সাংবাদিক হওয়ার দরুণ জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সমৃদ্ধ। রাজনীতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা আলোছায়াময় অন্ধকার তাই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে ‘অন্যদেশে’।
“শিউপূজন ঠিক বলেছে। আমরা এই অন্য ভারতগুলির কাছে যাই ট্যুরিস্ট হয়ে। ওদের নিয়ে ডি এস এল আর ক্যামেরায় ছবি তুলি। ওদের নিয়ে প্রবন্ধ লিখি। ওদের নিয়ে সিনেমা বানাই। ওদের নিয়ে রাজনীতি করি। ওদের সম্পর্কে সেমিনার করি। ওদের জন্য কাজ করে শাসকের থেকে পুরস্কারও নিই। কিন্তু ওদের মধ্যে কোনোদিন ঢুকিনা। এই যে ইন্ডিয়ার মধ্যে থাকা আর একটি ভারত সেটি খুব ইন্টেরেস্টিং। আমরা এদের কাছে গেলেও চোখে থাকে একটি অদৃশ্য বায়নোকুলারের উল্টোদিক। যা এদের জীবনযাত্রাকে আমাদের পর্যবেক্ষণ থেকে আদতে অনেক দূরের করে দেয়। অথচ ভান করি আমরা এদের চিনি, জানি, বুঝি।“ সেই অন্য ভারত এই গ্রন্থের অনেকটাই অংশ নিয়ে আছে। কয়েকটি লেখায় মিশেছে পালটে যাওয়া সমাজের বিপজ্জনক আগ্রাসী হওয়ার বিবরণ। আর বাকী কিছু রচনার বিষয় স্মৃতি। “বাঙালীর নিজস্ব ফেলে আসা কিছু কৈশোর, কিছু যৌবন আর অনেকটাই মেদুর ভালোলাগা…। ছুটির দিন ফুরনো সন্ধের মন খারাপের মতো”। – তাই প্রতিটা অধ্যায়ে আপাত দৃষ্টিতে দেশ বলতে গড়ে ওঠা সংজ্ঞাটা পালটে যায়। মুখোশ থেকে যেভাবে মুখ বেরিয়ে আসে, সেভাবেই লেখকের হাত ধরে আমরা ধীরে ধীরে পা রাখি সেই অন্যদেশে যেখানে চোরা বালির স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বহু মানুষকে। প্রতিটি অধ্যায় যেন উন্মোচিত হচ্ছে সমাজ সত্য, রাজনীতির নগ্ন স্বরূপ। বুননের বিন্যাস স্বাক্ষর দিচ্ছে এক একটি না জানা গল্পের বাস্তবকে চোখের সামনে তুলে ধরার। শুধু দেখা নয়, তাকে উপলব্ধির যন্ত্রণা আর দূরদৃষ্টি মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করায় একই দেশের ভেতর লুকিয়ে থাকা আর এক দেশে আর এভাবেই সমাজ বাস্তবতার দলিল হয়ে ওঠে ‘অন্যদেশ’।
আরও পড়ুন, জয় গোস্বামীর বইয়ের সমালোচনা পাড়া-ক্রিকেট ও স্মৃতির যৌথভাণ্ডার
যেসব মানুষগুলোকে আমরা করুণার দৃষ্টিতে দেখি, যেসব দুর্ভিক্ষের পেইন্টিং বিক্রি হয় লাখ লাখ টাকায়, যে শিশুদের কোন শৈশব হয়না তাদের জীবন-সত্যের, জীবন সংগ্রামের নিখুঁত ছবিগুলো একটা একটা করে উঠে আসে। আদিবাসী মানুষগুলোর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় তাদের প্রকৃতি, প্রতিটি প্রকল্পে সরকারি অনুদানের পরিমাণ কমতে থাকে। শান্তিপূর্ণ জীবনের আশ্রয় ছেড়ে মাইগ্রেটেড লেবার হয় এই মানুষগুলো। রাজনীতির ‘মাথা’ দের দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে শুরু হয় –‘আজ কাল পরশুর গল্প’। এই গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ে যেন চেনা মুখে অচেনা মানুষকে দেখা যায়। আমাদের এই কৃষিনির্ভরশীল সভ্য দেশে প্রতি ঘণ্টায় কজন করে কৃষক আত্মহত্যা করে এবং কেন তার মর্মান্তিক সরলীকরণের সমীকরণটি দেখানো হয় এখানে। বাজেট আর খাদ্য সুরক্ষা আইনের ভয়াবহ পরিণাম কি উচ্চ প্রতিষ্ঠিতদের গদি স্পর্শ করে? – অত্যন্ত সন্তর্পণে লেখক মুখোমুখি নিয়ে গিয়ে দাঁড় করান সেই সত্যের-
“ ভারতের অন্দরে সকলের অলক্ষ্যে এই আম আদমি বনাম নিও মিডল ক্লাসের একটি অপ্রত্যক্ষ লড়াই চলছে। এ যেন দুটি অ্যাপস। শেষ পর্যন্ত কোন অ্যাপস সফলভাবে ডাউন লোড করবে আজকের ভারত”।
‘নারী দিবস’ পালন করা হয় অথচ চাষবাসের সমস্ত কাজ করেন যে মহিলা তিনি আত্মহত্যা করলে কিন্তু ক্ষতি পূরণ দিতে হয়না কারণ তিনি তো কৃষকের স্ত্রী। এরকমই মননশীল চিন্তার ধারক ও বাহকেরা ‘আচ্ছেদিনে’র অপেক্ষা করেন। গণতান্ত্রিক দেশে এদের ভোটেই রচিত হয় গণতন্ত্রের সরকার যারা উন্নয়ন বলতে আসলে কি বোঝেন, সেটাই স্পষ্ট নয়।
‘অন্যদেশ’ বইটিতে লেখক এক চলমান জীবনের ছবি এঁকেছেন।
কবিতা অথবা টমাস হার্ডির ‘The time of the breaking of Nation’ কিংবা বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ এর প্রস্তাবনায়- ‘ইহাদের কথাই বলিব’- কোথাও যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। যুগে যুগে রচনা হয়ে চলেছে ইতিহাসের বিরাট ট্রাজেডি, মনুষত্বের ধ্বংসাবশেষ, মানবতার ফসিল। সভ্যতার পিলসুজ এই মানুষগুলোর গা দিয়ে গড়িয়ে পড়া তেল, ময়লা কালির এই নিখুঁত ছবির- রূপায়ণ রয়েছে এই বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে। উৎসব বা কার্নিভালে মেতে ওঠা নাগরিক জীবনের পুষ্প সম্ভারের অন্যদিকে অন্ধকার আনাচে কানাচে উঁকি দিচ্ছে মৃত্যুর বিভীষিকা। সূর্যও বুঝি মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সেখান থেকে, যেখানে দেখা যায় ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট রাতারাতি বাতিলের প্রস্তাবে – শুধু কালো টাকাই রোধ হয়না। একই সাথে তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়ে জমি কেনা ও বিক্রির পথে অন্তরায় তৈরী হয়। আর আত্মহননের পথকে বেছে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় বহু পরিবার। এইভাবে এই বইয়ের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে ‘মিথ্যে যুগ’ এর নির্মম বাস্তব স্বরূপ। প্রাইভেসিকে পাবলিক করে আমরা কীভাবে রাষ্ট্রের হাতে নজরবন্দী হচ্ছি এ প্রসঙ্গে জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’ এবং টম ক্রুজের সিনেমা ‘মাইনরিটি রিপোর্ট’ (১৯৯২) এর উল্লেখ নিঃসন্দেহে লেখকের সমৃদ্ধ মেধার দাবি রাখে। সাক্ষী হয়ে ওঠে এক সুচিন্তিত যুক্তিবুদ্ধি প্রবণ মনন।
এই ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিটি অধ্যায়ের উন্মোচিত সত্যে আলোকপাত সম্ভব নয়। অকপট সমাজ সত্যকে তুলে ধরার আবেদন রয়েছে লেখকের কলমে। ‘আত্মমগ্ন’ পাঠ তাঁকে নিয়ে দাঁড় করায় সমাজ দর্পণের সামনে। শাসক, শাসন, শোষক, শোষিত, লড়াই, প্রতিবাদ- অসহায়তার বোধে একা করে দেয় আমাদের প্রত্যেককে। ‘অন্যদেশ‘ কড়া নাড়ে চেতনার প্রত্যুষে।
বাংলা সমাজ-সংস্কৃতি রাজনীতির সামগ্রিক অবক্ষয় কখনো উঠে আসে বাংলা সিরিয়ালের গল্পগুলিতে, কখনো নেতাদের অন্তঃসারশূন্য ভাষণে- যা শুধুই চটুল, সস্তা হাততালি বা বাহবায় সন্তুষ্ট থেকে যায়। এভাবেই অন্বেষণের দৃষ্টি বোধহয় হারিয়ে ফেলছি আমরা। সামাজিক উত্থানে কিন্তু মানবিক অবক্ষয়ের প্রশ্নটি থেকেই যায়। ধাপে ধাপে দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ‘অন্যদেশ’-এর পর্দাগুলি লেখক সরিয়ে দেন। বাইরে থেকে সাজিয়ে রাখা ঘরের ভেতরের ছবিগুলো আগল ভেঙে অনর্গল হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্রের’ ভাষায় “সদরে তোমাদের একটুখানি বাগান আছে। ঘরে সাজ সজ্জা আসবাবের অভাব নেই। আর অন্দরটা যেন পশমের কাজের উল্টোপিঠ। সে দিকে কোন লজ্জা নেই, শ্রী নেই, সজ্জা নেই”।
কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন না করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে লেখক তুলে ধরেছেন বিষাক্ত জর্জরিত সমাজকে। তাই সি পি এম , কংগ্রেস তৃণমূল বা বিজেপি নয়, পদ্ধতির ঠিক ভুল বিচার নয়, বিষের পরিণাম তিনি বারবার তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। ‘মজার কথা’ অধ্যায়টি এমনই এক প্রতিফলন। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা যে কিভাবে বর্তমানে পদানত এবং অশিক্ষার প্রচার ও প্রসার করে চলেছে তার বিভিন্ন ঘটনাকে লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন। দেশের অন্যরাজ্যের আদিবাসী অথবা দলিত ছাত্র ছাত্রীরা যখন বিকাশোন্মুখ ঠিক তখন অকৃতকার্য, অপদার্থ ছাত্রছাত্রীদের পাস না করানোর অভিযোগে শিক্ষকবৃন্দ ঘেরাও হন সেইসব ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের দ্বারা। ওপরমহল থেকে নির্দেশ জারি হয় এইসব অযোগ্যদের যোগ্যতার প্রমাণপত্র দেওয়া হোক। এভাবেই পিছিয়ে পড়ে সবকিছু, অযোগ্য নিয়োগ বেড়ে চলে। তাই বাঙালি মধ্যবিত্তের সঙ্কট আলোচনায় অসাধারণ একটা লাইন দিয়ে শেষ করেছেন লেখক। -“বাঙালী মধ্যবিত্ত অবশেষে মধ্যমেধায় সুখী”।
পরবর্তী অধ্যায়ে সমালোচিত হয়েছে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। মানুষকে আরো অথর্ব পঙ্গু করে দিচ্ছে এই রাজনীতি। অর্জন করতে শিখছে না সে অথচ পেয়ে যাওয়ার অন্তঃসারশূন্যতায় উদ্ভাসিত। অকপট সত্যকথনে মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ‘দুরন্ত আশা’ কবিতার দুলাইন-
“হেলায় মাথা, দাঁতের আগে
মিষ্টি হাসি টানি
বলিতে আমি পারিব নাতো
ভদ্রতার বাণী”।
এই বইয়ে মনোরঞ্জনের দায় চোখে পড়বে না। দায়িত্ব আছে, সে দায়িত্ব সমাজের অভ্যন্তরে আলোকপাতের।
ভারতের আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণে আমেরিকাপন্থী মনোভাব কি ভারতকে রক্ষা করতে সমর্থ হবে?- এই প্রশ্ন সরাসরি ছুড়ে দিয়েছেন লেখক। পিংক সিনেমার অনুষঙ্গ টেনে এনে বোঝাতে চেয়েছেন, নিজেদের মধ্যেকার শক্তিতে আস্থাবান হলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য অন্য শক্তির হাত ধরতে হয় না। রাশিয়া বা প্যালেস্টাইনের মত দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বদলে যাওয়া সমীকরণের ফল যে আশানুরূপ হয়নি, তা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি।
বইয়ের শেষ অংশ ‘নস্টলজিয়া’ একেবারে অন্যস্বাদের পরিবেশনা। অন্যদেশ, অন্যমানুষ পেরিয়ে চেনা মুখ সুখ দুঃখের হদিস পেতে লেখক এসে দাঁড়ান “মন খারাপের হেমন্তে’ – যেখানে কর্মব্যস্ত কলকাতার ছবি আর জন অরণ্যে একা অনুভব হওয়া সিকিউরিটি গার্ডের নিঃসঙ্গতায় আলোকপাত করেন লেখক। হারাধনের দশটি ছেলে থেকে ক্রমে ক্রমে নিরালা সময়ে ভ্রমণ করে মন। ভরভরন্ত সংসার থেকে একা হয়ে যাওয়া বৃদ্ধা মা -বাবার কাছে দূরভাষে সুদূর প্রবাস থেকে বিজয়া দশমীর প্রণাম আসে। খবর পাওয়া যায় শহর থেকে ব্রেক-আপ, মিউচুয়াল সেপারেশন আর আচমকা মৃত্যুর। হঠাৎ এসে পড়া দুদিনের জ্বরে সতেজ যৌবনকেও মাথা নোওয়াতে হয়। আর সেইসব পরিবারগুলি একাকিত্বের, নিঃসঙ্গতার উৎসব পালন করে নীরবে। সদ্য বিবাহ বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠতে না পারা তরুণী লোকলজ্জায় মুখ লোকাতে চায়। এভাবেই জীবনের গল্পে এ লেখা অন্যমনস্ক করে তোলে, চোখের কোণ ভিজে যায়।
অনুভূতির কাছে এ বই চিরকালীন। শেষ হয়েও তাই শেষ না হওয়ার রেশটুকু থেকে যায়। লেখকের বলে যাওয়া কথার ভিড়ে না বলা কথারাও জায়গা করে নেয়। যে যার নিজের মতন করে ভাবতে থাকি আর এখানেই ‘অন্যদেশ’ পড়ার সার্থকতা।
অন্যদেশ
সমৃদ্ধ দত্ত
ধ্যানবিন্দু