শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
১
অসময়ে কলিং বেলের আওয়াজ শুনে অবাক হল সুমন। এই ভরদুপুরে আবার কে এল! নির্ঘাত দু’শো টাকায় হাফ ডজন সবজি কাটার ছুরি, অথবা মুদ্রিত মূল্যের অর্ধেকে অখণ্ড শেক্সপিয়ার রচনাসমগ্র–র মত কোনও অদ্ভুত জিনিস গছাতে এসেছে।
সুমন ভেবে পায় না, এই লোকগুলো কী করে বুঝে ফেলে যে ওর মাথাটা টুপি পরানোর পক্ষে একেবারে উপযুক্ত। অন্য লোকে কী সুন্দর এদের খেদিয়ে দেয়, কিন্তু সুমন পারে না। এই হাউজিং কমপ্লেক্সে ও তিন মাসও আসেনি, এর মধ্যে অন্তত এক ডজন অকাজের জিনিস কিনে ফেলেছে। আসলে সুমন কাউকে না বলতে পারে না। কদিন আগে একটা মেয়ে, করুণ গলায় বলল, ‘‘নিন না স্যার। ভাল অফার। ওয়াশিং মেশিনের তিন প্যাকেট গুঁড়ো সাবান কিনলে ৫০০ এমএল–এর এই ফেব্রিক সফ্টনারটা ফ্রি। নিন না, প্লিইজ।’’
রোগাসোগা মেয়েটার ঘামে ভেজা মুখ দেখে সুমনের এমন মায়া হল, যে ৬০০ টাকা দিয়ে তিন প্যাকেট সাবান কিনে ফেলল। সেগুলো এখন বাথরুমের তাকের ওপর পড়ে আছে। কারণ, ওর ওয়াশিং মেশিন নেই!
দরজা খুলে অবাক হল সুমন। সামনে শুভাশিস দাঁড়িয়ে। ওর কলিগ। একই অফিসে কাজ করে দু’জনে, তবে শিফট আলাদা। শুভাশিসের দুপুর থেকে সন্ধে, আর সুমনের নিয়মিত নাইট শিফট। কাজেই দুজনের দেখা হয় খুব কম সময়ের জন্য। হয়ত শুভাশিস বেরোচ্ছে, সুমন ঢুকছে, তখন দেখা হল। শুভাশিস কোনও কারণে রাত অবধি থেকে গেলে, ক্যান্টিনে চা খেতে গিয়ে হয়ত দেখা হল। কিন্তু ওইটুকুই, তার বেশি কিছু হৃদ্যতা, বা বন্ধুত্ব নয়। সুমন দেখল, শুভাশিসের মুখে কান এঁটো করা হাসি। আর তখনই খেয়াল করল শুভাশিসের পিছনে ছোটখাট চেহারাটা। ফুলছাপ সালোয়ার–কামিজ, ওড়না। শুভাশিসের শরীরের আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখছে ওকে। চোখাচোখি হতে সুমনই অপ্রস্তুত হয়ে নজর সরিয়ে নিল।
— ‘‘কী রে, দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকবি! ভেতরে যেতে দিবি না আমাদের?’’ শুভাশিস চোখ নাচাল।
তাড়াতাড়ি দু’পা পিছিয়ে গেল সুমন, ‘‘আয় আয়। আসলে আমি তোকে এক্সপেক্ট করছিলাম না তো, তাই আর কী, মানে, ইয়ে...।’’
— ‘‘আরে আমাদেরও কি ঠিক ছিল আসার! গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল পার্কে। সেখানে মনির পা–টা বেকায়দায় মচকে গেল। হাঁটতেই পারছে না। আমি বললাম... ওহ্ সরি, তোর সঙ্গে তো আলাপ নেই। মনি, এ হচ্ছে সুমন, আমার পুরনো কলিগ কাম বন্ধু, ছোট ভাইয়ের মত। আর সুমন, এ হচ্ছে মামনি, আমার নতুন বন্ধু।’’
‘নতুন বন্ধু’ শব্দদুটোয় কোনও বাড়তি ইঙ্গিত ছিল বোধহয়, মামনি মেয়েটি কপট রাগে চোখ পাকাল। শুভাশিস সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘‘হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, মনির পা মচকে যাওয়ার পর, আমার মনে হল, তুই তো কাছাকাছিই থাকিস, পা–টাকে একটু রেস্ট দিলেই ঠিক হয়ে যাবে, তাই একটা অটো ধরে চলে এলাম।’’
কথা বলতে বলতে শুভাশিস টান টান হয়ে শুয়ে পড়েছে সুমনের বিছানায়। আর মনি, যার কিনা পায়ের রেস্ট হওয়া দরকার, সেও বিছানার ওপরেই, শুভাশিসের গা ঘেঁষে, পা ঝুলিয়ে।
সুমন তাকিয়ে ছিল বোকার মতো। ওর একসঙ্গে অনেক কিছু মনে হচ্ছিল। সেন্ট্রাল পার্ক থেকে ওর বাড়ি মোটেই কাছে নয়। সোজা রাস্তাও নয়, দুটো অটো বদলে, কিছুটা হেঁটে আসতে হয়। কাজেই শুভাশিসের হঠাৎ হাজির হওয়ার অজুহাতটা একেবারেই খোঁড়া। আর বান্ধবীর পা মচকাল, সঙ্গে সঙ্গে শুভাশিসের মনে পড়ল সুমনকে, এটাও নেহাতই ছেঁদো কথা। ওই ‘কলিগ, কাম বন্ধু, ছোট ভাইয়ের মত’— এটাও বাজে কথা। অন্য কোনও ধান্দা আছে শুভাশিসের। কী সেটা, ভাবছিল সুমন।
হঠাৎ তড়াক করে উঠে বসল শুভাশিস। ‘‘উফ, বড্ড খিদে পেয়েছে। তোদের এখানে ভাল চাউমিন পাওয়া যায় না কোথায় একটা? মানস বলছিল।’’
কথাটা শুনেই সুমন সিঁটিয়ে গেল। অঙ্কটা হঠাৎ মিলে গেছে। শুভাশিসকে ওর বাড়ির কথা মানস বলেছে। সুমন একা থাকে। এলাকায় নতুন এসেছে বলে পাড়া–পড়শিরাও ওকে সেভাবে চেনে না। গত এক মাসে মানস তিন তিনবার এসেছে বান্ধবী নিয়ে। তিনবারই ‘খুব খিদে পেয়েছে, চাউমিন খাব’ বলে সুমনকে ঘণ্টাখানেকের জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ির বাইরে। ওর ফাঁকা, নিরিবিলি ফ্ল্যাটের সুযোগ–সুবিধের কথা অফিসে ছড়িয়ে যাচ্ছে তার মানে, বেজার মুখে ভাবল সুমন।
আরও পড়ুন, বিমল লামার ছোট গল্প: পিকনিক
২
— ‘‘আপনি খুব বাইরের খাবার খান, তাই না?’’
— ‘‘অ্যাঁ!’’ সুমন চমকে উঠে অনিতার দিকে তাকাল। কাঠের পাটার ওপর সরু ছুরি দিয়ে পটু হাতে গাজর কাটতে কাটতে একদৃষ্টে ওকে দেখছে অনিতা। সুমনের অস্বস্তি হল। মেয়েটা কথা বলার সময় এমন দিদিমনি মার্কা নজরে তাকায়, যে মনে হয় পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে, আর সুমন আবার ইতিহাসে কম নম্বর পেয়েছে!
অবশ্য ‘দিদিমনি মার্কা’ কেন, অনিতা দিদিমনিই তো। এখনও হয়নি, শিগগিরই হবে। স্লেট পরীক্ষায় খুব ভাল স্কোর করেছে। আর ক’মাস পরেই সরকারি কলেজে চাকরি হয়ে যাবে। অনিতা নিজেই ওকে বলেছে।
খুব অন্যরকম মেয়েটা। খুব সোজাসাপ্টা। সোজাসুজি কথা বলে, সোজা চোখে তাকায়। টিপিকাল মেয়েলিপনা কম। কথাটা ভাবতে ভাবতে আড়চোখে একবার দেখল সুমন। বড় চাটুর ওপর মুরগির মাংসের টুকরো, ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজ, লঙ্কা দিয়ে যেভাবে খুন্তি নাড়ছে, কে বলবে যে এ মেয়ে পাকা রাঁধুনি নয়! হাতের আঙুলগুলো লম্বা লম্বা। হাল্কা রঙের নেলপালিশ পরেছে। টানা টানা চোখ। টিকলো নাক। তাতে নাকছাবি চিকচিক করছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। খুব ছোট্ট একটা সবুজ রঙের টিপ।
এই দোকানে অনিতাকে দেখে প্রথমদিন হকচকিয়ে গিয়েছিল সুমন। সেদিনই দুপুরে মানস প্রথমবার বান্ধবীকে নিয়ে সুমনের ফ্ল্যাটে এসেছিল। চাউমিনের অর্ডার দিয়ে সুমনকে প্রায় ধাক্কা মেরে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেওয়ার সময় দরজা বন্ধ করতে করতে মানস ফিসফিসিয়ে বলেছিল, এক ঘন্টার আগে ফিরিস না কিন্তু!
কোথায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে, সোজা বাজারের মুখে এই দোকানটায় এসে দাঁড়িয়েছিল সুমন। অনেক দিনই রাতে এখান থেকে খাবার কিনে নিয়ে বাড়ি ঢোকে, কিন্তু কোনওবার অনিতাকে দেখেনি। সেদিন দেখল। ফুটপাথের রোল–চাউমিনের দোকানে এমন ঝকঝকে চেহারার মেয়ে বেমানান। কৌতূহলী হয়েছিল সুমন, কিন্তু সেদিন কোনও কথা হয়নি। ও দূর থেকে খেয়াল করছিল, কিন্তু একবার চোখাচোখি হয়ে যাওয়ার পর আর তাকাতে সাহস পায়নি। কথা হল পরের বার। এক সপ্তাহ পরেই। মানস সেদিন ফের এসে হাজির। সবান্ধবী। সেবার আর সুমনকে কিছু বলতে হয়নি, ও নিজেই, ‘যাই, তোদের জন্যে একটু খাবার নিয়ে আসি’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
সেদিন নিজেই কথা শুরু করেছিল অনিতা। সুমন জেনেছিল, দোকানটা অনিতার এক মাসির। এখানেই থাকেন। এতদিন তাঁর বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছে জলপাইগুড়ির মেয়ে অনিতা। মেসো ইন্ডিয়ান আর্মির সুবেদার ছিলেন, কারগিল যুদ্ধে শহিদ হন। সরকার থেকে দোকানটা করে দিয়েছে। সকাল–সন্ধে মাসি নিজেই বসেন, কিন্তু দুপুরের কয়েক ঘন্টা মাসি বাড়ি গেলে অনিতা সামাল দেয়। কিন্তু সেটাও বেশিদিন যে চলবে না, অনিতা যে চাকরি শুরু করবে, হয়ত দূরের কলেজে পোস্টিং দেবে, সেই নিয়ে অনিতার দুশ্চিন্তা, সব জেনে গিয়েছিল সুমন। এমনিতে ও নিজে মুখচোরা। পারতপক্ষে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। কিন্তু সেদিন ওর ভাল লেগেছিল অনিতার কথা শুনতে। কী সহজ, স্বাভাবিক! কোনওভনিতা নেই, অকারণ ন্যাকামি নেই। তৃতীয়বারের দেখায় সুমন তাই নিজের কথা বলেছিল। বীরভূমে ওর গ্রামের বাড়ির কথা, কলকাতায় ওর পড়াশোনা আর চাকরি পাওয়ার কথা।
— ‘‘কী, বললেন না? খুব বেশি বাইরে বাইরে খান?’’
হাসল সুমন। ‘‘আমি এই প্রথম দেখলাম দোকানি খদ্দের তাড়াতে চায়। আমি খাওয়া বন্ধ করলে কি আপনার লাভ?’’
লজ্জা পেল অনিতা। ‘‘আমি মোটেই আপনাকে তাড়াতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি, নাইট ডিউটি করতে হয় যখন, রোজ বাইরের খাবার না খাওয়াই ভাল।’’
— ‘‘খাই না তো! বন্ধুর জন্যে কিনে নিয়ে যাচ্ছি। ওরা খাবে।’’
— ‘‘ওরা মানে? কারা ওরা?’’ চোখ সরু হয়ে গেছে অনিতার।
ঢোক গিলল সুমন। ‘‘ওই তো, আমার অফিস কলিগ, আর ইয়ে... তার বান্ধবী।’’
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে অনিতার। তার মধ্যে কি সামান্য রাগও আছে? তীব্র গলায় বলল, ‘‘অফিসের কলিগ বান্ধবী নিয়ে আসে, আর আপনি এই ভরদুপুরে, বিশ্রাম না নিয়ে, তাদের জন্যে খাবার কিনতে আসেন! এতদিন ধরে তাইই চলছে? ওদের খিদে পেলেই আপনার বাড়ি চলে আসছে?’’
সুমন বিব্রত গলায় বলল, ‘‘না, এরাই সব বারে আসে না, আমার আরেক কলিগ আছে। সেও মাঝেমাঝে...’’
কথার মাঝখানে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিতা, ‘‘দাঁড়ান দাঁড়ান, ব্যাপারটা একটু বুঝতে দিন। আপনার অন্য কলিগরাও আসে? তারাও বান্ধবী নিয়ে আসে? আর এসেই আপনাকে চাউমিন কিনতে পাঠায়?’’
বিপন্ন মুখে প্রতি প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে যাচ্ছে সুমন। ওরও কি আসতে ভাল লাগে! কিন্তু কীই বা করার আছে! অনিতা খামোকা চটে যাচ্ছে ওর ওপর। এখন প্রায় ফুঁসছে একেবারে!
আরও পড়ুন, নীহারুল ইসলামের পাগলের পাগলামি কিংবা একটি নিখাদ প্রেমের গল্প
৩
সুমন দরজা খুলেই দেখল মানস। দাঁত বের করে হাসছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে পিঙ্কি। ওর বান্ধবী। নিয়মিত যাতায়াত করতে করতে পিঙ্কিরও আর সঙ্কোচ নেই। সুমন কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অনিতা। মানস আর পিঙ্কি চমকে উঠল, যেন ভূত দেখছে।
সুমন অতি কষ্টে হাসি চেপে বলল, ‘‘অনিতা, আলাপ করিয়ে দিই। এ হল মানস, আমার কলিগ। আর ও পিঙ্কি, মানসের বান্ধবী।’’
অনিতা একগাল হেসে বলল, ‘‘তুমি এদের কথাই বলছিলে সেদিন? আসুন ভাই, ভেতরে আসুন।’’
মানস ছিটকে উঠে বলল, ‘‘না না, আজ আর বসব না। ডিসটার্ব করছি না তোমাদের। বরং আরেকদিন আসব।’’
অনিতা মধুমাখা গলায় বলল, ‘‘হ্যাঁ, আসবেন। আমি তো থাকবই। দেখা হবে।’’
দরজা বন্ধ করে পিছন ঘুরে সুমন দেখল, অনিতা ঠোঁট টিপে হাসছে। দু’চোখের তারা ঝিকমিক করছে।
হেসে ফেলল সুমন। ‘‘এক সপ্তাহ ধরে রোজ দুপুরে পাহারা দেওয়ার ফল তা হলে পাওয়া গেল! কিন্তু একটা ভূত না হয় তাড়ালাম, অন্যজনের কী হবে? তাকে ঠেকাতেও কি নিজের কাজকম্ম ফেলে পাহারা দেবে নাকি?’’
— ‘‘চিন্তা কোরো না। যেভাবে তোমার ফাঁকা ফ্ল্যাটের কথা অফিসে ছড়িয়েছিল, সেভাবেই আবার সবাই জেনে যাবে যে ফ্ল্যাট আর ফাঁকা নেই! আমাকে আর এসে পাহারা দিতে হবে না।’’
অনিতার শান্ত, স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে সুমন মুচকি হাসল, ‘‘আর এই কদিনে আমার অভ্যেসটা যে খারাপ হল, তার কী হবে?’’
অন্যদিকে তাকিয়ে অনিতা বলল, ‘‘অভ্যেস শুধরে ফেল। আমার ঝাড়গ্রামে পোস্টিং হয়েছে। এক মাস পর চলে যাব। তখন কী করবে?’’
তার পর ওর দিকে ফিরে, সোজা সুমনের চোখের দিকে তাকাল অনিতা। যেভাবে ও তাকায়। ‘‘অথবা চাকরি বদলাও। ছেড়েও দিতে পারো চাকরি। সরকারি কলেজে এখন লেকচারারদের ভালই মাইনে। তুমি বরং সংসার সামলিও।’’
— ‘‘ঠিকমত রান্নাটাও করতে পারি না যে!’’ করুণ গলায় বলল সুমন।
— ‘‘শিখে যাবে। শিখিয়ে দেব সব।’’ অনিতার গলায় কৌতুকের সঙ্গে মিশে আছে অপার প্রশ্রয়।