Advertisment

ছোট গল্প: উমনো-ঝুমনোর মা

পেশায় অধ্যাপিকা ঈশা দেব পালের লেখালিখির বয়স এখনও এক দশক ছোঁয়নি বটে, তবে পাঠক শুধু নয়, সমসময়ের শক্তিশালী লেখকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যেই গবেষণামূলক প্রবন্ধের বই এবং একাধিক গল্পের বইও প্রকাশিত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ছবি- অরিত্র দে

 ঈশা দেব পাল

Advertisment

---এবার আশা করি তোমার মন ভাল হয়ে যাবে। তোমার রাজার অসুখ সেরে যাবে।

কথাটার মধ্যে একটা ব্যঙ্গ আছে। আমি অবশ্য মুখে কিছু বলিনা।

রূপম কি আমাকে দেখানোর জন্য বেশি সুখী ভাব দেখাচ্ছে? ওর ইয়ার এন্ডিংয়ের টাইমে প্রায় জোর করে বেড়াতে নিয়ে এসেছি আমি। দোল পূর্ণিমার আগের দিন এসেছি আমরা পুরুলিয়ায়। প্রকৃতিতে যে দোল লেগেছে তাই দেখব বলে।

ও গলায় ক্যামেরা আর মুখে আনন্দ ঝুলিয়ে আছে, তবু আমার মনে সন্দেহ।

সুখী সুখী ভাবের ও কিন্তু বেশ একটা গন্ধ আছে। কেমন একটা আবীর আবীর গন্ধ। একটু কর্পূর দেওয়া। যেন যে কোনো সময়ে ডানা মেলে উড়ে যেতে পারে সেই ভাব, আমি তাই সন্দেহ চোখে দেখছিলাম রূপমকে, তিন্নিকেও। আমার বর, আমার মেয়ে।

আমি চিরকালীন বিষণ্ণ টাইপ মেয়ে, রূপম বলে —দুঃখবিলাসী। অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে এই লাল হয়ে যাওয়া পলাশবনে দাঁড়িয়ে, এই ঘোর বসন্তে, দোল পূর্ণিমার আগের দিন তবু আমি সুখের রং দেখছিলাম, সুখের গন্ধ নিচ্ছিলাম। অন্তত চেষ্টা করছিলাম। চ্যালেঞ্জটা ছিল ওটাই। আমার প্রচণ্ড ডিপ্রেসড মনকে ভাল করা।

সামনে দিয়ে উঠে গেছে অযোধ্যা, আমরা ও পাহাড়ের একটা ধাপেই দাঁড়িয়ে। রূপম মেয়ের ছবি তুলছে। এই আগুন লেগে যাওয়া পলাশ বনে তিন্নি একটা হাল্কা সবুজ ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে। আমি একটা বাসন্তী রংয়ের সালোয়ার। রূপম আমারও ছবি তুলছে । চারিদিকে একটা আশ্চর্য মাতাল হাওয়া।

ড্রাইভার বলেছিল এখানে নাকি একটা ঝর্ণা আছে। ভাবছিলাম অল্প এগোলে যদি ঝর্ণাটা দেখা যায়। ঠিক উদ্দেশ্য কিছু নয় খুঁজে পাওয়া, শুধু এগোনো আর পাহাড় টা আবিষ্কারই আসল আনন্দ। বা এই নির্জন অরণ্যে এসে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করা। তিন্নি তরতর করে উঠছে। আমিই হাঁফিয়ে যাচ্ছি শুধু। রূপম অন্য সময়ের মত একাই এগিয়ে যাচ্ছে না, আমার জন্য দাঁড়াচ্ছে, হাত ধরে এগোচ্ছে। ফাল্গুনের রোদ আছে, কিন্তু নরম রোদ। এই রোদ যেন শিশিরের মত গা ভিজিয়ে দেয়, কেমন করে যেন শহুরে জীবনের ক্লান্তি, ক্লেদ, ডিপ্রেশান সব মুছিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে।

একটা বউ ঝুড়ি হাতে নেমে আসছিল। তাকে ঝর্ণার কথা জিগ্যেস করতেই সে বলল, -- হদহদি ? উ অনেক দূর। আজ এই সময়ে যাবি তো কাল এই সময়ে ফিরবি।

যাহ। আমি হাঁ করে অযোধ্যা কে দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল এই তো এক্টুখানি। রূপম হাসতে হাসতে বলছিল, ওরকম মনে হয়। সব ভাল জিনিসই আসলে ইশারা। আমাদের মনে থাকে। বাস্তবের নাগালের বাইরে।

তিন্নি হাঁ করে একটা প্রজাপতি দেখছিল। কালো রংয়ের প্রজাপতি। কী রূপ তার! আমাকে দেখালো ও। সেই সময় এই নির্জন পাহাড়ি অরণ্যে দেখি কালো প্রজাপতির মতই দুটো মিষ্টি আদিবাসী কন্যা। হাতে ঝুড়ি, আঁকশি। নিজেদের মধ্যে হাসতে হাসতে নেমে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে। একেবারে হাতে আঁকা ছবির মতই। তিন্নি প্রজাপতি ছেড়ে ওদের দেখতে দেখতে হঠাত বলে,-- মা, ওরা কি উমনো-ঝুমনো ? রূপম হাহা করে হাসে। ওর হাসিতে মেয়ের সাহিত্যবোধ, বুদ্ধি ইত্যাদি না বলা সব প্রশংসা লেগে থাকে।

পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে মেয়ে আবার বলে-- ওদের ও কি জঙ্গলে দিয়ে গেছে ওদের বাবা ?

আমি বুঝিয়ে বলি-- না না, দেখলে না ওদের মুখে কী হাসি, কী আনন্দ। ওরা উমনো-ঝুমনো নয়। তাহলে তো ওরা কাঁদত।

রূপম একটু গম্ভীর গলায় বলল—এসব দুঃখের গল্প ওকে আর বোলো না।

আমি বললাম,-- আমরা দিদুর কাছে খুব শুনতাম, দিদু যতবার বলত গল্পটা, আমি দিদুর চোখে জল দেখতাম।

রূপম চুপ করে গেল। আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এলাম। এখানেও পলাশ। রাস্তায় পড়ে লাল হয়ে আছে। কেমন রক্তের মত, বেদনার মত লাল।

আরও পড়ুন, Short Story of Bangladesh: আশার মতো মিথ্যে নেই

দুই

সেই রক্ত লাল পথ আর আগুন লেগে যাওয়া পাহাড়ের পথের ধারে একটা ছোট্ট দোকান । কাছে গিয়ে দেখি সেই দুটো ছোট মেয়ে যাদের তিন্নি উমনো-ঝুমনো বলল, তাদের একজন ডিম সেদ্ধ করছে, আর একজন চা বানাচ্ছে। দোকানের পাশে ওদের ঝুড়ি টা রাখা, সেখানে ভরে আছে পলাশ। আমি দোকানের পাশে রাখা বেঞ্চ টায় বসি। আমার পা ব্যথাও করছিল, ইচ্ছেও করছিল ওদের দোকান করার স্বাদ নিতে। রূপম মেয়েগুলোর ছবি তুলতেই দুজনে হাসি হাসি মুখে পোজ দিল। তিন্নি বাবার সঙ্গে ওদের ছবি তোলা দেখছিল। ওরা যেন সত্যি ই সেই দুটো মেয়ে, যাদের বাবা জঙ্গলে রেখে গেছে শুধু দুটো পিঠে খেয়েছিল বলে। ব্রতকথার বইতে আছে, মেয়েদুটো ইতুপুজো করে নিজেদের অবস্থা ফিরিয়ে বড়লোক হয়েছিল এই জঙ্গলেই। এখানে মেয়েদুটো যেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াই করছে। দুজনেরই বয়স চোদ্দ-পনের হবে। দিদুর মুখে যখন গল্পটা শুনতাম, তখন মেয়েগুলোর এই একা লড়াই করার কথাটা মনেই পড়েনি। জঙ্গলে ওদের ফেলে ওর বাবা চলে গেলে ওরা কত কাঁদত সেটাই মনে হত। আমি ও কাঁদতাম। দিদু ও কাঁদত। অথচ দিদুর জীবনে কিন্তু কোনও কষ্ট ছিলনা। দাদাই মাথায় করে রেখে দিয়েছিল আজীবন। দিদু ছিল অপূর্ব সুন্দরীও। রূপম অবশ্য বলে, আমি নাকি একদম আমার দিদুর মত ই দেখতে। তবু সারাজীবন দিদু এক অস্তিত্ব সংকটে ভুগত । দাদাই বেঁচে থাকতেই বারবার শরীর খারাপ লাগছে বলে নার্সিংহোমে ভর্তি হত, দাদাই মারা যাবার পর আর ও বেশি। ডাক্তাররা কোনো রোগ খুঁজে পেতনা। বাবারা মুখ টিপে হাসত, তবু দিদু যেমন চাইত, তেমনই করত আয়োজন। আমার বিয়ের পর রূপম তিনমাসের জন্য বিদেশ গেল। দিদু প্রতিদিন ফোন করে জানতে চাইত,--- নাতজামাই ফোন করেছে তো? আমি হাসতাম। বুঝিয়ে বলতাম,-- চিন্তা কোরোনা, নাতজামাই আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। তবু দিদুর বিশ্বাস হতনা। পরের দিন আবার জানতে চাইত। আমার মা-ও দিদুকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে ফিকফিক করে হাসত। দিদুর মনে বোধহয় দুয়োরানিদের গল্প, উমনো-ঝুমনো দের বঞ্চনা জোরালো বাসা বেঁধে ফেলেছিল।

যত আমার বয়স বাড়ছে , আমারও কি তাই-ই হচ্ছে ? আমিও কি সেই দুঃখিনী মেয়েদের মত একলা আর অসহায় হয়ে যাচ্ছি ? দিদুর সব আতঙ্ক কেমন নির্ভুল ভাবে আমার মনে বাসা বাঁধছে। রূপম ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে ওর নিজের কেরিয়ারে আর আমি যেন তত ফুরিয়ে যাচ্ছি। তিন্নি স্কুল চলে যায়, আর আমি সারা দুপুর জুড়ে একলা কাঁদি। রূপম কে ফোন করলেই ও ব্যস্ত গলায় শুধু কাজের কথাটুকু জেনে নিতে চায়। আউট অফ স্টেশনও থাকে লম্বা লম্বা সময়। আমাদের সংসারে এখন সচ্ছলতার বন্যা। এখন আমাদের উপচে পরা জীবনের ভিতরে ভিতরে. শূন্যতার ঢেউ। আমি একলা হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। এখন যতটুকু পাই রূপমকে কাছে, সে-ও যেন তিন্নির বাবা হিসেবে। এই একাকীত্ব এমনই এ কাউকেই বলা যায়না। ফেসবুকে ফিলিং অ্যালোন আপডেট দিলেই বাজে প্রস্তাবে যেভাবে ভরে ওঠে ইনবক্স, সেরকম ই এই সঙ্গীহীন দশা বোঝালে অরসিক লোকে নানা উপদেশ দেয় মাত্র।

রূপম আমার পাশে এসে বসে ছবিগুলো দেখায়। মেয়ে দুটো বেশ হেসে হেসে পোজ দিয়েছে। এখন একটা মেয়ে ডিম সেদ্ধ বসিয়ে পলাশগুলো নিয়ে মালা গাঁথছে। কাল দোল। এই মালা সব বিক্রি হবে। কাল রাতে ছৌ নাচও হবে। আমরা চা খেতে খেতে আরও গল্প করি। আর সেই সময়েই ওদের মা-ও এসে যায়। আমারই বয়সী প্রবল যৌবনবতী একটা মেয়ে । সাইকেল চালিয়ে এসেই সেই মেয়ে বাজারের ব্যাগ খুলে সব্জি বার করে কাটতে থাকে। শুনলাম আজ মেনু ভাত, আর দেশি মোরগের ঝোল। সঙ্গে আলু-কুমড়োর তরকারি। কোন লজের ট্যুরিস্টরা এসে খাবে। মা-ও মেয়েদের মতই। মুখে হাসি, চোখে আনন্দের ঝিলিক। খুব কৌতূহল হয়। একথা সেকথার পরে জিজ্ঞেস করেই ফেলি বউটাকে -- ওদের বাবা কোথায়?

বউটা হেসে হেসেই বলে- রাঁচিতে থাকে। আসেনা ইদিকে। মেয়ের কোলে মেয়ে, তাই ছেড়য়ে গেছে আমাকে।

আর ও প্রশ্ন মনে আসে। কিছুই বলিনা। এতবড় উত্তরটা যে হেসে দিতে পারে তাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখি। খুব খেয়াল করি মেয়েটার মাথায় একদম রক্তপলাশের মত একচিলতে সিঁদুর। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখি, রূপম ওর ও ছবি তোলে। পুরুষ কীভাবে নারী দেখে জানিনা, কিন্তু নারীর নারীদর্শন বুঝি আর ও গভীর। ওকে দেখতে দেখতে মনে হয়, দিদুর কাছে কোনোদিন জানা হয়নি কেমন ছিল উমনো-ঝুমনোর মা? ওদের বাবা যখন ওদের ছেড়ে দিতে গেল জঙ্গলে, সেই মহিলা কি শুধুই কেঁদেছিল? বাবা একলা বাড়ি ফিরে আসার পরও কি বেঁচেছিল সেই বিষণ্ণ মহিলা?

আরও পড়ুন, ছোট গল্প: মধুর তুমি

তিন

বেশ রাত এখন। তিন্নি সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত। ঘুমিয়ে কাদা। আমিও ওর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। অবিশ্বাস্য শোনালে ও রূপম এই জঙ্গুলে আকর্ষণ কে অস্বীকার করে ল্যাপটপ খুলে কাজ করছে। মাঝে মাঝে ক্লায়েন্ট দের সঙ্গে ফোনে কথা ও বলছে। ওর সব ক্লায়েন্ট ই নাকি রাতজাগা। আমি তিন্নির মা হয়ে ওর পাশে শুয়ে ঘুমের মত ভান করি। আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা রূপমের প্রেমিকা কাঁদে। একটা রাগী পাখি এই মধ্যরাতে ও ডাকছে জঙ্গলের মধ্যে থেকে। ওর রাগ বা অভিমানের গর্জন শুনতে শুনতে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ি।

প্রায় মাঝরাতে কে যেন ডাকে আমায়। গায়ে কার ভেজা হাতের স্পর্শ। আমি ঘুম ভেঙে তাকাই। আর আমার সব রাগ জল হয়ে যায়। ঠিক আমার স্বপ্নের মানুষ টা যেন। সব কষ্ট মুহূর্তে মিলিয়ে যায় চাঁদের আলোয় তাকে দেখে । বাইরে কাঁচের জানলা দিয়ে দেখি ধুন্ধুমার চলছে প্রকৃতি জুড়ে। ঘর খুলে বাইরে আসতে ডাকে সে। মানভূমের মাটির গন্ধ তার গায়ে। তার সমস্ত শরীরে জঙ্গুলে মাদকতা। কতদিন পরে আমার শরীর আকুল হয়। তার পুরুষালি বাহুতে আমি হাত রাখি। অভিমান নদী হয়ে যায় পাহাড়ি আহবানে।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি, ঘুমিয়ে আছে তিনজন। তিন্নি, তিন্নির বাবা, তিন্নির মা। কাছ থেকে গিয়ে দেখি তিন্নির মায়ের মাথায় পলাশ ফুলের মত সিঁদুর। মুখে চিরস্থায়ী কান্নার দাগ। ঠিক যেমনটা ছিল দিদুর বলা গল্পে উমনো-ঝুমনোর মায়ের মুখে ।

আমি সেই উমনো-ঝুমনোর মা-কে ফেলে বেরিয়ে আসি বাইরে। আমার মুখে হাসি। চোখে আনন্দ। মধ্যরাতের মানভূমে তখন চাঁদের আলোর উতসব। পিছনের অযোধ্যা পাহাড়ে যেন আনন্দের ঝর্ণা। আমাকে ডাকতে থাকে পৃথিবী। কাল দোল। আমি বাইরে ঘাসের জমিতে শুয়ে পড়ি। আমার সামনে তখন মহান প্রেমিকের মত অযোধ্যা পাহাড়, পিছনে পলাশ বনের ডাক। অনেক অনেকদিন পর আমার মিলন হয় মাতাল হাওয়ার সঙ্গে। আমার পোশাক, মন এলোমেলো হতে থাকে। বুঝতে পারি পৃথিবীতে এবার জন্ম নেবে নতুন কোনো উপকথা, যার গায়ে গত শতকের বিষণ্ণতা আর নেই।

Bengali Literature short story Bengali Short Story
Advertisment