-আজ ওরা কটায় ফিরবে সুমি?
-জানিনা, অত কথা আমি ওদের জিগ্যেস করিনা?
-কেন করোনা?তোমার ছেলে-বৌ, তুমি সংসারের কর্ত্রী, বলে যাবেনা কেন? তা আজ তারা গেছে কোথায়?
-কালরাতে আমার সামনেই তোমাকে বলেছে, পুপুর অফিস- পিকনিকে। এত ভুলে যাও!
-ওই শুরু হল অপবাদ দেওয়া! আমি সব ভুলি? গেল শনিবারে পিকনিকে গেল না? , তার আগে আরো তিন চার দিন তো হবেই। কই আমরাতো শীতকাল- ভোর এত পিকনিকে যেতাম না? এবারে ছেলে তার অফিস- পিকনিকে আমাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল একবারো?
-না।
- কেন বলেনা বলতো? কতদিন ভোজবাড়িতে নেমন্তন্ন খাইনা, লাল লাল গরগরে মাংসের ঝোল , শেষ কবে খেয়েছি, মনেই পড়েনা। ।
-ও! পঁচাত্তর পেরিয়ে তোমার সত্যি ভীমরতি ধরেছে। ওরা ছেলেমানুষ, সারাবছর খাটে খোটে , এর মধ্যে আবার বুড়ো বাপ-মায়ের হ্যাপা নেবে কেন? আমারই খারাপ লাগে, কতদিন যে শুকনো লতার মত পরগাছা হয়ে ঝুলে আছি!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত সব ছোট গল্প পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
- কিসের পরগাছা? পেন্সন পাইনা? বেশ করেছি,ঝুলে আছি। আমি মা- বাবাকে নিয়ে স্কুল পিকনিকে যেতাম না? তখন তুমিও উৎসাহ করে বলতে, আহা চলুক, সারাদিন ঘরবন্দি থাকে, একটু ছেলে- পুলেদের মাঝে হই- হই করে আনন্দ করুক। পুপু এসব দেখেছে। তাহলে বলবেনা কেন?
- অই শুরু হল, হিংসুটে বুড়োর কূট- কাচালি, আরে কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা। ওরা দুজনে কত বড় চাকরি করে কত পরিচিতি, একী আর তোমার মত মফসবলের স্কুলের হেডমাস্টারের ছেলে ঠ্যাঙানোর চাকরি। বছরে একদিন নিয়ে যেতে, তাও কত ঝামেলার পর। বাবা- মা না গেলে আমায় কাকভোরে সব রান্না গুছিয়ে সকাল ছটায় লজঝড়ে স্কুলবাসে চাপতে হোত।
- ভাল। আমার লো- প্রোফাইল চাকরি। আমার দাবি থাকতে নেই, এইতো তোমার বিচার। তা ছেলেটা আজ কত দূরে গেছে? ডাস্ট -আলারজি হয়ে আবার না জ্বরজারি আসে? মাফলার নিয়েছে ? দেখেছ? ভোরবেলা থেকে কত লম্ফ ঝম্প করছিল। আসল জিনিস ঠিক নিতে ভুলে যাবে। আর বৌটাও হয়েছে ন্যাকা-ষষ্ঠী -আদুরি। কিচ্ছুতে খেয়াল নেই। গাড়িটা ভালমত চালাতে জানে, ব্যাস! তাতেই ছেলে আমার গদগদ। আর তোমার আস্কারাও কম না।
মাগো! থামবে তুমি? চারটে বাজে। আজ চা এর সাথে গরম পিঁয়াজি খাবে? পদ্মকে তাহলে বলে দি।
-পিঁয়াজি? ছ্যা! ওরা পিকনিকে গিয়ে কত ভাল মন্দ খাচ্ছে আর আমার বেলায় যত্ত ফালতু খাবার। হ্যাঁগো, পিকনিকের মেনুটা ঝিমলি তোমায় বলেছে? খুবতো ভাব দেখি। চল্লিশ-বেয়াল্লিশের ধাড়ি মেয়ে, এমন আদিখ্যেতা করে, যেন---
আহা, ওর মা- বাবা নেই, একটু না হয় করলো। পিকনিকের মেনু আমি জানিনা। হবে হয়তো, ফ্রায়েড রাইস, মাংস, মাছ--, ফ্রাই, চাটনি—
পিকনিকে পরিবেশন কিন্তু একটা ঝকমারি কাজ, কত যে মান- অভিমান দেখতাম , খাবারের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে---- আচ্ছা, নলেন গুড়ের রসগোল্লা পাওয়া যাচ্ছে এখন?
- তোমার না হাই স্যুগার?
-থামতো! আজকাল ডাক্তাররা সব খেতে বলছে, টিভিতে শোননা? যাকগে, পুপুকে একটা ফোন করে দেখোনা, কটায় ফিরবে-
-উঃ! পারিনা তোমায় নিয়ে। বলা হয়নি, ঝিমলি দুপুরেই জানিয়েছে ওরা সুন্দর-গ্রাম না কোথায় একটা গেছে, রাতে ফিরছেনা, কাল খুব ভোরেই --- পদ্মকে রাতে থাকতে বলে গেছে। কত দায়িত্ব নেয় বলত মেয়েটা।
-ও । আজই আমরা একা একা—
-কেন আজ কিসের একা-দোকা?
না, ভাবছিলাম পিকনিকেতো কত সময় ভয়ঙ্কর ভুল বোঝাবুঝি হয়। কত গাঢ সম্পর্ক ফিকে হয়ে যায়, আবার ---কত মিট্মাট—। ওরা আজ কতগুলো ঘন্টা পিকনিকে থাকবে----
-সারাক্ষণ কেন এত যে এত কুচিন্তা করো ?
-না, তোমার মনে আছে আমার স্কুলের মালি নিজামুদ্দিনের ছেলে এস্রাফিল একবার স্কুল- পিকনিকের চাঁদা সময়ে দিতে পারেনি বলে ক্লাস- টিচার গগন- স্যার ওকে বেধড়ক পিটিয়েছিল ? তুমি শুনে পঁচিশ টাকা চাঁদা নিজের সঞ্চয় থেকে বার করে দিয়ে বলেছিলে, আহা ও আমার পুপুর ক্লাসের ছেলে।
-বাবা! আজ হঠাৎ আমার এত প্রশংসা? সহজে তো ওসব বাক্যি মুখ দিয়ে বেরয় না।
-সাধে কি আর করছি?
- এত হেঁয়ালি কর আজকাল—এই যা! লোড- শেডিং। কী হল আজ আবার?
- ব্যস্ত হোয়ো না। মোমবাতি আমার নাগালেই আছে। কেন জানো? আজ সন্ধ্যেয় এই ঘরে আর একটা মোমবাতি জ্বালানো পিকনিক হওয়ার কথা ছিল।, আমার পছন্দের একটা চকোলেট- কেক, পুপুই আনবে বলেছিল। আজ আমার পঁচাত্তরে পা---আজকের দিনটা সুমি তুমিও ভুলে গেছ?
আজই ২১ শে জানুয়রি--- কী করে যে ভুলে গেলাম! মোমের আলোয় ঘর জোড়া নম্র অন্ধকারে সুমির অপরাধী গলা ভেসে বেড়ায়।
- তোমার দোষ কী সুমি? আমার এই মধ্যবিত্ত অসফল জীবনে, বেলাশেষের এই শূন্যগর্ভ চাওয়া - এর দাম আছে নাকি? -বয়সে তো এইসব শেখায় ---
-অভিমান পুষে রেখোনা গো, বলছি তো মাপ চাইছি। ওদেরও লক্ষ্মীটি কিছু বোলনা। ভুলতো সবার হয়। ডুকরে কেঁদে ওঠে সত্তর ছোঁয়া সুমি।
-না সুমি। অভিমান নয়, বড় কষ্ট হয় আজকাল। কাকে বলি এসব কথা? জীবন এখন ঘন জঙ্গল তছনছ করা দীর্ঘস্থায়ী পিকনিকের খণ্ড খণ্ড টুকরো। স্থবির গাছের অভিমানের কথা সেখানে কে শুনবে বলো?
মোমের আলোর তিরতিরে শিখায় সুমির কান্না ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে, জীবনের চূড়ান্ত অর্জনের পর কলহ- প্রবণ স্বপ্ননীলের গলাটা হঠাৎই মেদুর হয়ে আসে।