কেউ কেউ তাঁকে শেষ মোহিকান হিসেবে বিবৃত করতে পছন্দ করবেন বটে, কিন্তু সে নেহাৎই আমাদের শব্দ খুঁজে না পাওয়া। ঠিকঠাক, যথার্থ শব্দ। কোনও আলংকারিক অভিধায় তাঁকে ধরে ফেলবার মত লেখক দেবেশ রায় ছিলেন না। অলংকার, তাঁর কথায় এক বিপজ্জনক অবলম্বন। সময় অসময়ের বৃত্তান্ত উপন্যাসের গ্রন্থবন্ধন অংশে, তিনি এ কথা লিখেছেন। লিখেছেন, অলংকার "যুক্তির চাইতে অনেক বেশি বিপজ্জনক। যুক্তির পালটা যুক্তি দেয়া যায়, কিন্তু অলঙ্কারের পালটা অলঙ্কার দেয়া যায় না। দেয়া যায়, যদি অলঙ্কারটাকে চকিতে যুক্তিতে বদলে নেয়া যায়। সে বড় হাঙ্গামা।"
যদি নিকষ সত্যি কথাটা বলা যায়, তাহলে বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের কেউ, দেবেশ রায়ের পরে, সে হাঙ্গামা পোয়াননি। দেবেশ, আক্ষরিক অর্থে এবং সর্বস্তরে হাঙ্গামা পুইয়েছেন।
দেবেশ রায় ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক, গল্প লেখক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক এবং সর্বোপরি প্রখর এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যৌবনে, যখন তিনি সিপিআইয়ের উত্তুঙ্গ কর্মী, সে সময়ে উত্তরবঙ্গে বন্যা নিয়ে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে মুখের উপর "শাট আপ" বলে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসার মত প্রখর। এবং সে প্রখরতা দেদীপ্যমান থেকেছে বাংলার শেষ নির্বাচনের সময়েও, যে সময়কালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় তিনি ধারাবাহিক ভাবে লিখে গিয়েছেন তাঁর সাময়িক প্রসঙ্গের রাজনৈতিক কলাম নিরাজনীতি।
আরও পড়ুন: দেবেশ রায়, আনিসুজ্জামান… একে একে নিভিছে দেউটি
যে ক্ষুদ্র অর্থে মার্ক্সবাদী পরিচিতি এখনকার দিনে ঘটে থাকে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, সেই বাস্তবতার প্রেক্ষিত থেকে দেবেশ রায়ের মার্ক্স চর্চা বোঝা অসম্ভব নয়, এক অবান্তর কল্পনাও বটে।
২০০৬ সালে প্রকাশিত ব্যক্তিগত ও গোপন সব ফ্যাসিবাদ নিয়ে একটি বই-এ তিনি লিখছেন, “মার্ক্সবাদ যে কোনো পূর্বনির্দিষ্টতায় বিশ্বাসই করে না, আর সেই অবিশ্বাসই যে হেগেলের ডায়ালেকটিকস থেকে মার্ক্সকে আলাদা করে দিল - এ কথাটা এত বেমালুম হয়ে গেল কী করে! একটা কারণ হতে পারে মার্কসবাদ যখন রাজনৈতিক কর্মসূচির আদিযুগে নিয়ন্ত্রক তত্ত্ব হয়ে উঠছে, তখন মার্ক্সবাদের তিনটি উপাদান রচনাটিতে লেনিন কিছু কথা সরল করে বলেছিলেন। স্তালিনের দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বইটি হয়ে উঠেছিল মার্ক্সবাদের একমাত্র বর্ণপরিচয়। তাতে মার্ক্সবাদকে এতটা সাফসুরুৎ করা হয়েছে যে পাশ্চাত্য দর্শনে মার্ক্স যে মৌলিক ও একক - সেই ধারণাটিই তৈরি হল না।"
বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্য সম্পর্কে একবার দেবেশ রায় বলেছিলেন, যত বেশি ইংরেজিতে অনুবাদ্য লেখা যেন তত ভাল। এই পাশ্চাত্যমুখী ভালত্বের জড় থেকে নিজের লেখাকে অতিক্রম করার এক অবিরল ধারা তাঁর প্রতিটি লেখায় উৎকীর্ণ, যা কোনও প্রয়াস নয়, যা কোনও চেষ্টা নয়, যা ফল্গু ধারার মতই বহমান। এবং নিজের লেখার ভাষাকে তিনি যে মুক্তি দিতে চেয়েছেন, তার সঙ্গে ভিন দেশের সাহিত্যের কোনও অমিত্রতা ছিল না। অতীব হাতেগোনা কয়েকজনই হয়ত জানেন, দেবেশ রায় অনুবাদ করেছেন শেকসপিয়র, এবং শেকসপিয়রের যে সে বই নয়, 'রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট'-এর মত বইও।
সে বইয়ের ভূমিকার প্রথম লাইন- “অবিরত অকারণ মৃত্যুর তাড়া খেতে খেতে আমাদের প্রজন্মের জীবন কাটল।”
ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুর তাড়া দেবেশ রায় বহুবার খেয়েছেন, যা তাঁকে বারংবার দীর্ণ করেছে। কিন্তু পরিচয় পত্রিকা, যা ছিল দেবেশ রায়ের অন্যতম আইডেন্টিটি, সেই পত্রিকার একটি সংখ্যার প্রচ্ছদে আঁকা ছবির নিচের লেখার মতই, আহত, ভূপতিত, নির্যাতিত, কিন্তু পরাজিত নন তিনি।
দেবেশ রায় ভারতীয় সাহিত্যের সেরা পুরস্কার পেয়েছেন 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত'-র জন্য। 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত' নাটক হিসেবে মঞ্চস্থও হয়েছে। দেবেশ সে নাটকের মহড়ায় হাজিরা দিয়েছেন, একাধিকবার শো-তেও। এমনকি ওই নাটকের পরিচালক, সুমন মুখোপাধ্যায় দেবেশের আরেক মহা উপন্যাস 'সময় অসময়ের বৃত্তান্ত'-ও মঞস্থ করেছিলেন দুয়েকবার।
'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত' শেষ হয়েছিল যে মাদারির মায়ের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উপ-আখ্যান দিয়ে, সেখানে তিনি বাংলার এক বহু পুরনো কথা পুনরুচ্চারণ করেছিলেন। “সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর।”
দেবেশ রায়, বাংলা সাহিত্যের সম্ভবত আধুনিকতম লেখকের জীবনদীপ নিভে গেছে। দেবেশ রায়ের সাহিত্য জনপ্রিয় নয়। দেবেশ রায় নিজের অজনপ্রিয়তা জানতেন। তা সত্ত্বেও তিনি লিখে গিয়েছেন। লেখার কথা লিখেছেন, লিখেছেন স্মৃতির কথা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাতেই আরেক কলাম মনে পড়ে কী পড়ে না-তে তিনি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে লিখেছিলেন, "এই তো মাস দুইও হয় নি - মৃত্যু চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ডেকেছিল, এসো, চলো। আমি তার চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম, কী করে যাই। সেনটেন্সগুলো তো ঠিক আসছে না।”
'রোমিও-জুলিয়েট'-এর ভূমিকার প্রথম লাইনের কথা উল্লেখ করেছি। ওই ভূমিকার শেষ লাইনটায়, ক্রিয়াপদের একটু বদল ঘটিয়ে নিয়েছিলেন দেবেশ রায়।
"অবিরত অকারণ মৃত্যুর তাড়া খেতে খেতে আমাদের প্রজন্মের জীবন কাটছে।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন