বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। আর এ সময় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঘরের ভেতর মিলির মোবাইলে কুউউউ, কুউউউ স্বরে কোকিল ডেকে উঠলে বড়ো বেখাপ্পা শোনায়। সোনাইনিজের ঘর থেকে টিপ্পনী কাটে, ‘মা তোমার মোবাইলের রিংটোনটা পাল্টাও। ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে কোকিল ডেকে উঠলে কি অড শোনায় ভাবতে পারবে না’।
মিলি মেয়েকে পাল্টা জবাব দেয়, ‘সিজিন অনুযায়ী রিংটোন করতে হবে নাকি? যা আছে তাই থাকবে’।
সোনাইয়ের বাবা খবরের কাগজের শব্দ-জব্দ করছিল। এটা পার্থর একধরনের নেশা। সারাদিনে সময় পায় না। তাই রাতে বিছানায় গুছিয়ে বসে এই অসাধ্য কাজটা করে ফেলে। নতুবা নাকি ঘুমই আসে না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম একটু কিন্তু কিন্তু করতো। এখন সব খুল্লামখুল্লা। সেও ছাড়ে না, ‘তাই তো, তাহলে তোর মার রিংটোনে এখন এ ভরা বাদর / মাহ ভাদর / শূন্য মন্দির মোর করলে ভাল হোতো। ফোনটা ধরো’।
মিলির কপালের বিয়াল্লিশের হালকা রিংকেল বিরক্তিতে ঘন হয়। ঘড়ির দিকে তাকায়। এগারোটা কুড়ি। এখন এই রাতে কার প্রয়োজন হল! বাবা, শাশুড়ি মা মিলির বিয়ের আগেই গত হয়েছেন। আর পাঁচ বছর আগে শ্বশুরমশাই, বছর দেড়েক হল নিজের মা। সুতরাং এত রাতের ফোন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কিছু নেই। তবু ...। ফোনটা কানে চেপে ধরে মিলি। হ্যালো বললে ওপাশে নীরবতা।
মিলি আবার বলে, ‘হ্যালো কে বলছেন?’
নীরবতা ঘন হয়।
মিলি রাগ বিরক্তি চাপতে পারে না, ‘হ্যালো কে বলছেন?’
নীরবতা দীর্ঘ হয়।
মিলি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘ইয়ার্কি মারার জায়গা পাচ্ছেন না, না? এই দেখো তো কে?’
পার্থর হাতে ফোনটা দিয়ে আয়নার সামনে নাইটক্রীম মাখতে দাঁড়ায়।
পার্থ ফোনটা হাতে নিয়ে বলে, ‘যা বাবা কেটে দিয়েছে তো!’
মিলি তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ঐ নাম্বারটায় ডায়াল করো’।
পার্থ বলে, ‘ছাড়ো না বাবা’।
মিলি দু’হাতে মুখে ক্রীম ঘষতে ঘষতে বলে, ‘না না ছাড়বো কেন? রাত দুপুরে বাঁদরামি হচ্ছে, দেখাচ্ছি মজা’।
পার্থ নম্বরটা ডায়াল করে বলে, ‘এ বাবা সুইচড অফ বলছে। গোস্ট কলার। তোমার সুরেলা কণ্ঠস্বরটাই বোধহয় শুনতে চেয়েছিল’।
পাশের ঘর থেকে সোনাই খিলখিলিয়ে ওঠে। মিলি চীৎকার করে ওঠে, ‘দেখেছো কি বাঁদর মেয়ে! বই মুখে নিয়ে বসে আছে অথচ কান এদিকে’।
মশারির ভেতর ঢুকে বালিশে মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় মিলির - কে হতে পারে! এমন অদ্ভুত আচরণ করলো কেন?
দুদিন বাদে দুপুরবেলা পাশের বাড়ির ঘোষাল জেঠু মারা গেলেন। বয়সজনিত কারণে অনেকদিন ধরেই ভুগছিলেন। বৃষ্টির জন্যই দেহ শ্মশানে নিয়ে যেতে পারছিল না কেউ। বিকেলের দিকে ধরন দিতেই তড়িঘড়ি সকলে বেড়িয়ে পড়ে। পার্থও সঙ্গে গেছে। ঘোষাল জেঠিমা আগেই মারা গেছেন এবং ঘোষাল জেঠুর কোনও মেয়ে না থাকায় শোকের আড়ম্বর একটু কম। পার্থ বলে গেছে, ‘তোমরা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো, কখন ফিরবো তো ঠিক নেই’।
রাত দশটা নাগাদ মা মেয়েতে গল্পগুজব করতে করতে খেয়েও নেয়। সোনাই এবছর উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। পড়ার চাপ খুব। তবু ডাইনিঙে সোফায় বসে টিভি দেখে যাচ্ছে। রান্নাঘরে মিলি তা নিয়ে গজগজ করা শুরু করে। ফোনটা আবার বেজে উঠলে মানে কোকিল ডেকে উঠলে মিলি মেয়েকে বলে, ‘তোর বাবা নিশ্চয়ই ফোন করেছে, ধরতো’।
সোনাই মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলে, ‘না মা বাবা না, একটা নম্বর মনে হয় তোমার সেই গোস্ট কলার’।
মেয়ের কথায় গা জ্বলে যায় মিলির, ‘আমার সেই গোস্ট কলার মানে, মারবো এক চড় টেনে’।
সোনাই মুচকি হেসে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। মিলি ফোনটা কানে চেপে রাগতে গিয়েও রাগতে পারে না। বরং বেশ শান্ত গলায় বলে, ‘প্লীজ বলুন, কে বলছেন আপনি?’
ওপাশে সেই ঝিঁঝিঁ ডাকা নির্জনতা।
মিলি বলে, ‘দেখুন এভাবে আমায় বিরক্ত করলে আমি কিন্তু পুলিশকে জানাতে বাধ্য হবো’।
টুপটাপ শিশির পতনের শব্দের মতো একটা অলীক নিস্তব্ধতা ভেসে আসে। মিলি নিজেই ফোনটা কেটে দেয়। ফোনটা হাতে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মিলি। তারপর মেয়ের ঘরে ঢুকে কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গীতে বলে, ‘হ্যাঁরে তুই ঠিক বলেছিস। সেই গোস্ট কলটা’।
তারপর আত্মমগ্ন হয়ে নিজেকেই নিজে যেন বলে, ‘কে হতে পারে বলতো?’
সোনাই বাতাসে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়, ‘তোমার পুরনো কোনও বয়ফ্রেন্ড হতে পারে’।
মেয়ের কথায় তেঁতে ওঠে মিলি, ‘কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে। তোদের মতো নাকি পেট থেকে একেবারে বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে বের হচ্ছিস যেমন। আমার কোনদিন কোনও বয়ফ্রেন্ডট্রেন্ড ছিল না’।
মাকে সিরিয়াস হয়ে যেতে দেখে আড়চোখে দেখে নিয়ে পড়ায় মন দেয় সোনাই।
আরও বাংলা ছোট গল্প পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
মিলি নিজের বিছানায় বসে ভেবে ভেবে আকাশপাতাল থৈ পায় না, কে হতে পারে এই গোস্ট কলার। তার ফোনটায় ব্লক করার সিস্টেমও নেই যে নম্বরটা ব্লক করে দেবে। মেয়ের ঘরে একটু উঁকি দিয়ে নম্বরটায় ডায়াল করে মিলি। সুইচড অফ। বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। সোনাইয়ের বাবার কথাটাই সত্যি নয়তো তার গলার স্বর শোনার জন্যই এই ঘোস্ট কলটা আসছে। ফুল স্পীডে ফ্যানের তলায় বসেও কপালে ঘাম ফুটে ওঠে মিলির। ধুস কি সব যা তা ভাবছে সে। কিন্তু কে হতে পারে?
সে রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে মিলি, তার বাপের বাড়ি ইছামতী নদীর ধার দিয়ে একটা অরণ্যের ভেতরে হেঁটে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতে সে ভারশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে হাঁটাটা তার খানিক ভেসে থাকার মতো হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে সে যেন শূন্যে সাঁতার কাটছে। তার আর কোনও রোগ শোক জ্বালা যন্ত্রণা কিছু নেই। শুধু আনন্দ আর আনন্দ। অসাধারণ অনাবিল এক আনন্দস্রোতে সে যেন উড়ে যাচ্ছে। তার দুই হাত যেন দুটো ডানা। পায়ের কোনও ব্যবহারই নেই। সে যেন রূপকথার দেশের রাজকন্যা। দূরে রয়েছে একটা উজ্জ্বল স্ফটিকের প্রিজম। প্রিজমের প্রতিটা তলে ভেসে উঠেছে এক একটা মুখ – কে নেই সেখানে, মা’র মাসতুতো বোন প্রায় সমবয়সী মণিমাসী, গানের স্যার অনুপমদা, প্রিয় বান্ধবী অর্চিতা, প্রিয় বন্ধু মিতুল, বাবার বন্ধু সলিলকাকু, বড়দার বন্ধু ঋষিদা, ছোড়দার প্রেমিকা ঐশীদি, এমনকি বর্তমানে যাদের সঙ্গে মিলির নিয়মিত সম্পর্ক তার অফিসের কলিগরা, অনিন্দিতাদি, রঞ্জনা, সঞ্জয়দা, ভীমদা, দেবাশিষ, এমনকি অফিসার পর্যন্ত। স্লাইডিং শোয়ের মতো একটার পর একটা মুখ ভেসে উঠছে। ঘেমে নেয়ে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে ওঠে মিলি। ফ্যানের হাওয়ায় দেওয়ালে পেরেক দিয়ে টানানো ক্যালেন্ডারের ঘসঘস শব্দের মতো দুলতে থাকে মুখগুলো। এদের মধ্যে কি লুকিয়ে আছে মিলির গোস্ট কলার!
এখন রাত্রি সাড়ে দশটা বাজলেই মোবাইলের সাউন্ড অফ করে দেয় মিলি। মোবাইলটা কাছে কাছে রাখে। রান্নাঘর, বাথরুম, বারান্দা কোথাও দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলে, ‘হ্যালো কে বলছেন?’ কোনদিন বলে, ‘দেখুন ভালো হচ্ছে না কিন্তু আমি এবার পুলিশে জানাবোই’। কোনদিন বা বলে, ‘আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কে’। আবার কোনদিন ফোনটা ধরেই না। শব্দহীনভাবে দু’তিনবার ফোনটা বেজে থেমে যায়। মনে মনে ভাবে ঠিক হয়েছে, উচিত শিক্ষা দিলাম আবার কোনদিন মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।
একদিন সোনাইয়ের বাবা জিজ্ঞাসা করে, ‘কি গো তোমার সেই গোস্ট কল আসা বন্ধ হয়ে গেছে?’
রেগে যায় মিলি, ‘আমার গোস্ট কল নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন?’
সোনাই ফোঁড়ন কাটে, ‘ভূতে ধরলে এমনই হয়’।
ব্যাপারটা তখনকার মতো তরল হয়ে গেলেও একটা সন্দেহের বীজ দানা বাঁধে মিলির ভেতর। পার্থ কিছু সন্দেহ করছে না তো! এই যে তার সারাক্ষণ মনে হয় অদৃশ্য দুটো চোখ তাকে যেন সবসময় লক্ষ্য করছে।
মিলির সাজগোজ বেশভূষাতে বেশ একটা পরিপাটি পরিবর্তন এসেছে। এমন কি ব্যবহারেও। আগের মতো আর কথায় কথায় রেগে ওঠে না। রঞ্জনা সেদিন বলল, ‘মেরুন কালো শাড়িটায় তোমায় দারুণ মানিয়েছে মিলিদি’। অনিন্দিতাদি বলে, ‘ব্লাউজের ডিজাইনটা তুমি নিজে দিয়েছো না ক্যাটালগ দেখে বানাতে দিয়েছিলে?’ সঞ্জয়দা, ভীমদা, দেবাশীষও বলে, ‘ওর ব্যবহারে বেশ সত্যি সত্যি পরিবর্তন হয়েছে। যা কটকট করে কথা শোনাতো সবসময়ে’। অফিসার বলে, ‘মিলি দিদিমণি আপনার কাজে একটা গতি এসেছে’।
মিলির যেন এখন সারাদিনের অপেক্ষা কখন বাজবে রাত এগারোটা কুড়ি।
এবার পুজোয় তাদের ভাইজাগ যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পার্থর বড়োজামাইবাবুর হঠাৎ করে ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং পনের দিনের মধ্যে সব শেষ হয়ে যাওয়ায়, সব টিকিট ক্যান্সেল করতে হয়। ষষ্ঠীর সকালবেলা মায়ের বোধোনের ঢাক বাজছে। সোনাই নিজের ঘর থেকে চীৎকার করে ওঠে, ‘মা, দেখো আমরা যে ট্রেনটায় ভাইজাগ যেতাম, সে ট্রেনটায় কি বীভৎস দুর্ঘটনা ঘটেছে। কত লোক মারা গেছে, কত জন ইনজিওরড’।
মিলি মনে মনে ঈশ্বরকে প্রণাম জানায়। সেই তাদের এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। তারা গেলে কি সর্বনাশ হতে পারতো, সেই আলোচনায় আর ষষ্ঠীর ছোলার ডাল, লুচি, কুমড়োর ছক্কার স্বাদে দিনটা কিভাবে যেন পার হয়ে যায়। পরের দিন মিলির খেয়াল হয়, ‘গতকাল তো ফোনটা আসেনি!’ সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী পুজোর সব দিন কটাই পার হয়ে যায়, ঘোষ্টকলটা আর আসে না। আর কোনোদিনই আসে না। ড্রাফটে সেভ করে রাখা নাম্বারটা দেখে ফোন করে মিলি। ওপাশ থেকে যথারীতি বলে যায়, ‘সুইচড অফ’। মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে ওঠে মিলির, ফালতু একটা বিষয় নিয়ে বেকার সে মাথা ঘামাচ্ছে। পার্থ আর সোনাই বলে, ‘হল কি তোমার? এই তো বেশ ছিলে!’
পুজোর ছুটির পরে অফিসে জয়েন করে মিলি। রঞ্জনা বলে, ‘এমা মিলিদি একটা নতুন শাড়ী পড়ে এলে না কেন?’ সঞ্জয়দা কি নিয়ে রসিকতা করতে গেলে খিঁচিয়ে ওঠে মিলি। সঞ্জয়দা বলে, ‘যাক বাবা হল কি ওর?’ অফিসারের কাছে একটা ফাইলে কাজ করে নিয়ে গেলে অফিসার সেই কাজের মধ্যে পাঁচখানা ভুল বার করেন। বলেন, ‘দেখুন কি করেছেন আপনি?’
মিলির ভেতরে গোষ্টকল আসার প্রতীক্ষাটা হঠাৎ করে একদিন ধুকপুকুনি জাগায়। আচ্ছা ঐ গোষ্টকলার কি জানতো মিলিদের পুজোয় ভাইজাগ যাওয়ার কথা ছিল! কিন্তু সেটা বাতিল হয়ে গেছে সেটা জানতো না। তাই নিজেও টিকিট কেটে ঐ ট্রেনে...। না মিলি আর কিছু ভাবতে পারে না। তাড়াতাড়ি নাম্বারটায় ডায়াল করে। ওপাশ থেকে সুরেলা কণ্ঠস্বর যথারীতি জানায়, ‘দিজ নাম্বার ইজ সুইচড অফ’।