েছিল। বিবেক ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে। হয়তো কিছুটা অচেনাও। হঠাৎই একদিন....
দৃশ্য ৭
মুনশাইন বারের ম্যানেজার ইমরানের চরিত্রটা জলের মতোই তরল হলেও, নন্দিনীর প্রতি একটা আলাদা দুর্বলতা আছে। সে মনেপ্রাণে নন্দিনীর নেকনজরে থাকার চেষ্টা করে। নন্দিনী বোঝে সবই। কিন্তু চার বাচ্চার বাপের যে শুধু শরীরের ক্ষিদে, সেটাও বুঝতে ভুল হয় না তার। যদিও নগ্ন হতে হতে, এখন আর যৌনক্রীড়ায় অংশগ্রহন করার জন্য তেমন কোনও আলাদা কারণের প্রয়োজন পড়ে না নন্দিনীর। তবু আরও একটু বেশি রোজগারের আশায় সে রোজই, 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' মার্কা একটা ব্যবহার করে ইমরানের সাথে। ইমরানও রোজ আশায় থাকে, তার কনুইতে নন্দিনীর স্ফীত স্তনের একটু আলগা ছোঁয়া পাওয়ার।
নাইট শিফ্টের বারে যাওয়ার সময় প্রায়ই কোনও না কোনও গেস্ট সাথে সাথে যায়। ফলে প্রায়ই পেট ভরা একটা স্ন্যাক্স পেয়েই যায় নন্দিনী। আসলে এই গেস্টগুলোর বুকে আর পকেটে অতটা দম নেই হাজার পনেরো-বিশ খরচা করে তাকে হোটেলে নিয়ে যাবে। তারা ঐ পথচলতি একটু হাতটা ছোঁয়া, একটু আঙুল ধরা অবধিই দৌড়তে পারে। এতেই ওদের শান্তি। আর হয়তো নন্দিনীরও। ইভনিং শিফ্টে সিঙ্গাররাই ফুটেজ খেয়ে যায়। কিন্তু নাইটে ডান্সাররাই আসল। সিঙ্গাররাও থাকে বটে, কিন্তু স্টেজ বেশীক্ষণ পায় না। নাইটে খুব কমই বৌ-পালানো, প্রেমে চোট মার্কা মাতালরা আসে। নাইটের গেস্টরা রসিক। এরা আবেগী নয়। এরা টাকার হিসেবটা ভালো বোঝে। কিন্তু সেটার চেয়েও ইজ্জতের দাম এদের কাছে মহামূল্যবান। নতুন কোনও আনকোরা গেস্ট, কোনও মেয়ের দিকে হাজারের বান্ডিল ওড়ালে, এরকম গেস্টগুলো কল্পতরু হতে লেট করে না। নন্দিনীদের পকেট ভর্তি হতে থাকে। সংসার চালানোর খরচ বেরিয়েও, কাঁচা টাকায় কেনা সোনার গয়না ওঠে শরীরে। আমিরী ঠাটবাট দেখানোর রেস্ত জমা হয়।
নাইটের ব্যান্ডলিডার স্বরূপ দে'র চরিত্র ইস্পাত কঠিন। তিনি দলের কোনও মেয়ের দিকে খারাপ চোখে তাকিয়েছেন, এমনটা চরম শত্রুও বলতে পারবে না। কিন্তু প্রফেশনালিজম এতটাই যে দলের মেয়েদের নিরপত্তা নিয়েও অত ভাবেন না। যাদের পিক আপ-ড্রপের ব্যবস্থা নেই, তাদের একাই ফিরতে হয়। রাত নামলে কলকাতা তার চরিত্র পাল্টায়। নন্দিনীকে যদিও একা ফিরতে হয় না, কারোকে না কারোকে সাথে পেয়েই যায়। কিন্তু তাও। কল্লোলিনী কলকাতায় আজও রাত নামলে ভিড় করে শেয়াল শকুনরা। রাস্তা দিয়ে স্খলিত পায়ে গেস্ট আর বার গার্ল কোমর জড়িয়ে হাঁটে। গলির কোণে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে প্রেম করে মধ্যবয়স্ক কোটিপতি কোনো অল্পবয়সী সিঙ্গার-ডান্সারের সাথে। দু'একজন প্রতারক মেয়ে ওত পেতে বসে থাকে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে। ভদ্র চেহারার, অল্পবয়সী ছেলে ছোকরা দেখলেই সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। টাকা চায় ক্ষিদে পেয়েছে বলে। ততক্ষণে শিকারের চোখ তার উন্মোচিত উদ্ধত বক্ষবিভাজিকায় আটকে গেলে, ছিনতাই রাহাজানি করতে লেট করে না মেয়েগুলো। কলকাতার মধ্যে আরেক কলকাতা জেগে ওঠে। সেটা নগ্ন কলকাতা। তার আর পোষাকের আড়ালে আব্রুর প্রয়োজন পড়ে না।
নন্দিনী হেঁটে আসে ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে। শাটল্ ট্যাক্সি ধরে সোওজা তারাতলা। সেখানে বজবজ যাওয়ার শাটল্গুলো দাঁড়িয়ে থাকে জুট কর্পোরেশনের সামনের ঝুপড়ি মার্কা পূজা হোটেলের সামনে। ড্রাইভারগুলো চেঁচায় "বজবজ বজবজ নুঙি নুঙি" করে। রোজই নন্দিনী ধীর পায়ে গিয়ে বসে ড্রাইভারের পাশের সিটটায়। বোতল থেকে জল খেয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনতে থাকে ভীমসেন যোশী। রাত বাড়তে থাকে। ট্যাক্সিগুলো হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলে বজবজের দিকে। পেছনে পড়ে থাকে ব্রেসব্রীজ, গোপালপুর, সন্তোষপুর।
দৃশ্য ৮
গর্ভের বয়স তিন মাস কাটতেই বিবেক কেমন যেন পাল্টে গেল দ্রুত। দেরী করে বাড়ি ফেরা, মদ খেয়ে মাতলামো, সবই করছিল। কলকাতার নামকরা সঙ্গীত পরিচালকদের সাথে ওঠাবসা থেকে পেজ-থ্রি পার্টি, সব জায়গাতেই ধীরে ধীরে লাইমলাইটে আসছিল বিবেক।
একটা রোববার। দিনটার কথা খুব ভালো করে মনে আছে নন্দিনীর। তখন ছ'মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা সে। চিরাচরিতভাবে বিবেক সাড়ে বারোটা-একটার সময় বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যে ছ'টা দশ-পনেরো নাগাদ একটা মেসেজ পেয়েছিল ফোনে। বিবেক লিখেছে, সে চলে যাচ্ছে। প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েও, নন্দিনী ভেবেছিল বিবেক হয়তো মদের ঘোরে লিখেছে। যেমনটা আগেও লিখেছে যে নন্দিনীর জন্য তার কেরিয়ার শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু রাত একটার পরেও বাড়ি না আসায় চিন্তিত নন্দিনী বার দশেক ফোন করেছিলো বিবেকের ফোনে। প্রতিবারই আশাহত হয়েছিল, কারণ বিবেকের ফোন বন্ধ ছিল। আতঙ্কিত, দিশেহারা নন্দিনী লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে প্রায় সাড়ে চার মাস পরে মা'কে ফোন করেছিল।
পরের ঘটনা বড়ই সামান্য। থানা-পুলিশ অনেক হয়েও খোঁজ মেলেনি বিবেকের। যোগমায়া দেবী একবার বলেছিলেন অবশ্য অ্যাবরশন্ করে নেওয়ার জন্য। দাঁতে দাঁত চেপে, শক্ত চোয়ালে নন্দিনী বলেছিল, "গুরু মা, ওটা আমার বাচ্চা। ওকে মারতে বোলো না। আমি বাঁচলে, সেও বাঁচবে।" ততদিনে বিবেকের বদান্যতায় সেভিংস অ্যাকাউন্টে হাজার দশেক টাকা, হাতের চারগাছা চুড়ি আর কানের দুল ছাড়া নন্দিনীর সম্পত্তি বলতে পেটের বাচ্চাটাই অবশিষ্ট। রূপালী দেবীর যা জমেছিল, তাই দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়াটা দেওয়া গেল মাস কয়েক। অবশ্য যোগমায়া দেবীও একেবারে ফেলে দেননি নন্দিনীকে। মাতৃসদনে ভর্তি করিয়ে দেওয়া থেকে, বজবজে একটা এক কামরার ঘরও দেখে দিয়েছিলেন। আর কাজ চালানোর জন্য হাজার তিরিশ টাকা।
বার ডান্সারের কাজটা একরকম বাধ্য হয়েই নিতে হয়েছিল নন্দিনী। বাজার খুব নির্দয়। একবার হারিয়ে গেলে আর কেউ ফিরেও তাকায় না। কালের নিয়মে ততদিনে নন্দিনীও হারিয়ে গিয়েছিল শিল্পজগৎ থেকে। তায় বাচ্চার মা। লোকে ভরসাও দেয়নি, কাজও দেয়নি। নন্দিনীর চেনা একজন খবর দিয়েছিল। যোগাযোগও করিয়ে দিয়েছিল। সেই শুরু। প্রথমে ছোটখাটো একটা বারে ঢুকে কাজে হাতেখড়ি। তারপর শুধুই জনপ্রিয়তা। গেস্টই বলা যাক বা খদ্দের, কলকাতার বেশ কিছু তাবড় ভদ্রজনের টিকি আর সম্মান, দুইই বাঁধা পড়ে আছে নন্দিনীর কাছে।
দৃশ্য ৯
বজবজ মোড় থেকে নন্দিনীর ফ্ল্যাটটা দেখা যায়। হেঁটে যেতে সময় লাগে মিনিট দেড়েক। রাত তখন একটা দশ, ক্লান্ত শরীরে লোহার মেইন গেটটা খুলে ধীর পায়ে তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠতে উঠতে নন্দিনীর মনে পড়ছিল আজ নাইট ব্যান্ডের রিজার্ভ টেবিলে বসা আনকোরা, চেনা গেস্টটার কথা। মানুষ দাড়িগোঁফের আড়ালে নিজেকে লুকোতে পারে না। চোখ...একজোড়া চোখই মানুষকে চিনিয়ে দেয়। ঐ দুটো চোখেই খেলা করে রাগ দুঃখ দ্বেষ আনন্দ খুশী প্রেম স্নেহ। প্রথমে খেয়াল না করলেও নন্দিনী নাচতে উঠেই বিবেক শর্মার দিকে বহু পুরোনো চেনা ত্যারচা হাসিটা হাসতেই, মাথা নীচু করে নিয়েছিল বিবেক। তার চোখে তখন অপরাধীর ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক। কিন্তু বিস্মিত হয়েছিল সেই চোখও, যখন নোটের বান্ডিলের ফোয়ারা উড়ছিল নন্দিনীর ওপরে।
বেলটা বাজাতে গিয়েও, চোখের কোণের এক কণা জলটা বাঁ হাতের তেলো দিয়ে মুছে, দু সেকেন্ড থমকে, একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বেল বাজাল নন্দিনী। বেলের আওয়াজে মায়ের সাথে বছর তিনেকের রুক্মিণীও দৌড়ে এল।
ফ্ল্যাটে ঢুকে, জুতোটা ছাড়তে ছাড়তে মামন, মানে রুক্মিণীকে সজোরে বুকে জড়িয়ে নিলো নন্দিনী।
রাত প্রায় দুটো। ঘর অন্ধকার। ফুটফুটে জোৎস্নায় মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েছিল নন্দিনী। আলতো করে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, "তোকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না মামন। কেউ না। ভগবানও না।"