অনীশের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা গাঢ় হবার কারণ ছিল একটাই। নয়ত রাত জেগে ঘন্টার পর ঘন্টা ওর সঙ্গে আমি কি আর বকবক করি ফেসবুকে? যতই হোক সোশ্যালনেটের একফালি বারান্দায় এসব উড়ো মিতে মিতেনির দল। কথাতেই বলে অজ্ঞাতকুলশীলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো ঠিক নয়। কিন্তু কী আর করি? আমার তো সব ছিল একদিন। বিয়ে, সংসার, বাড়ি গাড়ি সব। আমার পেটের শত্তুর, আমার একরত্তি সন্তানকে যে কেড়ে নিল ওরা। মেয়েটাকে কিছুতেই দিল না তমোঘ্নর সঙ্গে ডিভোর্সের পর। সেই থেকেই আমি যেন কেমন একটা হয়ে গেছিলাম। কয়েকটা টিউশানি সম্বল। তমোঘ্নর ফ্ল্যাটটা ছাড়িনি আমি। বন্ধুরা জোর করে ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট করে বলল, মন ভালো রাখ। ক্রমেই অনীশের সঙ্গে বন্ধুত্ব।
গানপাগলা অনীশ ফেসবুকে রোজ রোজ সকালে মন ভালো করা গানের ভিডিও পোস্ট করত। সেই থেকে অনীশের প্রতি আমার ভালোলাগা। কোথাও যেন দুজনের মনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ম্যাচিং হল। আমি লেট ফর্টিতে এসে একপ্রকার প্রেমে পড়েই গেলাম অনীশের। গান ছিল আমার ভালবাসার জায়গা। যদিও অনীশের দিক থেকে তেমন কোনো ক্রাশ অনুভব করিনি। তবে দুজন সমমনস্ক মানুষের ভালোবেসে আড্ডা দেওয়াটা রীতিমত নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। ভুলেই গেলাম আমার আগের জীবন। আমার সন্তান, শ্বশুরবাড়ি, পরিবার, টানাপোড়েন সব নিমেষে উধাও আমার জীবন থেকে। কী আর হবে এসব ভেবে? বৃথাই অনুতপ্ত হওয়া। সাইকোলজিস্ট বলেছিলেন ভালো থাকার চেষ্টা করুন। ভুলে যান অতীত। ভাবুন ভবিষ্যত নিয়ে। কাজও হল কাউন্সেলিংয়ে। মাইল্ড ওষুধপালা প্রয়োগে। তবে আমি জানতাম অনীশের সঙ্গে আমার আর যাইহোক একসঙ্গে ঘর বাঁধা হবে না এ জীবনে। তার কারণ দুজনের বয়সের বিস্তর ফারাক। যদিও আজকাল সবই সম্ভব। তাই বলে অনীশের বাবা মায়েরো তো একটা শখ আহ্লাদ আছে ছেলের বিয়ের ব্যাপারে। কেনই বা তারা রাজী হবেন ডিভোর্সি এক মধ্যবয়সী মায়ের সঙ্গে তাদের ছেলের বিয়েতে? আমি জেনেশুনে কারও ক্ষতি করতে চাইনি। অতএব শুধুই ফেসবুক অলিন্দে বেঁচে রইল আমাদের সম্পর্ক, বন্ধুতা, সহমর্মিতা, সমমনস্কতা। সেটাই আমার বেঁচে থাকার রসদ হয়েই থাকুক আপাতত, এটাই মেনে নিলাম। গানের ক্লাসে আবারো ভর্তি হলাম। সেটাও অনীশের কথায়।
আরও পড়ুন, ছোট গল্প: মধুর তুমি
এত কথাবার্তা হয়েছে এযাবৎ আমাদের তবু দেখা করার সময় হয়নি এখনো।
বহুদিন বাদে রবীন্দ্রনাথ আওড়ে উঠলাম... এই তো ভালো লেগেছিল, আলোর নাচন পাতায় পাতায়। কিশোরীবেলায় গান অন্ত প্রাণ ছিল আমার। বইয়ের পর সব যেন বদলে গিয়েছিল।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। রোজ ভোরে উঠেই অনীশের পোস্ট করা গানের ভিডিও দেখে আর শুনে দিনযাপন শুরু হত। মন ভাল করা সব গান। এর নাম মিউজিক থেরাপি। সেটাও অনীশ মনে করিয়ে দেয় বারেবারে। গান শোনা আর গাওয়া হল মধ্য বয়সে ভালো থাকার পাসওয়ার্ড।
রিয়েলিটি শোয়ের ঝলকে নবাগত সব শিল্পীদের দাপটে সঙ্গীতজগত একেবারে রমরম করছে আজকাল। এত চ্যানেল। ডিজিটাল মিডিয়া। প্রচারের আলোয় সব একে একে উঠে আসছে । কী সুন্দর লাগে ভাবলে। কী অপূর্ব এদের গ্রুমিং! বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। মাতিয়ে দেয় মঞ্চ। অনীশের পাঠানো গানের ভিডিও দেখেই মন ভাল হয়ে যেত।
অনীশ কোথায় থাকে, কী তার পছন্দের বিষয়, তারা কয় ভাইবোন এসব নিয়ে কথা হয়নি কখনো। আমাদের দুজনের মধ্যেকার একমাত্র যোগসূত্র ছিল গান আর গান। শুধু জানতাম সে একটি বেসরকারি কলেজে এমবিএ পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। তারপর চাকরি করবে।
সেদিন সকালে ফেসবুক খুলেই দেখি অনীশ একটি অসাধারণ সুন্দর ভিডিও পোস্ট করেছে। মানে রোজ যেগুলি পোস্ট করে তার চেয়ে অনেক আলাদা সেটি।
বিখ্যাত টেলিভিশনের রিয়েলিটি শোয়ের সেই ঝলক দেখেই স্তম্ভিত আমি । মেয়েটির কী অপূর্ব গায়কী! এ মেয়ে উঠবেই একদিন। একটুখানি ক্লিক করেই পজ করে দিলাম। সকালে হাতে প্রচুর কাজ তখন। ভাল করে দেখতে গেলে চশমা পরতে হবে। অনীশের এই পোস্টে কমেন্টের বন্যা। লাইকের লাইকে বানভাসি ফেসবুক। শেয়ার করেছেন প্রায় জনা পঞ্চাশেক মানুষ।
টিভি আমার দেখা হয় না। গল্পের বইয়ের নেশা কুরেকুরে খায় যে। নয়ত আমার মাঝ বয়সী বেকার মেয়েরা এই সময়ে টিভি সিরিয়াল গোগ্রাসে গেলে। শুধু গান চালিয়ে রেখে বই পড়ি আমি । আর সপ্তাহের একদিন গানের গোয়ালে যাই, গান তুলে, শিখে নিজেকে ব্যাস্ত রাখি। তাও অনীশের কথায়। এই বয়সে শিল্পী হওয়ার কোনো বাসনা নেই আমার। আর টিভি দেখিনা বলে এইসব নতুন নতুন টিন এজারদের মুখগুলো ভালো করে চিনিনা। কাগজ খুললে খুব নাম করা, ভিক্টরি স্ট্যান্ডে ওঠা নতুন নতুন ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই।
অনীশের এই ভিডিওটা সেভ করে রাখি। পরে শুনতেই হবে। কী এমন জাদু আছে এর কন্ঠে ? অনীশকে মেসেজ করি। মেয়েটিকে চেনো নাকি? অনীশ আমাকে সেই শিল্পীর ফেসবুক প্রোফাইল দেখার লিংক দেয়। ক্লিক করে দেখটার সময় নেই । অনীশ বলে তার নাকি পরিচিত অনেকদিনের। আপাতত সেই গানবন্ধুর সঙ্গে তার রিলেশনশিপ কমিটেড। কিছুদিনের মধ্যেই নাকি তাদের প্রেমপর্ব বিয়েতে পরিণত হতে চলেছে । শুধু অনীশের চাকরি পাবার অপেক্ষায়।
মনে মনে তখন সেই মেয়েকে আমি হিংসে করতে শুরু করেছি। অতএব তার প্রোফাইল দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই তখন। আফটার অল মেয়েছেলে আমি। তায় আবার অসম্পূর্ণ জীবন আমার। আর অনীশের সঙ্গে আমার ভার্চ্যুয়াল জগতের রিলেশনে সেই মেয়ে এবার ছেদ পড়াবে।
ভাবলাম, বাঁচা গেল। অনীশের প্রতি আমার এই ইনফ্যাচ্যুয়েশনের একটা ফেজ কাটল বুঝি। জীবন থেকে মেঘ সরে গেল এবার। যাক্, এবার সে বিয়ে করে সুখী হোক। ঠাকুর রক্ষে করেছেন।
চিন্তার পরত একে একে সরে গেছিল আমার স্টুডেন্টের আগমনে। তাকে পড়িয়ে নিয়ে দুপুরে স্নান খাওয়া সেরে এবার একটু বিশ্রাম। স্মার্টফোন হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই দেখি, ভোরবেলার সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে ফিরে এসেছে আমার হোয়াটস্যাপের একাধিক বন্ধু গ্রুপে। ফ্লিপ করি। চকিতে টিভি চ্যানেল ঘোরানর মত। একবার ফেসবুক, একবার হোয়াটস্যাপ। কী এমন গেয়েছে এই মেয়ে?
আরও পড়ুন, ছোট গল্প: খোঁচা
ফেসবুকে আবারো অনীশের পোস্ট। উফফ! বড্ড আদিখ্যেতা করছে যেন! আবার নিজের স্ট্যেটাসে লিখেছে "তুই আরো এগিয়ে চল জীবনে, আছি তোর পাশে' সেই ভোরের ভিডিওটিতে ইতিমধ্যে একশো শেয়ারিং হয়ে গেছে। আরও আরও পটাপট লাইক পড়েছে। মেয়েটার প্রোফাইলে ছবি নেই। শুধু বাদ্যযন্ত্র। অনীশ খুব প্রোমোট করছে তার গার্লফ্রেন্ডকে। এর নাম বুঝি সত্যি প্রেম। ভাবলাম, তমোঘ্ন যদি এমন করে আমাকে ভালবাসত!
মনকে প্রবোধ দিই আমি, বাঁচা গেল বাবা। বড় দোটানায় ছিলাম এদ্দিন। ভালোবাসা? তাও আবার ভারচ্যুয়াল? ধুস!
কৌতূহলের পারদ চড়তেই থাকে। এবার আলতো করে আমার আঙ্গুল সেই ভিডিওতে রেখে মোহিত হয়ে শুনতে থাকি সেই মেয়ের কণ্ঠস্বর। অদ্ভুত যেন গায়কী! ফোন রাখা আমার বালিশের পাশে। চোখের বিশ্রাম দি এভাবেই আমি। নয়ত ড্রাই আই সিন্ড্রোমে ভুগি এই সোশ্যালনেটের দায়বদ্ধতায়।
বাইরে অক্লান্ত শ্রাবণের বারিধারা। জানলার কাঁচে জালের ফোঁটা সজোরে আছড়ে পড়ছে তো পড়ছেই। আহা! কি ভাল গাইছে মেয়েটি। নির্মলা মিশ্রের পর "ও তোতা পাখীরে' এত কম বয়সে কেউ গায়নি এমন করে। আর ঐ লাইনটা? আমার মা'কে যদি এনে দাও... শুনে আমার দু চোখ জলে ভরে এল। আমিও তো মা হয়েছিলাম একদিন! আচমকা হাতে তুলে নি ফোন। আহা যার গান এত ভাল লাগল, তাকে একবার চাক্ষুষ দেখব না?
ওমা! এ তো আমারই মেধা! ভীষণ ভাল গাইত ছোট থেকেই। আমিই তো ওকে বিখ্যাত গানের স্কুল সঙ্গীতনন্দনে ভর্তি করে দিয়েছিলাম একদিন! কতটুকুন মেয়েটা এখন সুমেধা হয়েছে ! কত নামডাক হয়েছে তার! এদ্দিনে স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছে হয়ত। কী সুন্দর বডি ল্যঙ্গুয়েজ মেয়ের! গানের সঙ্গে গ্রুমিং হয় যে শুনেছি। আমার আর তমোঘ্নর একদিনের প্রেম ফল।
আমার চোখের জল সেই সঙ্গে ভেসে গেল সেদিনের আকাশ ভেঙ্গে পড়া বৃষ্টিতে। কালো মেঘে আকাশ ডেকে উঠল। সেই সঙ্গে আমার বুক ফেটে গেল যেন!